করোনা–পরবর্তী অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে বাংলাদেশের মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা বিভিন্ন মাধ্যমে নিয়মিত আলোচনা করছেন। অনেকেই একমত হবেন যে এই আলোচনাগুলো বাংলাদেশের মূলধারার অর্থনীতিবিদদের মনস্তত্ত্ব বোঝার জন্য জরুরি। যেমন অর্থনীতির কাঠামোগত সমস্যাগুলোর গভীরে না গিয়ে ওপরে ওপরে সংখ্যা নিয়ে বাড়াবাড়ি করা মূলধারার অর্থনৈতিক চিন্তার একটা পুরোনো সমস্যা।
করোনাকালীন অর্থনীতির আলাপে তার ব্যতিক্রম দেখিনি। অর্থনীতি ‘ভি শেপ’ হবে, না ‘ইউ শেপ’ হবে, এ নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই। খেয়াল করলাম লকডাউনের অকার্যকারিতা নিয়ে আলাপ চলছে, অথচ লকডাউন কার্যকর না হওয়ার পেছনের মূল কারণটি যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অর্থনৈতিক অসক্ষমতা, সেই বিশ্লেষণে যাচ্ছেন না কেউ। এই দেশের ৮৬ ভাগ শ্রমজীবী মানুষই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সঙ্গে জড়িত। লিখিত কন্ট্রাক্ট নেই, মাসিক বেতন নেই এবং সবচেয়ে বড় কথা, একটা সপ্তাহ বাড়িতে বসে থাকার মতো সঞ্চয় নেই! কোনো অর্থনীতিবিদকে প্রশ্ন করতে শুনেছেন, বার্ষিক ১ হাজার ৯০০ ডলার (প্রায় দেড় লাখ টাকা) মাথাপিছু আয়ের দেশে মাত্র কয়েক সপ্তাহের খাদ্য মজুত করার সক্ষমতা হলো না কেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের? ৮ পার্সেন্ট জিডিপির দেশে সাড়ে ৭ কোটি অ্যাকাউন্টে সঞ্চয় গড়ে মাত্র ৬২৫ টাকা কেন? ১৭ লাখ টন চালের মজুত থাকা সত্ত্বেও কাজ হারানো প্রান্তিক মানুষের ঘরে ঘরে এই খাদ্য পৌঁছে দেওয়া হলো না কেন? একটা গোটা দশকের উচ্চ প্রবৃদ্ধির পরও লকডাউনে নগ্ন হয়ে পড়া ভয়াবহ বৈষম্য অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় স্থান পেল না কেন? বৈষম্য কি অর্থনীতির বিষয় নয়? তাঁরা বৈষম্য বোঝেন না, সঞ্চয়হীনতা বোঝেন না, মুটে, মজুর, রিকশাচালক, ফেরিওয়ালাদের লকডাউন ভাঙার কারণ বোঝেন না, ক্ষুধা বোঝেন না, ভ্যানে চড়ে গাদাগাদি করে মানুষ কেন গ্রামে ফেরে তার অর্থনৈতিক কারণটাও ধরতে পারেন না; তাঁরা বোঝেন খালি অর্ডার বাতিল আর ইউভিডব্লিউ? স্বাস্থ্য খাতের ভয়াবহ জীর্ণদশা চোখের সামনে উদোম হয়ে না পড়লে স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে বর্তমানে অর্থনীতিবিদের যে দরদি বিশ্লেষণ, সেটাও দেখতেন কি না সন্দেহ। কই, এত দিন তো দেখিনি!
আলোচনায় কৃষি নেই কেন
অদ্ভুত হলেও সত্যি, বড় অর্থনীতিবিদদের দুর্যোগকালীন আলোচনাগুলোতে কৃষি নিয়ে প্রায় কোনোই আলাপ নেই। একটি আলোচনার শেষের দিকে একজন অর্থনীতিবিদকে শুধু বলতে শুনেছিলাম, ‘আমাদের কিন্তু রুরাল ইকোনমিটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ, দুর্যোগ হোক আর যা–ই হোক, প্ল্যান্ট উইল অলওয়েজ গ্রৌ’। মানে কী? মানে হলো ফসল এমনি এমনিই ফলে? যেন প্রতি মৌসুমে ধারকর্জ করে বাজার থেকে অতিরিক্ত দামে বীজ কিনতে হয় না কৃষককে। যেন এই ফসল ফলানোর পিছে বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া সার–বীজ–সেচের লাগামছাড়া খরচ নেই। যেন ফড়িয়া, সিন্ডিকেট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, কৃষি উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি, বছর বছর লস, এত সবকিছুর পরও বারবার কৃষিতে রক্ত নিংড়ানো বিনিয়োগের পেছনে কৃষকের কোনো রূঢ় আর্থসামাজিক বাস্তবতা নেই। যেন এ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক যে আবাদি জমির মালিক নয়, এর পেছনে ভূমি সংস্কার প্রক্রিয়ার ঐতিহাসিক ব্যর্থতা নেই। কারণ, ফসল তো এমনি এমনি ফলে (হীরক রাজার দেশে সিনেমাটির শেষ দৃশ্যের মতো আকাশ থেকে মন্ডার মতো সার, বীজ, সেচের পানি জায়গামতো পড়তে থাকে আর ফসল ফলে যায়)।
খেয়াল করুন, করোনাকালীন অর্থনীতির আলোচনায় কৃষির জন্য বরাদ্দ মাত্র এক–আধ মিনিট সময় কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। আশির দশকে বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদেরা জোরজবরদস্তি করে এশিয়া–আফ্রিকার দেশগুলোর কৃষি থেকে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ সরিয়েছিলেন। একসময়ের খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশগুলো কৃষিজমিতে কোকো, রাবার, তুলার মতো অর্থকরী ফসল ফলাতে গিয়ে বারবার তীব্র খাদ্যসংকটে পড়েছে। উন্নয়নশীল দেশের রপ্তানি পণ্যের কারখানাগুলোতে সস্তা শ্রমিকের সরবরাহ চালু রাখতে ইচ্ছা করেই ফসলের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করা হয় না এমন অভিযোগও আছে। সেই ধারাবাহিকতায় আমরা দেখি বছরের পর বছর কৃষকের ধান–পাটের দাম না পাওয়া নিয়ে দেশের অর্থনীতিবিদদের কোনো অভিযোগ নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরেও রাষ্ট্রের ধান–চাল মজুত করার সক্ষমতা কেন তৈরি হয় না, সেই অভিযোগও নেই। দুর্যোগকালীন ৭২ হাজার কোটি টাকার বিশাল রাষ্ট্রীয় প্রণোদনায় কৃষির নামগন্ধ নেই কেন, সেই প্রশ্নও নেই। পরে ঘোষিত ৫ হাজার কোটি টাকাও বরাদ্দ করা হয়েছে ৪ পার্সেন্ট সুদে, শুধু ‘জমির মালিক’ এবং কৃষিপণ্যের ক্রেতা কোম্পানিকে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষক (বর্গাচাষি) বাদ। এবং সেই বিশ্লেষণটিও বাদ।
দেশের স্বনামধন্য কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বিভিন্ন ইংরেজি দৈনিকে করোনাকালীন অর্থনীতি নিয়ে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। সেখানে তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কৃষি নিয়ে পেলাম না একটি শব্দও! অথচ কে না জানে, এই মহাদুর্যোগের দিনে মাঠভরা বাম্পার ফলন এবং ধারকর্জ করে কৃষকের ফসল ফলানোর চেষ্টাই আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে আসন্ন দুর্ভিক্ষ থেকে। দুর্যোগের মধ্যেও বোরো ফসলটা ঠিকঠাকমতো ঘরে তুলতে হবে—এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও বিস্তর আশঙ্কা দেখেছি, কিন্তু এটা যে বোরোর মৌসুম ছিল, উত্তরবঙ্গে যে ক্ষেতমজুর–সংকট চলছিল এবং আগাম বন্যার আগেই ফসল তোলার তড়িঘড়ি ছিল (নইলে দুর্ভিক্ষ আসন্ন), এসব জীবন-মরণ তথ্য আমাদের ‘হাইপ্রোফাইল’ অর্থনীতিবিদদের আলোচনায় জায়গা করে নিতে পারেনি। তো আলোচনায় কৃষক যেমন নেই, তেমনি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের (ইনফরমাল খাত) কাজ হারানো কয়েক কোটি শ্রমিক নিয়েও কোনো দিকনির্দেশনা নেই!
অবহেলিত অপ্রাতিষ্ঠানিক (ইনফরমাল) খাত
বাংলাদেশের ইনফরমাল খাতটি কি বিপুলা এক পৃথিবী! শুধু ঢাকা শহরেই হকার ও ফেরিওয়ালার সংখ্যা তিন লাখের বেশি। দরজির সংখ্যা কয়েক লাখ। রিকশাচালকের সংখ্যা প্রায় ১০ লাখ। উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে লবণশিল্পের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন কয়েক লাখ শ্রমিক। কুয়াকাটা ও কক্সবাজার মিলিয়ে এক লাখের বেশি জেলে ও শ্রমিক জড়িয়ে আছেন শুঁটকিশিল্পের সঙ্গে। সারা দেশে পরিবহনশ্রমিকের সংখ্যা ৬০ থেকে ৭০ লাখ। যাত্রীকল্যাণ সমিতির মতে, তাঁদের মধ্যে ৪৪ লাখ পরিবহনকর্মীই অবৈধ। শুধু বাসের হেলপার বা ড্রাইভার নয়, আছে নছিমন-করিমন, ইজিবাইক, লেগুনাসহ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার চালক। তো অবৈধ বললেই হয়ে গেল? ৪৪ লাখ ‘অবৈধ’ পরিবহনকর্মী এবং স্থানীয় প্রযুক্তিতে তৈরি হওয়া লক্ষাধিক স্থানীয় বাহন নিয়মিত রাস্তায় আছে। এর মানে হলো এই চালক এবং এই বাহনগুলোর বিপুল চাহিদা আছে রাস্তায়। রাষ্ট্র গণপরিহবন নামিয়ে স্থানীয় জনগণের জীবনযাত্রার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই চাহিদা পূরণ করতে পেরেছে? পারেনি। অথচ কাজ হারানো এই বিশাল সংখ্যক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকদের সুরক্ষা নিয়ে কোনো পরিকল্পনা বা কোনো নির্দেশনা অর্থনীতির আলোচনায় ঠাঁই পায় না কেন?
ঢাকা শহরে ‘ঠিকা বুয়া’র সংখ্যা কত? পাঁচ লাখের বেশি তো হবেই। কোভিডের সময় বোঝা গেল তো বুয়াদের এই সার্ভিস মধ্যবিত্তের জীবনে ঠিক কতটা অপরিহার্য? তাহলে বলুন, পাঁচ লাখ মানুষের এই ইন্ডাস্ট্রি চাহিদা-জোগানের নিয়ম অনুসারেই একটি গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস-ইন্ডাস্ট্রি নয় কেন? ‘অনলাইন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান’ খুলে ‘মেইড’ সরবরাহ করলে শুধু সেটাই কর্মসংস্থান? এই যে লাখে লাখে কর্মঠ নারী কাজ হারিয়েছেন, এই নারীদের জন্য পাঁচ লাখ বিকল্প চাকরি তৈরি করতে পেরেছে রাষ্ট্র? আছে কোনো পরিকল্পনা? তাহলে ঠিকা বুয়াদের ক্ষতিপূরণ, কাজের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা, ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ বা আবাসন সমস্যা নিয়ে কথা বলবেন না কেন মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা? নাকি এগুলো ‘ইকোনমিস্ট’দের মানায় না!
শিক্ষিত গ্র্যাজুয়েট ‘ফুড অ্যাপ’ বানিয়ে হোম ডেলিভারির ব্যবসা করলে সেটা কর্মসংস্থান আর আজীবন ঘরের দরজায় এসে ব্রয়লার মুরগি বা দেশি মুরগির ডিমটা পৌঁছে দেওয়া ফেরিওয়ালার কর্মসংস্থানটা অর্থনীতির বিষয়বস্তু নয়? ডিম, দুধ, সবজি, আদা, রসুন, মৌসুমি ফল, নদীর মাছ, এমনকি মাছ কাটার ছাইটা পর্যন্ত বাড়ির গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেওয়া আবহমানকালের এই সার্ভিস ইন্ডাস্ট্রির কর্মীরা এলাকার ‘সাপ্লাই-ডিমান্ড’–এর চক্রটা অর্থনীতিবিদদের চেয়ে কম বোঝেন? হাজার কিলোয়াট বিদ্যুৎ খরচ করে সুপারমল বানিয়ে বিদেশি পণ্য বিক্রি করলে সেটা কর্মসংস্থান, অথচ এক ওয়াট বাড়তি বিদ্যুৎ খরচ না করে ফুটপাতে নিত্যদিনের চাহিদার জোগান দিয়ে যাওয়া পরিবেশবান্ধব এই বিশাল কর্মী বাহিনীর কর্মসংস্থান এবং তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তার আলাপ অর্থনীতির কম গুরুত্বপূর্ণ আলাপ?
স্থানীয় শিল্পের বিকাশ
স্থানীয় কর্মসংস্থান এবং স্থানীয় শিল্পের বিকাশের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে গণমানুষের ক্রয়ক্ষমতা। যেমন বাংলাদেশের পাটকলগুলো সচল থাকা মানে তো শুধু পাটপণ্যের বিকাশ নয়। শখানেক পাটকল ঠিকঠাকমতো চললে গোটা এলাকার অর্থনীতিটাই পাল্টে যায়। পাটকলের শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এলাকার ভাতের হোটেল, কাপড়ের বাজার, ছাপা লুঙ্গির ফ্যাক্টরি, বাচ্চাদের খেলনা, সস্তা কাঠের ফার্নিচার থেকে শুরু করে দেশীয় বিস্কুট, চানাচুর, চিপস, বা কোক–পেপসির ছোট বড় অসংখ্য দোকানের ভবিষ্যৎ। অথচ সারা দেশের অর্ধশত পাটকল এখন পর্যন্ত বন্ধ হয়ে আছে। বিশ্বব্যাংকের প্ররোচনায় ধসে গেছে খুলনার শিল্প এলাকা। পুরোনো শিল্পাঞ্চলগুলোতে গেলে চোখে পড়ে সারি বাধা শয়ে শয়ে তালাবন্ধ দোকান। অথচ ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের মজুরি বাড়লে, পাটশ্রমিক তার হারানো সুদিন ফিরে পেলে, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, ছাপাখানার শ্রমিক সরকারি রেশন পেলে দেশীয় বাজারে ডিম, দুধ, মাছ, মুরগির মতো পুষ্টিকর খ্যাদ্যের কেনাকাটা বাড়ত। চাহিদা বাড়ত দেশি জুতা, দেশি কসমেটিকস, দেশি ছাপা শাড়ি-গামছা, দেশি দই–মিষ্টিসহ শত রকমের দেশীয় পণ্য ও সার্ভিসের। স্থানীয় শিল্পের দুর্দান্ত বিকাশের এখানেই কত যে সুযোগ।
স্থানীয় মানুষের নিত্যদিনের বহুমুখী চাহিদার ওপর নির্ভর করে চাহিদা-জোগানের যে অসাধারণ সাইকেলটি তৈরি হয়, অর্থনীতির ভাষায় তার চমৎকার একটি নামও আছে, ‘ডমেস্টিক ডিমান্ড ড্রিভেন গ্রোথ’ বা স্থানীয় চাহিদানির্ভর প্রবৃদ্ধি। যদিও বলা হয়, পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পুরোটাই হয়েছে রপ্তানিভিত্তিক বাণিজ্যের কারণে, কিন্তু বাস্তবতা হলো আশি–নব্বইয়ের দশকে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি ছিল স্থানীয় চাহিদা এবং স্থানীয় শিল্পায়ন। বিশেষ করে বৈশ্বিক মন্দা–পরবর্তী সময়ে এশিয়ার রপ্তানি বাজারে ধস নামলেও স্থানীয় চাহিদা এবং স্থানীয় শিল্পের বিকাশের কারণেই মালয়েশিয়া বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর অর্থনীতি ক্রমাগতই সমৃদ্ধ হতে থাকে [হা জু চান (১৯৯৩, ২০১০) এবং লাই ওয়াহ (২০১০)–এর কাজে স্থানীয় চাহিদা এবং স্থানীয় শিল্পায়নে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের বিষয়টি বারবার সামনে এসেছে।]
একবারে ছোট থেকে ধুঁকে ধুঁকে উঠে দাঁড়িয়েছে আমাদের পোলট্রিশিল্প। পোশাকশিল্পের মতো বছর বছর ভর্তুকি পায়নি। একসময় বিদেশ থেকে আমদানি করলেও এখন পোলট্রি ফিড (ভুট্টা ও রাইস ব্র্যান) আর ভ্যাকসিনের একটা বড় অংশই দেশের বাজারেই তৈরি হয়। আগে–পিছে সব মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এই খাতে। সারা দেশে প্রায় ৪ লাখের মতো ডেইরি খামারও আছে। এদিকে সারা দেশে দুধ উৎপাদনে ঘাটতি আছে প্রায় ৫৬ লাখ মেট্রিক টন। ডিমের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় ২০০ কোটি পিস কম। অর্থাৎ বিপুলসংখ্যক মানুষের দেহে প্রোটিনের ঘাটতি আছে। অথচ করোনাকালে মারাত্মক লোকসানের মুখে পড়েছেন না–জানি কত ছোট–বড় খামারি। পোশাকশিল্পের চেয়েও বেশি মানুষের টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি করা এই দুটি শিল্পের ক্ষতিপূরণ নিয়ে, বিকাশ নিয়ে, সম্ভাবনা নিয়ে কোনো অর্থনীতিবিদকে বলতে শুনবেন না কখনোই। তাঁরা বিজিএমইএর কান্না শুনতে পান ঠিকই, অথচ পোলট্রি ব্যবসায়ীদের কান্না শুনতে পান না! পোলট্রি ব্যবসায়ীদের সংগঠন থেকে বারবারই বলা হয়েছে, কিছুটা রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পেলে আরও ৩০ লাখ মানুষের নতুন কর্মসংস্থান হতে পারে শুধু পোলট্রি খাতেই। এই ভঙ্গুর শিক্ষাব্যবস্থায় প্রোগ্রামিং শিখিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ঘটিয়ে ৩০ লাখ তো দূরে থাকে, তিন লাখ টেকসই কর্মসংস্থান তৈরি করে দেখান তো দেখি!
প্রাতিষ্ঠানিক খাতের দুর্দশা ও পোশাকশিল্পের ভবিষ্যৎ
খেয়াল করুন, পোশাকশিল্প নিয়ে অর্থনীতিবিদদের হা–হুতাশের প্রায় সম্পূর্ণটাই বৈদেশিক মুদ্রা এবং কারখানা সচল রাখার সঙ্গে সম্পর্কিত। তাঁদের দুশ্চিন্তার সঙ্গে মার্চ মাসের বেতন না পাওয়া শ্রমিক, হেঁটে হেঁটে ঢাকায় ফেরা শ্রমিক এবং সাভার, আশুলিয়া বা টঙ্গীতে ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের কোনোই সম্পর্ক নেই। অথচ এখনই সুযোগ ছিল পোশাকশিল্পের ওপর আমাদের একচেটিয়া নির্ভরশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তোলার। প্রথমত, তথাকথিত ‘ফাস্ট ফ্যাশনে’র উৎপাদনব্যবস্থা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ক্ষতিকর বর্জ্যের পাহাড় তৈরি করছে। বলা হচ্ছে ফ্যাশন ব্র্যান্ডগুলো অতিরিক্ত মুনাফার লোভে তৈরি করেছে এই কৃত্রিম চাহিদা। সস্তা ফ্যাশনের এই ফাঁদে পড়ে চাহিদার তুলনায় বহুগুণ বেশি কাপড় কিনছেন পশ্চিমা ক্রেতারা। এবং এই কৃত্রিম চাহিদার ওপর ভিত্তি করেই তৈরি হচ্ছে একের পর এক গরিব দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল খাত। এদিকে গত কয়েক বছরে স্বয়ংক্রিয় মেশিন আমদানির ফলে ঢালাও অটোমোশনের প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। গত বছর এ দেশে প্রায় ৩০ হাজার পোশাকশ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে এবং সস্তা শ্রমের অসুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগে কোম্পানিগুলো এক দেশ থেকে আরেক দেশে অর্ডার সরিয়ে নিচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের রাষ্ট্রীয় নীতি কী হবে, নতুন ধরনের কর্মসংস্থান কীভাবে তৈরি হবে, অর্থনীতির বৈচিত্রকরণটা কোন উপায়ে হবে, স্থানীয় শিল্পের বিকাশে রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপগুলো কী কী হবে, এসব আলোচনার এখনই ছিল উপযুক্ত সময়।
প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতগুলো নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা আন্তরিক হলে পোশাকশিল্পের মতো একটি প্রাতিষ্ঠানিক খাতের যে ক্রমাগত ‘অপ্রাতিষ্ঠানিকীকরণ’ বা ‘ইনফরমালাইজেশন’ হচ্ছে সেই আলাপ নেই কেন? এসব তথাকথিত প্রাতিষ্ঠানিক বা ফরমাল কর্মসংস্থানে না আছে চাকরির গ্যারান্টি, না আছে বাঁচার মতো মজুরি, না আছে ভবিষ্যতের পেনশন, না আছে চিকিৎসাসেবা। একটা ৪০ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি অথচ হকার ফেরিওয়ালার মতোই অরক্ষিত কর্মসংস্থান। আমাদের অর্থনীতিবিদেরা জানেন খালি ‘সমস্ত ইনফরমাল খাতকে ধীরে ধীরে ফরমাল বানাও’। সেটা কী করে সম্ভব? পোশাক খাত ইতিমধ্যেই সংকুচিত হচ্ছে, ব্যাপক অটোমেশনের কারণে ভারী শিল্পে হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে আসছে এবং শুধু বিদেশি চাহিদার ওপর ভিত্তি করে রপ্তানিমুখী শিল্পে ‘ফোকাস’ করার ঝুঁকিগুলোও স্পষ্ট। গত ৫০ বছরে ইনফরমাল খাতের কয়েক কোটি শ্রমিকের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি, ৭-৮ পার্সেন্ট জিডিপির একটা গোটা দশক পার হয়ে গেল, কর্মসংস্থান তৈরি হলো না। অথচ এখনো আমরা স্বপ্ন দেখি পাঁচ কোটি শ্রমজীবী মানুষের জন্য ভালো ভালো বেতনওয়ালা নতুন নতুন চাকরি তৈরি হবে? আছে কোনো পরিকল্পনা সরকারের? অর্থনীতিবিদদের? তা ছাড়া সেই প্রাতিষ্ঠানিক খাতের চাকরিগুলো কেমন হবে? এখনকারগুলোর মতো? অরক্ষিত, অনির্ভরযোগ্য, অল্প মজুরির, অপুষ্টির? ১০ ঘণ্টা বাথরুম চেপে রাখতে হয়? আজকে আছে কালকে নেই টাইপের? তাহলে আমাদের নিজেদের শ্রমে ঘামে গড়ে ওঠা ইনফরমাল খাত কী দোষ করল?
অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের সম্ভাবনা
মূলধারার অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অপ্রাতিষ্ঠানিক বা ইনফরমাল খাত অলাভজনক, অনুৎপাদনশীল এবং অদক্ষ শ্রমিকের অগত্যার গতি। অর্থাৎ ফরমাল খাতে যাঁর চাকরি হয় না, সেই উপায়হীন গরিব লোকটাই ইনফরমাল খাতে কাজ করেন। ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা ‘কেনিয়া রিপোর্ট’ নামের যে গবেষণাটি প্রকাশ করে, সেখানে ইনফরমাল খাতের কাজ ‘অগত্যার গতি’ এই প্রচলিত ধারণাকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা হয়। কেনিয়ার অভিজ্ঞতা থেকে দেখানো হয়, ইনফরমাল খাতের কর্মসংস্থানের সংখ্যা ফরমাল খাতের তুলনায় বহুগুণ দ্রুততার সঙ্গে বাড়ে, এই খাতের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা নিয়মিতভাবে স্বল্প পুঁজি বিনিয়োগ করেও পর্যাপ্ত মুনাফা করেন এবং বহু ক্ষেত্রে শিল্পকারখানাগুলোর তুলনায় এসব কাজের রোজগার ভালো এবং কাজের পরিবেশও ভালো। পরবর্তী সময়ে ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ কলিন উইলিয়ামসসহ নতুন ঘরানার অর্থনীতিবিদেরা দাবি করতে থাকেন, ফরমাল অর্থনীতির ব্যর্থতার কারণেই প্রসার ঘটেছে ইনফরমাল খাতের। শহুরে মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্তের জীবনে নানা ধরনের সার্ভিস বা পণ্যের চাহিদা আছে বলেই এর জোগানের অর্থনীতিও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া এসব কাজে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিবেশদূষণ নেই, নেই উচ্চ হারে বিদ্যুতের ব্যবহার। আমেরিকান অর্থনীতিবিদ টমাস প্যালে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের কোটি শ্রমিকের কাজকে প্রাতিষ্ঠানিক শিল্প খাতে রূপান্তর করার চিন্তাকে বলছেন অবাস্তব। বরং তাঁর মতে, অরক্ষিত খাতের শ্রমিকদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং সামাজিক সুরক্ষার আওতায় আনার মাধ্যমেই শ্রমিকের জীবনমান বাড়বে (সামাজিক সুরক্ষা মানে রেশনের চাল, বিনা মূল্যে সরকারি চিকিৎসা, বাচ্চাদের স্কুলিং, সরকারি হাউজিং, স্বল্প খরচে গণপরিবহন বা সুদমুক্ত ঋণের সুবিধা।) প্যালের মতে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ–সুবিধার মাধ্যমে অরক্ষিত শ্রমিক পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা বাড়ে। এতে সস্তা স্থানীয় পণ্যের চাহিদা তৈরি হয় এবং স্থানীয় শিল্প বিকাশের পথগুলো খোলে। কোভিড-১৯ কি আমাদের দেখিয়ে দেয়নি, বড় বড় কয়লা প্রকল্প আর অন্তঃসারশূন্য জিডিপি দিয়ে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন বাঁচে না। বরং স্থানীয় অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদি বিকাশই একমাত্র পথ!
