মতামত

যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে

মিজানুর রহমান খান, অরুণ বসু ও আবুল কালাম আজাদ (বাঁ থেকে ডানে)
মিজানুর রহমান খান, অরুণ বসু ও আবুল কালাম আজাদ (বাঁ থেকে ডানে)

সবশেষে হারালাম অরুণদাকে। প্রথমা প্রকাশনার সমন্বয়ক অরুণ বসু। তার আগে সম্পাদনা সহকারী আবুল কালাম আজাদ আর বছরের শুরুতে যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান, আমাদের মিজান ভাই। প্রথম আলো পরিবারের আমার তিন সহকর্মী। গত বছর প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতেও ছিলেন, কিন্তু এ বছর নেই। করোনা আর ডেঙ্গুর আঘাতে শেষ। তাঁদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাই কি শেষ কথা? বরং এই তিন সহকর্মীর কাছ থেকে শিখতে চাই যা—

লেখাটা যেন ছ্যাঁৎ করে ওঠে
অরুণদা সর্বশেষ প্রথমা প্রকাশনার সমন্বয়ক ছিলেন বটে, তবে তিনি কাজ করেছেন প্রথম আলোর নানান বিভাগে। বার্তা থেকে ফিচার। একসময় ফিচার পাতাগুলো ছাপা হওয়ার আগে পড়ে পরামর্শ দিতেন। তেমনি একদিন একটা পাতা হাতে কারও একটা লেখা পড়তে পড়তে উঠে এলেন (দীর্ঘাঙ্গি মানুষ; বড় বড় কদমে হাঁটতেন, জোরে জোরে শব্দ করে কথা বলতেন।) বললেন, ‘বুঝলেন আপা, মাছে হলুদ–লবণ মাখিয়েছেন, কড়াইয়ে তেলও দিয়েছেন, কিন্তু মাছটা ছ্যাঁৎ করে না উঠলে ভাজা মাছটার স্বাদ যেমন হবে, এই লেখাটা তেমনি, সব উপাদান আছে কিন্তু কী যেন নেই!’ অরুণদা, প্রতিদিন অসংখ্য লেখা পড়তে পড়তে যে লেখা ছ্যাঁৎ করে উঠবে, সেদিন ঠিক আপনার কথা মনে হবে। আপনার এই উপমা লেখায় আর সম্পাদনায় শিখতে চাই।

এমন চেয়ারে বোসো না…
প্রথম আলো কার্যালয়ে বোর্ডরুমে মিটিং। একে একে সবাই আসছেন। অরুণদা এসে পেছনে বসলেন। আমরা সবাই বললাম, ‘অরুণদা, সামনে আসেন, চেয়ার ফাঁকা আছে।’ অরুণদা বললেন, ‘আমার ঠাকুমা শিখিয়েছেন, “এমন কাজ কোরো না কেউ বলে ছোট, এমন চেয়ারে বোসো না, কেউ বলে ওঠো।”’ তাঁর বলার ধরনে আমরা সবাই একসঙ্গে হেসে উঠেছিলাম বটে, কিন্তু কথাটা মনের মধ্যে গেঁথে আছে। সারা জীবন এই কথা মেনে চলা বড় কঠিন কাজ, তবে চেষ্টা করতে দোষ কী?

২৪ ঘণ্টার সাংবাদিক
মিজানুর রহমান, আমাদের মিজান ভাইকে নিয়ে বলার অসংখ্য ঘটনা আছে। কিন্তু আইনবিষয়ক এক সিরিয়াস সাংবাদিক মিজান ভাই একবার দেশের বাইরে যাচ্ছিলেন কোনো কাজে, বিমানবন্দরে আলাপ হলো এ দেশের এক জনপ্রিয় অভিনেত্রীর সঙ্গে। সেদিনই প্রথম পরিচয়। সেখানে বসেই সাক্ষাৎকার নিয়ে আমাদের লিখে দিয়েছিলেন।
আর অফিস থেকে বাড়িতে ফেরার পথে দুই বাসের চাপায় হাত চলে যাওয়া হতভাগ্য তরুণ রাজীবের সেই আলোচিত ছবি মুঠোফোনে তুলে তিনি তো সেবার সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন। পরদিন সেই ছবি প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ছাপা হওয়ার পর নিচের ক্যাপশনে মিজানুর রহমানের নাম দেখে আমরা বিস্মিত হয়েছি। সে বছর সব আলোকচিত্রীকে হারিয়ে তিনি প্রথম আলোর বর্ষসেরা আলোকচিত্রের পুরস্কার জিতে নিয়েছিলেন।

মিজান ভাই, এখন বারবার শুনি, এই নতুন স্বাভাবিক জীবনে সাংবাদিকতা করতে হলে কর্মক্ষেত্রে তাঁকে হতে হবে বহুমুখী। তরুণদের কাছ থেকে সেটাই চাওয়া। অথচ কেউ আপনাকে কিছু বলেনি, বলতে হয়নি, ভেতর থেকেই আপনি ছিলেন ২৪ ঘণ্টার ‘মাল্টিটাস্কার সাংবাদিক’! আপনার মতো ‘তরুণের’ সঙ্গে আর কি হে হবে দেখা?

অল্পতে খুশি যেজন
সম্পাদনা সহকারী আবুল কালাম আজাদ বসতেন আমার ফ্লোরেই। তাই রোজ দেখা হতো। হাসিখুশি এক মানুষ। রোজ সন্ধ্যায় সম্পাদনা সহকারী বিভাগের কর্মীরা একসঙ্গে নাশতা করার উদ্যোগ নিতেন। হয়তো চানাচুর–মুড়িমাখা, নয়তো কাসুন্দি দিয়ে পেয়ারামাখা, আমের মৌসুমে কারও বাড়ি থেকে আসা আম কেটে খাওয়া। দৈনিক সংবাদপত্রে সন্ধ্যা মানেই পিক আওয়ার। ঘাড় ঘোরানোর সময় নেই। তার ওপর এখন তো ২৪ ঘণ্টার অনলাইন আছেই। কিন্তু অল্প সময়ের জন্য হলেও আবুল কালাম আজাদ বিপ্লবকে দেখতাম, হাসি হাসি মুখ করে ক্ষণিকের আনন্দে মেতে উঠতেন। কাগজের চোঙা বানিয়ে নিজেদের বিভাগের বাইরেও একে–তাকে ডেকে ডেকে মুড়ি খাওয়াতেন। অবধারিতভাবে একটা প্লেট তিনি আমাকে ঠিক দিয়ে যেতেন। আমি বলতাম, এতটা? বিপ্লব ভাইয়ের হাসি, ‘সবাইকে নিয়ে খাবেন।’

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া এই সহকর্মীর অন্য সহকর্মীরা জানতেন, কোনো কাজে ‘না’ ছিল না তাঁর। জানতেন অল্পতেই খুশি হতে। অনলাইন সংবাদব্যবস্থা চালু হওয়ার পর ঈদের ছুটিতেও প্রথম আলোর কোনো কোনো কর্মীকে কাজ করতে হয়। আবুল কালাম আজাদ স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসতেন। ঈদের নামাজ পড়ে নতুন পাঞ্জাবি গায়ে অফিসে এসে দায়িত্ব পালন করেছেন। হাসিমুখে ঈদের দিন ছবি তুলেছেন। সহকর্মীরা ঈদের ছুটিতে গেছেন, কাউকে না কাউকে তো আসতেই হবে। তাই হাসিমুখে উপস্থিত হতেন আবুল কালাম আজাদ। এ কি কম কথা?

প্রতিদিন দেখা হতো বলে সহকর্মীদের এই অসাধারণ গুণগুলো নিজের ভাবনায় আলাদা করে স্থান হয়তো দেওয়া হয়নি। আজ তাঁরা পৃথিবীতে নেই, তাই হয়তো বড় বেশি করে মনে বাজছে তাঁদের কথা। সে আর নতুন কী? কবি হাসান হাফিজুর রহমান তো সেই কবেই লিখে গেছেন, ‘তোমাদের হিসেবি খাতায় বীর নেই, শহীদ রয়েছে শুধু।’ আমি নিশ্চিত, অরুণদা এই লেখা পড়ে বড় বড় কদমে এগিয়ে এসে উচ্চ স্বরে বলতেন, ‘লেখাটা পড়েছি, আপা। সবই ছিল কিন্তু ছ্যাঁৎ করে উঠল না।’

সুমনা শারমীন প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক।