৩৩ বছর বয়সী ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের নির্দেশনায় সৌদি সরকার একের পর এক পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভুল করে চলেছে। কাতারের ওপর গোঁয়াড়ের মতো অযৌক্তিক ও ব্যর্থ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা, লেবাননের প্রধানমন্ত্রী সাদ আল হারিরিকে গৃহবন্দী করা, মানবাধিকার ইস্যুতে কানাডার সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়া এবং ইয়েমেনে নৃশংস হামলা চালানোয় সৌদি সরকারের ভাবমূর্তি এমনিতেই দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে তুরস্কে সৌদি দূতাবাসের মধ্যে সৌদি সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে হত্যা করে সৌদি সরকার পুরো পরিস্থিতি লেজেগোবরে করে ফেলেছে।
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের প্রভাব বেড়ে যাওয়াটা সৌদি প্রতিরক্ষাব্যবস্থার জন্য স্পষ্টতই হুমকির বিষয়। এ অবস্থায় সৌদির উচিত ছিল তার পররাষ্ট্রনীতিকে আগের চেয়ে ইতিবাচকভাবে এগিয়ে নেওয়া। প্রতিবেশী দেশগুলোকে খেপিয়ে না তুলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করা উচিত ছিল।
কিন্তু দেখা গেল, মোহাম্মদ বিন সালমান সৌদি আরবের বহুদিন ধরে চলে আসা ঐতিহ্যবাহী পররাষ্ট্রনীতি ও ঠান্ডা মাথার কৌশলকে বাদ দিয়ে রাতারাতি এমন সব কাজ করতে লাগলেন, যা দেশের ভেতরে ও বাইরে অস্থিরতা ছড়িয়ে দিল।
শীতল যুদ্ধের প্রথম দশকে গোটা মধ্যপ্রাচ্যের ওপর দিয়ে একটা বিপ্লবের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল।
১৮০৫ সালে মিসরে মোহাম্মদ আলী যে রাজত্বের পত্তন ঘটিয়েছিলেন, সেই রাজবংশের রাজত্ব শেষ হয় ১৯৫২ সালে। ওই বছর এই বংশের শেষ শাসক বাদশাহ ফারুককে উৎখাত করা হলো। ১৯৫৮ সালে ইরাকের জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থীরা সেখানকার হাশেমি শাসক পরিবারকে উৎখাত করে। ১৯৬২ সালে ইয়েমেনের শাসক জাইদি ইমাম মোহাম্মদ আল বদরকে সেনাবাহিনী উৎখাত করে। ১৯৭৯ সালে ইরানের শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভিকে উৎখাত করে শিয়া মুসলিমরা।
মধ্যপ্রাচ্যের এই ঝড়ঝাপটার মধ্যে সৌদি আরবের রাজপরিবার সুকৌশলে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়। প্রতিবেশী ও পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সৌদি নেতারা অত্যন্ত সতর্কভাবে কূটনীতি বজায় রেখে এসেছেন। যতটা সম্ভব সবার সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রেখে এসেছেন। তাঁরা সব সময়ই সরাসরি যুদ্ধ থেকে নিজেদের সরিয়ে রেখেছেন।
এমনকি সরাসরি শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে নামার মতো পরিস্থিতি হলেও তাঁরা সরাসরি যুদ্ধ করেননি। সে ক্ষেত্রে তাঁরা প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়েছেন। ষাটের দশকে সৌদি সরকারের সঙ্গে মিসরের প্রেসিডেন্ট গামাল আবদেল নাসেরের দ্বন্দ্ব বেধেছিল। নাসের ইয়েমেনের শাসক ইমাম মোহাম্মদ আল বদরের বিরুদ্ধে লড়াইরত বিদ্রোহীদের সহায়তায় সেনা পাঠিয়েছিলেন। ওই সময় সৌদি সরকার ইয়েমেন সরকারের পাশে দাঁড়িয়েছিল। অর্থাৎ মিসরের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধ না করে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়েছিল সৌদি আরব। এর ধারাবাহিকতায় ইয়েমেনে সামরিক শক্তি ক্ষয় করার কারণে ১৯৬৭ সালে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে মিসরের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। একইভাবে ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ না করে ইরাক–ইরান যুদ্ধের সময় ইরাকিদের মদদ জুগিয়েছিল রিয়াদ।
একইভাবে নিজেদের গা বাঁচিয়ে সৌদি আরব এত দিন কূটকৌশল দিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করে এসেছে। উপসাগরীয় যুদ্ধ থেকে শুরু করে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত—সব খানে তার ভূমিকা পরোক্ষ ছিল। কিন্তু বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যুর পর সৌদি রাজপরিবারে ব্যাপক পরিবর্তন চলে আসে। যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান অতীতের সব ঐতিহ্যকে সরিয়ে ফেলে প্রথমবারের মতো সৌদিকে সামরিক অভিযানে নামিয়ে দেন। ইয়েমেনে সৌদি হামলায় অগণিত শিশু, নারীসহ সাধারণ মানুষ নিহত হওয়ায় বিশ্বজুড়ে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
মোহাম্মদ বিন সালমানের কাজকর্ম দেখে মনে হয় তিনি ধরেই নিয়েছেন, অর্থ দিয়ে পৃথিবীর সবকিছু অর্জন করা সম্ভব। তিনি সৌদির শত্রুদেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা তো করেনইনি, তিনি শত্রুর সংখ্যা বাড়িয়েছেন। শুধু তাঁর হঠকারী নীতির কারণে সৌদির বিরুদ্ধে এখন তুরস্ক, কাতার, ইরান, সিরিয়া, ইয়েমেন ও লেবানন তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে তিনি ইসরায়েলের সাফাই গাওয়ায় বেশির ভাগ আরব দেশ তাঁর ওপর চরমভাবে বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ হয়েছে। আসলে তিনি যাদের বন্ধু করার দরকার ছিল, তাদের শত্রু বানিয়েছেন এবং যাদের শত্রুদের কাতারে থাকার কথা ছিল, তাদের তিনি বন্ধুর কাতারে এনেছেন। এই ভুলের খেসারত তাঁকে দিতে হবে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনূদিত
মারওয়ান কাবালান সিরিয়ার লেখক ও গবেষক