ওপরতলার অর্থনীতিবিদ
২০০৮ সালের অর্থনৈতিক ধসের ঠিক আগে আগে আইএমএফের প্রধান অলিভিয়ে ব্ল্যানচার্ড তাঁর ‘স্টেট অব ম্যাক্রো’ লেখাটিতে নিশ্চিন্ত মনে লিখেছিলেন, ‘দ্য স্টেট অব ম্যাক্রো ইজ গুড।’ অর্থাৎ কোথাও কোনো সমস্যা নেই আরকি! পরবর্তী সময়ে ফোর্বস ম্যাগাজিন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেখিয়েছিল, বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ডিগ্রি নেওয়া অর্থনীতিবিদেরা ২০০৮–এর মন্দার ঠিক আগে আগেই আমেরিকার অর্থনীতির ফুলেফেঁপে ওঠা নিয়ে ব্যাপক উচ্ছ্বাস দেখিয়েছিলেন। ২০০৯ সালে প্রকাশিত হয় ডাহলেম রিপোর্ট (দ্য ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইসিস অ্যান্ড দ্য সিস্টেমেটিক ফেইলিয়র অব একাডেমিক ইকোনমিস্টস)। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদদের অবাস্তব সব গাণিতিক মডেলের ওপর অগাধ আস্থা, বাজার অর্থনীতির ওপর অন্ধ বিশ্বাস এবং অর্থনীতির ফুলেফেঁপে ওঠা সংখ্যাগুলোকে প্রশ্নহীনভাবে মেনে নেওয়াকে দায়ী করা হয় এই রিপোর্টে। এ দেশেও আছেন এমন অর্থনীতিবিদ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে হাতে গোনা কয়েকজন শ্রদ্ধাভাজন অর্থনীতিবিদ ছাড়া এ দেশের মূলধারার অর্থনীতিবিদেরা চেনেন খালি তৈরি পোশাক আর রেমিট্যান্স। তাঁরা দেখেন ৩০ বিলিয়ন ডলারের রিজার্ভ, দেখেন নবম শক্তিশালী অর্থনীতি। রিজার্ভের তলায় চাপা পড়ে যাওয়া প্রবাসী শ্রমিকের ঋণের বোঝা, তাঁদের কম খেয়ে বেঁচে থাকা আর ১৩ বছরে ৩৩ হাজার কফিনের বোবা কান্না বোঝার একাডেমিক প্রশিক্ষণ তাঁদের নেই। তাঁরা বোঝেন বছর বছর বাম্পার ফলন, ৪০ বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রি আর নির্মাণশিল্পে জমজমাট জিডিপি। বোঝেন না ৮০ ভাগ পোশাকশ্রমিকের অপুষ্টি ও রক্তশূন্যতা, বোঝেন না ১৭ কোটি মানুষকে ভাত খাওয়াতে কৃষকের রক্ত পানি করা ভর্তুকি, বোঝেন না ইটভাটার শ্রমিকের অবিরাম হাঁপানি। অথচ আমাদের দরকার ছিল গণমানুষের কথা বলা অর্থনীতিবিদ। পশ্চিমের শেখানো তত্ত্বকে যাঁরা ঝাঁকি দেবেন, ভাঙবেন এবং দুর্যোগের দিনে তীব্র রাগে প্রশ্ন করবেন, ‘আমার কৃষকের জন্য বরাদ্দ কই’? প্রশ্ন করবেন ‘৮% জিডিপির তলায় এত অন্ধকার কেন?’
মাহা মির্জা: উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক গবেষক।