যে উদ্যোগগুলো নেওয়া জরুরি

দেশে ধর্ষণ যেন থামছেই না। তুফানগতিতে চলছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ২৮০টি। এর মধ্যে ১৬ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় এবং আত্মহত্যা করেছে ৫ জন। অন্যদিকে শিশু ধর্ষণের হার প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে ৩ গুণ বেশি। কিন্তু এ রকম তো চলতে দেওয়া যায় না। ধর্ষণ প্রতিরোধে সামগ্রিকভাবে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

সব ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করার পরও আমরা হয়তো ধর্ষণ পুরোপুরি প্রতিরোধ করতে পারব না, তবে সচেতনতা, সতর্কতা, সামাজিক ও আইনি প্রতিকার এ সংখ্যা অনেক কমিয়ে আনতে পারে। প্রতিরোধের জন্য নারীকেএমনভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে, যেন তারা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে শেখে যে ‘না’ বলার ও ‘আত্মরক্ষার’ অধিকার ও সক্ষমতা তার রয়েছে।  নারীকে ‘মানুষ’ নয় ‘ভোগের সামগ্রী’ হিসেবে ভাবার পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন করতে হবে।

প্রতিরোধের উপায়

প্রথমেই প্রয়োজন ধর্ষণ-সংস্কৃতিকে উসকে দেয়, প্রশ্রয় দেয় তেমন সমাজকে ধর্ষণবিরোধী, ধর্ষণ প্রতিরোধী সমাজে রূপান্তর করা। এর জন্য গল্প, উপন্যাস, নাটক, সিনেমা, বিজ্ঞাপনে নারীকে ‘যৌন পণ্য’ হিসেবে আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন বন্ধ করার উদ্যোগ নিতে হবে। নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে ভাবার সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে হবে।

অন্যদিকে সমাজে যেসব মিথ ও ভ্রান্ত ধারণা ধর্ষণকে প্রশ্রয় দেয়, তেমন মিথগুলোকে ভেঙে দিতে হবে। তেমন কিছু প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে: নারীর উগ্র পোশাক, চালচলন ধর্ষণকে উৎসাহিত করে, নারী ধর্ষিত হতে চায়, পুরুষেরা অধিক যৌনকাতর, তাই তারা নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ভূমিদস্যুদের মতো এই যৌনদস্যুদের মানসিকতা এই যে নারীর দেহের ওপর সে ‘অধিকারপ্রাপ্ত’ (এনটাইটেলমেন্ট); একবার শারীরিক সম্পর্ক হওয়া মানে পরবর্তী সময়েও সে অধিকার থাকবে, রাতবিরাতে নারীর একাকী চলাফেরা ধর্ষণের অন্যতম কারণ, ধর্ষিত নারীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন নেই, তাই তঁার নীরব সমর্থন ছিল ইত্যাদি। এসব ভ্রান্ত বিশ্বাস সমাজ থেকে দূর করতে হবে।

ধর্ষণ প্রতিরোধে শুধু নারীকে সতর্ক থাকতে বললে হবে না, পুরুষকেও ‘ধর্ষণ করবে না’—এই বার্তা বারবার দিতে হবে। পরিবার, সমাজে অন্যের ‘অনুমতি বা সম্মতি’ নেওয়ার সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে, পৌরুষত্বের সনাতনী ধারণায় পরিবর্তন আনতে হবে, ধর্ষণ ‘প্রাকৃতিক’ ব্যাপার—এই ভুল ধারণা ভেঙে একে ‘অপরাধ’ ও নারীর প্রতি ‘সহিংসতা’ হিসেবে দেখতে হবে, ধর্ষণ মানে ধর্ষণ, প্রেম-বন্ধুত্বের নামে একে ‘বৈধতা’ দেওয়ার চেষ্টা করা যাবে না, চোখের সামনে ধর্ষণ হচ্ছে অথচ নির্বিকার, নিষ্ক্রিয় থাকার কাপুরুষতা পরিহার করতে হবে, সামাজিক বা আইনগত হয়রানি, অসম্মানের ভয়ে ধর্ষণের ঘটনা লুকিয়ে রাখা যাবে না।

সম্ভাব্য ভিকটিমদের করণীয়

আপনি কোথাও বা কারও কাছে নিরাপদ কি না, সে ব্যাপারে নিজের অন্তর্জ্ঞান (ইনটুইশন) ও মন যা বলে সেটিকে গুরুত্ব দিন, চারদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখুন, তেমন কিছু সঙ্গে রাখুন, যা প্রয়োজনের সময় অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে কাজে লাগবে (হুইসিল, অ্যালার্ম); আত্মরক্ষার কৌশল শিখুন, রাস্তায় হাঁটার সময় নির্জন, পরিত্যক্ত এলাকা এড়িয়ে চলুন, সঙ্গে মোবাইল ফোন রাখুন, আত্মবিশ্বাসী, সাহসী মনোভাব রাখুন, মোবাইল ফোনে ‘কোড ওয়ার্ড’ রাখুন, যাতে বিপদের সময় সাংকেতিকভাবে পরিবারের লোক বা বন্ধুদের জানাতে পারেন, কেউ অনুসরণ করছে মনে করলে পাশের বাড়িতে ঢুকে পড়ুন, পার্টিতে দল বেঁধে ও বিশ্বস্ত লোক নিয়ে যাবেন, বিপদ আঁচ করলে কোনো এক অছিলায় বের হয়ে আসার চেষ্টা করুন। যদি একান্তেই আক্রমণের মুখে পড়ে যান, স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় নিজের অবস্থান পরিষ্কার করুন, এটি ধর্ষণ স্মরণ করিয়ে দিন, কোনো অজুহাত দাঁড় করান (পিরিয়ড চলছে বা যৌনবাহিত রোগ রয়েছে), অন্যদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য চিৎকার করুন, নখ দিয়ে খামচে ধরুন, চুল ধরে হ্যাঁচকা টান দিন, কামড় দিন, লাথি, ধাক্কা দিন—এভাবে কোনোরকমে নিজেকে ক্ষণিকের জন্য মুক্ত করতে পারলে দৌড়ে পালিয়ে আসুন, সরাসরি পুলিশের কাছে যাবেন, যদি ছুরি বা আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে দাঁড়ান, আপনার বাধা তাকে আরও হিংস্র করতে পারে, তাই যদি আক্রমণ করতেই চান, তা হতে হবে অপ্রত্যাশিত, হঠাৎ ও খুবই কষ্টদায়ক (বিশেষ করে তার অণ্ডকোষ, চোখের কোটর, শ্বাসনালিকে টার্গেট করতে হবে)।

সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ

ব্যক্তিকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে ঠিক, তবে ধর্ষণ প্রতিরোধে মূল দায়িত্ব নিতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রকে। আমেরিকায় সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) কেন্দ্রীয়ভাবে ‘রেপ প্রিভেনশন অ্যান্ড এডুকেশন’ (আরপিই) প্রোগ্রাম চালু করেছে। এ ধরনের প্রোগ্রাম আমাদেরও নিতে হবে, যেখানে পৃথিবীব্যাপী পরীক্ষিত ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত কার্যকর ‘প্রতিরোধ’ প্রোগ্রামগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

আইনি উদ্যোগ

রেপ শিল্ড ল অনুসরণ করতে হবে, যাতে ভিকটিমকে অনাবশ্যক প্রশ্ন না করা হয়, ব্যক্তিগত বিষয় বেশি প্রকাশ্যে আনা না হয়, তার অতীত যৌনতাকে উদাহরণ হিসেবে টানা না হয়, অধিকতর প্রমাণের বিধান রহিত করতে হবে, মেডিকেল পরীক্ষায় মানসম্মত প্রটোকল মেনে চলতে হবে, অভিজ্ঞ চিকিৎসককে দিয়ে পরীক্ষা করতে হবে, সবকিছুর ডকুমেন্ট রাখতে হবে, কোনো চাপ, দুর্নীতির যেন অবকাশ না থাকে, ধর্ষকদের পূর্ণ জীবনবৃত্তান্ত রেজিস্ট্রি করে তা সব জায়গায় সংরক্ষণ করতে হবে, ইন্টারনেটে তা প্রাপ্তির সুযোগ থাকতে হবে এবং কঠোর শাস্তির জন্য আইনি সংস্কার আনতে হবে। এ ছাড়া ন্যূনতম সাজার উল্লেখ থাকতে হবে, বিচার দ্রুত ও শাস্তি দৃশ্যমান করতে হবে।

মো. তাজুল ইসলাম: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কমিউনিটি অ্যান্ড সোশ্যাল সাইকিয়াট্রি বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল।

drtazul84@gmail.com