যেভাবে খাদ্যসংকট সামলাচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য

সংযুক্ত আরব আমিরাতে মরুভূমির নিচে বানানো হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলাধার
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেনে যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যের যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা অন্যদের তুলনায় মধ্যপ্রাচ্যকে বেশি চাপে ফেলেছে। লেবানন ও ইয়েমেনের মতো যেসব দেশ ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে থেকেই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অভ্যন্তরীণ সংঘাত মোকাবিলায় জেরবার হচ্ছিল, সেসব দেশে খাদ্যসংকটের প্রভাব দারুণভাবে আঘাত করেছে। ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে আমদানি করা গম এবং অন্যান্য শস্যের ওপর চরম নির্ভরশীল দেশ মিসরও এ সংকট সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। কিন্তু পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চল এবং ইসরায়েল এখন পর্যন্ত এ ঝড়কে অসাধারণভাবে মোকাবিলা করছে। এ দেশগুলোর খাদ্য নিরাপত্তার দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় ভূমিকা রাখতে পারে।

খাদ্য উৎপাদনের জন্য মধ্যপ্রাচ্য যে প্রতিকূল জায়গা, সে কথা সুবিদিত। খাদ্যনিরাপত্তা ইস্যু এ অঞ্চলে দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক অসন্তোষের উৎস হিসেবে কাজ করে। ২০১১ সালের আরব বসন্ত বিক্ষোভের প্রাথমিক কারণগুলোর মধ্যে এটি ছিল অন্যতম।

সেচের পানির অভাব ও বৈরী আবহাওয়ার কারণে প্রচলিত কৃষিপদ্ধতি ব্যবহার করে এ অঞ্চলে বড় আকারের কৃষি খামার করা কার্যত অসম্ভব। এ প্রতিকূলতা এখানকার অনেক দেশকে উল্লেখযোগ্যভাবে উদ্ভাবনী কৌশলে বিশদ আকারের কৃষি খামার করতে উদ্বুদ্ধ করেছে।

ইসরায়েলই প্রথম পানির অভাবের সমস্যা প্রশমনে প্রযুক্তি ব্যবহার শুরু করে। উন্নত সেচ কৌশল এবং সমুদ্রের পানিকে লবণমুক্ত করার (ডিস্যালাইনেট) ব্যবস্থা বিকাশের মাধ্যমে ইসরায়েলিরা স্বাদুপানিতে স্বয়ংসম্পূর্ণতা পেয়ে গেছে। এটি তাদের বড় আকারের চাষাবাদে সক্ষম করেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো উপসাগরীয় দেশগুলোকে খাদ্য ও পানি সরবরাহ সুরক্ষিত করতে একই রকম পদক্ষেপ নিতে হয়েছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাত হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডিস্যালাইনেটেড জলাধারের দেশ। দেশটির লিবা মরুভূমির একটি জলাধারে ২ হাজার ৬০০ কোটি লিটার পানি মজুত রয়েছে এবং এ জলাধার ভরতে প্রায় তিন বছর সময় লেগেছে। জরুরি প্রয়োজনে রিজার্ভটি প্রতিদিন ১ কোটি লিটার পানি সরবরাহ করতে পারে। আবুধাবি প্রতিদিন ৪১ লাখ ৩০ হাজার ঘনমিটার লবণমুক্ত পানি উৎপাদন করে।

বৈশ্বিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য উপসাগরীয় অঞ্চল জোর পদক্ষেপ নেয়। জ্বালানির দাম কমে যাওয়া এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উপসাগরীয় সরকারগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে তারা আফ্রিকায় অনেক জমি কিনেছে।

কৃষি এবং খাদ্য সরবরাহব্যবস্থা সুরক্ষিত করতে সৌদি আরবের নেতৃত্বে উপসাগরীয় দেশগুলো খাদ্য উৎপাদনের জন্য বিশ্বব্যাপী বিপুল পরিমাণ জমি কিনেছে। মিসর যেমন ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে খাদ্য আমদানি করায় তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, ধনী উপসাগরীয় দেশগুলো তেমন করে পরের ওপর নির্ভরশীল হয়নি। এ দেশগুলো অন্যান্য দেশে জমি কিনেছে এবং তারা তাদের ভৌগোলিক সীমানার বাইরে গিয়ে খাদ্য উৎপাদন করছে।

