পুতিন ও তাঁকে ঘিরে থাকা অভিজাতদের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে একটি গৃহযুদ্ধ
পুতিন ও তাঁকে ঘিরে থাকা অভিজাতদের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে একটি গৃহযুদ্ধ

মতামত

যে কারণে ইউক্রেনকে ধ্বংস করতে চান পুতিন

ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বর্বর এক যুদ্ধ শুরু করেছেন। এর কারণ হলো, তিনি বিশ্বাস করেন, রুশ ও ইউক্রেনীয়রা একই জাতির মানুষ। ইউক্রেনে আগ্রাসনের ক্ষেত্রে পুতিন যেসব যুক্তি দেখিয়েছেন, তার মধ্যে সুনির্দিষ্ট করে দুটি যুক্তি উল্লেখযোগ্য। প্রথম যুক্তিটি হলো, ইউক্রেন হলো ‘রাশিয়াবিরোধী’। এটা সুস্পষ্টভাবে অবাস্তব যুক্তি। দ্বিতীয় যুক্তিটি হলো, ‘রুশ ও ইউক্রেনীয়রা একই জাতির মানুষ’। প্রথম যুক্তির প্রেক্ষাপটে দ্বিতীয় যুক্তিটি অসংগত। যদিও এই যুক্তির জোরেই রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে আরও বেশি খুনে আচরণ করছে।

রাজনীতির ক্ষেত্রেও দেখা যায় উদ্ভট বলে মনে হওয়া কোনো বিষয়ই শেষ পর্যন্ত কোনো ঘটনার মূল কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পুতিনের দেওয়া দুটি যুক্তিরই গভীর ঐতিহাসিক শিকড় ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ রয়েছে। এ কারণগুলোর পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় এবং ব্যাখ্যা প্রয়োজন। মধ্যযুগে মস্কোর রাজপুত্রদের উত্থান এবং রুশ সাম্রাজ্যের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

মস্কোর রাজপুত্ররা প্রথম যুগে শক্তি সঞ্চয় করেছিলেন মঙ্গল সাম্রাজ্যের অধীনে করসংগ্রাহক হিসেবে। মঙ্গল প্রভুদের কাছ থেকে নিষ্ঠুর স্বৈরতন্ত্রের পাঠ নিয়েছিলেন মস্কোর রাজপুত্ররা। তাঁদের সহযোগিতাতেই নিজেদের রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছিলেন। শেষে প্রভুদেরই বিতাড়িত করে দিয়েছিলেন তাঁরা। এরপরই মস্কোর শাসকেরা রাশিয়া ভূখণ্ডে তাঁদের সাম্রাজ্য সুসংহত করেন। তাঁদের উত্তরসূরিরা হলেন ‘সব রাশিয়ানের সম্রাট বা কাইজার’।

ইতিহাস বলে, মস্কোকে কেন্দ্র করে স্বৈরতান্ত্রিক সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। কিন্তু এর আশপাশে বিকল্প শাসনব্যবস্থাও ছিল। উত্তর-পশ্চিমে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বাণিজ্যিক প্রজাতন্ত্র নভগ্রদ। লিথুয়ানিয়া রাজ্যটিতে (বর্তমানের বেলারুশ ও ইউক্রেন এ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল) মধ্যযুগের ইউরোপের বিবেচনায় অনেক বেশি সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। ষোড়শ শতকে লিথুয়ানিয়ার অভিজাতদের দ্বারা পরিচালিত কেন্দ্রীয় কিংবা প্রাদেশিক পরিষদের হাতে প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রিটিশ ও আইবেরিয়ানদের তুলনায় বেশি ক্ষমতা ছিল। লিথুয়ানিয়ার দাপ্তরিক ভাষা ছিল পুরোনো বেলারুশ। রাজ্যটির অভিজাতদের বেশির ভাগই ছিলেন অর্থোডক্স খ্রিষ্টান এবং জাতিগতভাবে রুশ।

পুতিন ও তাঁকে ঘিরে থাকা অভিজাতদের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে একটি গৃহযুদ্ধ। এটা রাশিয়া প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের সঠিকতা সম্পর্কে তাঁদের যে ধারণা তারই প্রতিফলন। স্বৈরতন্ত্র ভালো এবং স্বাধীনতা হচ্ছে খারাপ—এ ধারণা রাশিয়ার অনেক নাগরিক পোষণ করেন। একই সঙ্গে একটা প্রতারণামূলক মনস্তাত্ত্বিক ধারণাও তাঁরা পোষণ করেন। সবাই ভয় করে এমন একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়ার জন্য তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিস্বাধীনতাও বিসর্জন দেন।

এখানে কসাকদের রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিষয়টিও বিবেচনা করতে হবে। কসাকরা ছিলেন কৃষক। দাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে পোলিশ-লিথুয়ানিয়ার বিরান সীমান্তে তাঁরা বসবাস শুরু করেন। কসাকরা নিজেদের বীরের জাতি বলে পরিচয় দিতেন। ক্রিমিয়ান তাতার, অটোমান তুর্কি, পোলিশ ও রুশদের বিরুদ্ধে সামরিক আধিপত্য দেখিয়েই তাঁরা তাঁদের স্বাধীনতা অর্জন করেছিলেন। কসাকরা তাঁদের হেটম্যান অথবা রাজ্যের প্রধান এবং শাসক পরিষদ নির্বাচিত করেছিল। ১৭৬৪ সালে রুশ সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন কসাকদের এসব প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়ার আগপর্যন্ত ২০০ বছর তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু রেখেছিলেন।

নভগ্রদকে রক্তগঙ্গায় ভাসিয়ে ধ্বংস করেছিলেন মস্কোর শাসক চতুর্থ আইভান, যিনি ইতিহাসে ‘দুর্দশা ডেকে আনা আইভান’ নামে পরিচিত। ১৭৭৫ সালে কসাকদের বিরুদ্ধে মস্কোর শাসকেরা গণহত্যা চালিয়েছিলেন। সে সময় ২০ হাজার কসাককে হত্যা করা হয়েছিল। ইতিহাসের এই দুটি অধ্যায় রাশিয়ার ভূমিতে স্বৈরতান্ত্রিক শাসন (রুশকিয়ে মির) প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল।

আজকের ইউক্রেন সংঘাতের কেন্দ্রীয় কারণ খুঁজতে হলে রুশ সাম্রাজ্যের এই আধিপত্যবাদী মতাদর্শের দিকে ফিরে তাকাতে হবে। এ ধরনের মতাদর্শ মস্কোর শাসকদের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল। লিথুয়ানিয়ার অভিজাততন্ত্র, নভগ্রদের প্রজাতন্ত্র, কসাক, ইংরেজ ব্যারন কিংবা আমেরিকার উপনিবেশ স্থাপনকারীদের সমকক্ষ তারা ছিল না। সে কারণেই আভিজাত্য রক্ষার জন্য এ ধরনের বিধিবহির্ভূত নির্বাহী ক্ষমতার চর্চার প্রয়োজন মস্কোর শাসকদের হয়েছিল।

এই বয়ান দুটি প্রধান প্রতিপাদ্যের সঙ্গে জড়িত। প্রথমটি হচ্ছে, কাইজার বা সম্রাট হচ্ছেন সব জনগণের ‘ছোট পিতা’। অভিজাত প্রভুদের সঙ্গে তাঁরা ক্রীতদাসের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে, রাশিয়ার জনগণ সাংবিধানিক স্বাধীনতা ভোগ করতে যোগ্য নয়। এই বয়ানের অর্থ হচ্ছে, রাশিয়ানরা পশ্চিমাদের মতো নিজেদের সাংবিধানিক পন্থায় শাসন করতে অক্ষম। ‘শক্ত হাতে’ শাসন করতে পারে, এমন শাসক তাদের জন্য প্রয়োজন। রাশিয়ানরা মনে করেন, শাসনক্ষমতার ভাগাভাগি মানেই হলো রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেওয়া। এর ফল হবে, বহিঃশক্তির হুমকির মুখে রাষ্ট্রকে সঁপে দেওয়া। চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতাকে বিনষ্ট করা।

আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি, ইউক্রেনীয়দের ‘রুশবিরোধী’ বলা হচ্ছে। স্বৈরতন্ত্র দিয়ে রাশিয়ার রাষ্ট্রব্যবস্থাকে যদি সংজ্ঞায়িত করা হয়, এবং রুশ ও ইউক্রেনীয়রা যদি একই জনগোষ্ঠীর হয়, তবে সফলভাবে সাংবিধানিক শাসন পরিচালনা করে ইউক্রেনের মানুষেরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, মস্কোকেন্দ্রিক স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের মিথটা ঐতিহাসিকভাবে ভুল।

অন্য ইউরোপীয়দের মতো রাশিয়ানদেরও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও কার্যকর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বাধীনতা রয়েছে। অন্য সব কার্যকর রাষ্ট্রের মতো রাশিয়াও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী ও ভূরাজনৈতিক দিক থেকে প্রভাবশালী হয়ে উঠতেই পারে। কিন্তু সে জন্য রাশিয়াকে স্বৈরতান্ত্রিক হওয়ার তো প্রয়োজন নেই। রাষ্ট্রীয় এই স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাবের কারণেই সম্প্রতি রাশিয়ার একটি টেলিভিশনে একজন ভাষ্যকার বলতে পেরেছেন, ‘ইউক্রেনীয় হওয়ার এই ধারণা পরিপূর্ণভাবে নির্মূল করা প্রয়োজন।’

পুতিন ও তাঁকে ঘিরে থাকা অভিজাতদের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ হচ্ছে একটি গৃহযুদ্ধ। এটা রাশিয়া প্রতিষ্ঠার ইতিহাস এবং সেই ইতিহাসের সঠিকতা সম্পর্কে তাঁদের যে ধারণা তারই প্রতিফলন। স্বৈরতন্ত্র ভালো এবং স্বাধীনতা হচ্ছে খারাপ—এ ধারণা রাশিয়ার অনেক নাগরিক পোষণ করেন। একই সঙ্গে একটা প্রতারণামূলক মনস্তাত্ত্বিক ধারণাও তাঁরা পোষণ করেন। সবাই ভয় করে এমন একটা শক্তিশালী রাষ্ট্রের বাসিন্দা হওয়ার জন্য তাঁরা নিজেদের ব্যক্তিস্বাধীনতাও বিসর্জন দেন। অনেক রাশিয়ান বিদেশিদের কাছে বলেন, ‘আমি আমার রাষ্ট্রকে ভয় পাই, কিন্তু এটা তো আমার রাষ্ট্র। তুমি আমার রাষ্ট্রকে ভয় পাও, কিন্তু সেটা তোমার রাষ্ট্র নয়।’ কিন্তু ভাবুন তো, বিদেশিদের কাছে যদি সেই ভয় ভেঙে যায়, তাহলে কী ঘটবে।

সে কারণেই ইউক্রেনের কাছে পরাজিত হলে, সেটা রাশিয়ার জন্য হবে নতুন যুগের সূচনা। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমারা শীতল যুদ্ধ জয় পেয়েছিল। কিন্তু এরপরও রাশিয়ায় কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসান হয়নি। সোভিয়েত স্বৈরতন্ত্র থেকে যে পশ্চিমা গণতন্ত্র শক্তিশালী, সেটা প্রমাণের সময় এসেছে।

প্রজেক্ট সিন্ডিকেট: অনুবাদ মনোজ দে

ইয়াসেক রোসতোয়াস্কি: পোল্যান্ডের সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী