মতামত

যেভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের বড় শিকার নারীরা

ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের সময় জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় তলিয়ে যায় উপকূলের বিশাল এলাকা
ছবি: প্রথম আলো

দিন দিন উষ্ণ হয়ে উঠছে পৃথিবী, আর সেই সঙ্গে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে জলবায়ু নিয়ে আলোচনার মঞ্চ। মুষ্টিমেয় কেউ বলছেন, এখনই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে চিন্তিত হওয়ার মতো প্রেক্ষাপট তৈরি হয়নি, পক্ষান্তরে বেশির ভাগের মতামত হলো, জলবায়ু স্থিতিশীল রাখার লক্ষ্যে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে আমরা ইতিমধ্যে অনেক দেরি করে ফেলেছি। ১৮৮০ সাল থেকে অদ্যাবধি সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৮ ইঞ্চি। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে ২০৫০ সাল নাগাদ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে আরও প্রায় ১ ফুট। ফলে বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলোর উপকূলবর্তী অংশ পানির নিচে তলিয়ে যাবে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।

সম্প্রতি আরেকটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলে ২১০০ সাল নাগাদ সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পেতে পারে ১০ থেকে ৩০ ইঞ্চি। ইতিমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর নানা প্রান্তে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিকতা ও তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে; জলবায়ু বিশারদদের আশঙ্কা, এর পরিমাণ ভবিষ্যতে আরও বাড়তে পারে। এই চরম অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা নিরসনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নির্ধারণে পৃথিবীর সব নেতৃত্ব এখনো একমত হতে পারেনি। সম্প্রতি স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলন কিছুটা সফল হলেও প্রয়োজনীয় সমন্বিত প্রচেষ্টা এখনো অনেক দূর। তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে কি না, তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। কিন্তু  স্বল্পমেয়াদি ফল হিসেবে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, দীর্ঘমেয়াদি জলাবদ্ধতা, খরা, অতিবৃষ্টি এবং কোথাও কোথাও  অনাবৃষ্টি, সুনামিসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকোপ এবং সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।

জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিবেচনায় পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। সব প্রাকৃতিক দুর্যোগই সাময়িক অথবা দীর্ঘ সময়ের জন্য মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কষ্ট ও জীবনসংগ্রামের বিষয়ে আমরা সবাই অবগত। দুর্যোগপ্রবণ জনপদের অধিকাংশ পুরুষ সদস্য জীবন ও জীবিকার তাগিদে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের ছাড়াই শহর অথবা অন্য কোথাও ছিন্নমূল জীবন যাপন করে। এ অবস্থায় দুর্যোগকালীন জনপদে অবস্থানরত পরিবারের নারী ও শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিগ্রস্ত এবং বিপদগ্রস্ত থাকে। ১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় এবং ২০০৭ সালের সিডরে আক্রান্ত মানুষের শতকরা ৯০ ভাগ ছিল নারী ও শিশু।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মহাম্মাদ মনিরুজ্জামান খান ২০১৫ সালে এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন, ঘূর্ণিঝড় আইলা–পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলের প্রায় ৬০ ভাগ জনগোষ্ঠী অন্যত্র চলে যায়। ফেলে আসা পরিবারের এসব নারী ও শিশু চরম অনিশ্চয়তায় দিনাতিপাত করে। সেই সব পরিবারের নারীদের ১৮ ভাগ নিরাপত্তাহীনতায় জীবনযাপন করে, ৩২ ভাগ খাদ্য নিরাপত্তা ও বিকল্প জীবিকার সন্ধান করে এবং ২৩ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়। আক্রান্ত পরিবারের কিশোরীদের স্কুল ত্যাগ এবং বাল্যবিবাহ বহুল প্রচলিত এবং অতিপরিচিত পরিণতি হিসেবে আমরা জানি। দুর্যোগজনিত অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তির লক্ষে পরিবারের চাপ ও সম্মতি এবং সমাজের সহায়তায় কিশোরীদের বাল্যবিবাহ খুবই প্রচলিত একটি বিষয়।

বাল্যবিবাহ আইনত দণ্ডনীয় হলেও তা সামাজিক সচেতনতার অভাবে নারীর প্রতি সহিংসতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। দুর্যোগকালে নারীর প্রতি সহিংসতার বিচ্ছিন্ন ঘটনাগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং প্রকৃত অবস্থাসংক্রান্ত তথ্য–উপাত্ত আমাদের জানা না থাকলেও গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকেই সমস্যার বিস্তৃতি সহজেই অনুমেয়। এ ছাড়া আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা এবং নারীবান্ধব পরিবেশের অভাবে নারী এবং কিশোরীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে, যা তাদের কেন্দ্রে যেতে অননুপ্রাণিত করে, অন্যদিকে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান না গ্রহণের ফলেও তারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনালের সাতক্ষীরা এবং গাইবান্ধা জেলায় পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, প্রাকৃতিক দুর্যোগকালে শতকরা ২৫ জন নারী অতিপ্রয়োজনীয় নিরাপদ মাতৃত্বসেবা থেকে বঞ্চিত হন। গবেষণা প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর সেবাপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে নারীরা অসহায়। পরিবারসংশ্লিষ্ট এবং পরিবারের বাইরে সবাই দুর্যোগ মোকাবিলায় মনোনিবেশ করেন, কিন্তু দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অংশ হিসেবে যে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হয়, সেখানে নারী এবং কিশোরীদের অতিপ্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবাগুলো যেমন মাসিক ঋতুচক্র ব্যবস্থাপনা, ব্যক্তিগত পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, নিরাপদ মাতৃত্বজনিত সেবা এবং প্রজনন স্বাস্থ্যসেবাগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুপস্থিত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার অতিপ্রয়োজনীয় জরুরি কার্যক্রমে নারী ও কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা না করার ফলে আরও যে সমস্যাগুলো পরিলক্ষিত হয়, তা হলো কিশোরীদের ব্যক্তিগত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধার অভাব। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কিছু পদক্ষেপ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা বিচ্ছিন্ন এবং অপরিকল্পিত। সন্তান সম্ভবা নারীদের জরুরি প্রসবসেবার বিষয়টি দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ। তাই দুর্যোগকবলিত এলাকায় সরকারি-বেসরকারি সেবাদান প্রতিষ্ঠানগুলোকে আপৎকালীন সেবা প্রদানে প্রস্তুত করার কোনো বিকল্প নেই।

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, অতিবৃষ্টির প্রকোপ এবং ঝুঁকি নিয়েই ধীরে ধীরে উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে। দুর্যোগ মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতাও বিশ্বে প্রশংসনীয়। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবিকা রক্ষায় খুব সফল হলেও নারী ও কিশোরীদের আর্থসামাজিক নাজুক অবস্থা মোকাবিলায় এখনো অনেক পিছিয়ে। দুর্যোগের সঙ্গে বসবাসের ফলে আপত্কালীন জনপদের নারীরা দুর্যোগ মোকাবিলায় সহজাত পদ্ধতি অবলম্বন করেন। তাদের এই জ্ঞান ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে এবং ঝুঁকি হ্রাসকল্পে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণ ও মতামত অনস্বীকার্য। দুর্যোগকালীন এবং দুর্যোগ–পরবর্তী সময়ে নারীদের অতিপ্রয়োজনীয় প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্যে সেবা প্রদানকারী এবং সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিকল্পে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। অবলম্বন করতে হবে দুর্যোগকালীন সেবা প্রদানের বিকল্প কৌশল, যেমন ভাসমান সেবাকেন্দ্র, প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবী নিয়োগ, স্বাভাবিক সেবাকেন্দ্রের চেয়ে প্রয়োজনে খানিকটা ভিন্ন অবকাঠামোর দুর্যোগকালীন সেবা প্রদানে সক্ষম সেবাকেন্দ্র নির্মাণ ইত্যাদি। শুধু সেবাদানকারী বা প্রতিষ্ঠানই নয়, প্রজনন ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে নারী ও কিশোরীদের নিজস্ব ধারণা বিকাশেরও প্রয়োজন রয়েছে।

তথ্য-উপাত্ত ও সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এটা সহজেই অনুমেয়, আগামী দিনগুলোতে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রাদুর্ভাব আরও বৃদ্ধি পাবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে আমাদের নারী এবং কিশোরীরা আরও নাজুক অবস্থায় উপনীত হবে, যদি আমরা যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হই। দুর্যোগের সময় আমাদের সুরক্ষার লক্ষ্যে নিয়োজিত সামাজিক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর হয়ে পড়ে। অনিশ্চয়তা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে দুর্যোগকবলিত জনগোষ্ঠীর প্রয়োজন ন্যায্যতা ও অধিকার নিশ্চিতপূর্বক অতিপ্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তার। সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় নারীদের ক্ষমতায়ন ও অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং তৃণমূল পর্যায়ে নারীদের নেতৃত্বে কার্যক্রম বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি।

মো. মাহবুব-উল-আলম কান্ট্রি ডিরেক্টর, পাথফাইন্ডার ইন্টারন্যাশনাল এবং প্রকল্প পরিচালক, ইউএসএআইডি সুখী জীবন প্রকল্প