বৈশ্বিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য এই অঞ্চল জোর পদক্ষেপ নেয়। জ্বালানির দাম কমে যাওয়া এবং আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উপসাগরীয় সরকারগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে যেতে বাধ্য হয়। এর ফলে তারা আফ্রিকায় অনেক জমি কিনেছে। ২০১৫ সালে একটি উচ্চাভিলাষী চুক্তির আওতায় আবুধাবিভিত্তিক আল দাহরা অ্যাগ্রিকালচারাল কোম্পানি সুদানের উর্বর আল হাওয়াদ উপত্যকায় এক হাজার কোটি ডলারের কৃষি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এর অংশ হিসেবে প্রথম পর্যায়ে সেখানে তারা এক শ কোটি ডলার বিনিয়োগ করছে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো কিছু উপসাগরীয় দেশ পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে কৃষিপ্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে। দুবাইয়ে ‘ফুডটেক ভ্যালি’ নামের নতুন যে কৃষি প্রকল্প চালু হয়েছে, তা পুরো মাত্রায় উৎপাদন শুরু করলে দেশটির খাদ্য উৎপাদন বর্তমানের চেয়ে তিন গুণ বেশি হবে। আমরা যদি ভালো করে তাকাই, তাহলে উপসাগরীয় অঞ্চল কীভাবে তার খাদ্যসংকট মোকাবিলা করেছে তা এবং তা থেকে এখানকার ভবিষ্যৎ কৃষির কিছু আলামত দেখতে পাব।

বোঝা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তন আরও অনেক দেশকে খাদ্য উৎপাদনের জন্য তাদের সীমানার বাইরে জমি খুঁজতে বাধ্য করবে। যুক্তরাষ্ট্রে যথেষ্ট পরিমাণ আবাদযোগ্য জমি থাকা সত্ত্বেও দেশটির খাদ্য সরবরাহের একটি বড় অংশ আসে মেক্সিকো থেকে, কারণ মেক্সিকোতে ফসল চাষ করা সহজ। কিন্তু এ সমাধান দুই পাশে ধারওয়ালা তলোয়ারের মতো।

গত বছর, যখন যুক্তরাষ্ট্র মেক্সিকো থেকে অ্যাভোকাডো ফল আমদানি নিষিদ্ধ করেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাভোকাডোর দাম ২৪ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উচ্চতায় গিয়েছিল, কারণ যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাভোকাডোর চাহিদার ৮০ শতাংশ মেক্সিকো থেকে আসে। যদিও খাদ্যের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশে জমি কেনা খাদ্য নিরাপত্তার ভবিষ্যৎ হতে পারে, তবে এটি সম্ভবত বিশ্বের কিছু অংশে ভূরাজনৈতিক সমস্যাকে উসকে দেবে। উত্তেজনা তৈরি হতে বাধ্য কারণ ধনী দেশগুলো উন্নয়নশীল দেশগুলোর সেই সব জমি কিনছে, যেসব জমিতে স্থানীয় মানুষ আগে থেকেই চাষাবাদ করত।

ধনী দেশ এবং কোম্পানিগুলো কঙ্গোর খনিজ সম্পদ আহরণ করে কোটি কোটি ডলার আয় করলেও কঙ্গো কীভাবে অনুন্নত থাকে তা বিবেচনা করুন। আজ বিদেশি কোম্পানিগুলো কঙ্গো থেকে কোবাল্ট এবং লিথিয়াম তুলছে। কাল সেখানে তারা খাদ্য উৎপাদন করবে। উপসাগরীয় অঞ্চল দেখিয়েছে, খাদ্য আবাদের মডেল একটি ছোট কিন্তু ধনী সমাজের জন্য খাদ্যনিরাপত্তা মোকাবিলায় কাজ করতে পারে। কিন্তু আমাদের বিবেচনা করা দরকার যখন অনুশীলনটি বড় আকারে সঞ্চালিত হবে, তখন এর প্রভাব কী হবে।

ইউক্রেন সংকট খাদ্যসংকটের পূর্বসূরি হিসেবে কাজ করছে, যা বিশ্ব অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলবে। যেহেতু উপসাগরীয় দেশগুলো তাদের কৃষিপ্রযুক্তি খাতভিত্তিক অর্থনীতি তৈরি করে চলেছে, অন্যান্য দেশের জন্যও তাদের খাদ্য চাষের অভিজ্ঞতা শেয়ার করার সুযোগ রয়েছে। আগামী বছরগুলোতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের খাদ্যনিরাপত্তার এ নতুন পর্যায়ের জন্য নতুন নির্দেশিকা প্রয়োজন। মধ্যপ্রাচ্য সেই নির্দেশিকা রচনায় অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

  • জোসেফ ডানা প্রযুক্তি এবং সমাজে এর প্রভাব–সম্পর্কিত সাপ্তাহিক নিউজলেটার এক্সপোনেনশিয়াল ভিউ-এর সাবেক জ্যেষ্ঠ সম্পাদক