১০০ দিন পার হলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। নিজের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন উত্তর কিভেয়ের এক বাসিন্দা
১০০ দিন পার হলেও যুদ্ধ থামার কোনো লক্ষণ নেই। নিজের বাড়ির ধ্বংসস্তূপের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন উত্তর কিভেয়ের এক বাসিন্দা

যুদ্ধের ১০০ দিনে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় কতটা কাবু রাশিয়া

সম্প্রতি ইউক্রেনের জন্য চার হাজার কোটি ডলারের একটি প্যাকেজ সহায়তা বিল মার্কিন সিনেটে পাস হয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে দেড় হাজার কোটি ডলার ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীতে যাবে। বাকি অর্থের বেশির ভাগই রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাত–সংশ্লিষ্ট অন্যান্য ফ্রন্টের জন্য রাখা হয়েছে।

ইউক্রেনকে যুক্তরাষ্ট্র এ পরিমাণ সহায়তা দেওয়ার পরও অর্থনীতির মাঠে বল রাশিয়ার পায়েই রয়ে গেছে। জ্বালানির রেকর্ড পরিমাণ দাম এবং সেই দামে রাশিয়ার কাছ থেকে ইউরোপীয় দেশগুলো জ্বালানি কিনতে বাধ্য হওয়ায় মস্কোর অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড সোজা রয়েছে।

মস্কো সেই জোরে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে এ যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ মারা গেছে এবং রাশিয়া ইউক্রেনের বেশির ভাগ অংশকে সম্পূর্ণ শক্তি দিয়ে ধ্বংস করার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু নির্মম সত্য হলো, রাশিয়ার সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়া ইউক্রেনকে পশ্চিমারা যে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিচ্ছে, তা যদি তারা এখনই পুনর্মূল্যায়ন না করে এবং তাদের বিদ্যমান কৌশল না বদলায়, তাহলে নিশ্চিতভাবে কমপক্ষে আরও ১০০ দিন এ যুদ্ধ চলবে।

শুরু থেকেই অর্থনৈতিক আঘাত করতে পশ্চিম যে প্রাথমিক অস্ত্র ব্যবহার করে আসছে, সেটি হলো নিষেধাজ্ঞা। নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রাশিয়ার মূল ব্যাংকিং সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন করা, ডলার মার্কেটে রুশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা এবং রুশ যুদ্ধ তহবিলকে জব্দ করার মাধ্যমে রাশিয়াকে কাবু করতে চেয়েছিল পশ্চিমারা। মস্কোকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করতে রুশ রপ্তানি খাতকে, বিশেষ করে তাদের কয়লা খাতকে পশ্চিমারা নিশানা করেছিল।

রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি কীভাবে পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা যায়, তা নিয়ে ইউরোপে এখনো বিশদ আলোচনা চলছে। এখন পর্যন্ত পশ্চিমারা রাশিয়ান অর্থনীতিকে কাবু করার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সে কৌশল শুধু ব্যর্থই হয়নি, উল্টো এর নেতিবাচক প্রভাব নিজেদের ওপর পড়েছে।

এখনো রাশিয়ান হাইড্রোকার্বন এবং ব্যাংকিং ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে কি না এবং করা হলে তা কীভাবে করা যেতে পারে, তা নিয়ে পশ্চিমাদের মধ্যে উত্তপ্ত আলোচনা হচ্ছে। কোনো পক্ষ রাশিয়ার ওপর সর্বাত্মক অবরোধ আরোপের পক্ষে, আবার কোনো পক্ষ এর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে আলোচনায় অংশ নেওয়া সব পক্ষই বুঝতে পারছে, এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা দিলে তাদের বাড়তি মাশুল গুনতে হবে।

বাইডেন প্রশাসন যে চার হাজার কোটি ডলারের তহবিল দিচ্ছে, তার এক–চতুর্থাংশ রাখা হয়েছে ইউক্রেন এবং সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলোতে যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব প্রশমিত করার জন্য। বেশ কিছু পশ্চিমা দেশ ইতিমধ্যে রাশিয়ার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে। তাদের পাশেও যুক্তরাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে।

এ চিন্তার কারণে পশ্চিমা অনেক দেশের মনোযোগ ধীরে ধীরে যুদ্ধ থেকে সরে যাচ্ছে। কারণ, তারা বুঝতে পারছে, এ বিলাসবহুল যুদ্ধের খরচ মেটানো ইউক্রেনীয়দের পক্ষে সম্ভব হবে না। এ ছাড়া রাশিয়ার বিরুদ্ধে আরও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হলে সেগুলোও শেষ পর্যন্ত দুর্বল হয়ে পড়তে পারে—এমন ঝুঁকি রয়ে গেছে।

পুতিন ইতিমধ্যেই স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, পশ্চিমারা যে কৌশলই নিক না কেন, তিনি তাঁর সামরিক ব্যয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া থেকে পিছপা হবেন না। এর জন্য যদি তাঁকে আরও স্বৈরাচারী হতে হয় কিংবা নিজের জনগণকে দরিদ্রের মুখে ফেলতে হয়, তবু তিনি এ অবস্থান থেকে সরবেন না।

এসবের অর্থ দাঁড়ায়, পশ্চিমারা যদি প্রকৃত অর্থেই ইউক্রেনে চলমান ধ্বংসযজ্ঞের ত্বরিত অবসান ঘটাতে এবং রাশিয়াকে তার অনাচারি কর্মকাণ্ডের জন্য জবাবদিহি করতে চায়, তাহলে তাদের শুধু ক্রেমলিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেই হবে না, বরং অর্থনৈতিক যুদ্ধের এ অস্ত্রের মোক্ষম ব্যবহারও শিখতে হবে।

রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পর তা দেশটিকে যে মাত্রায় চাপে ফেলবে বলে পশ্চিমারা প্রথমে আন্দাজ করেছিল, সেই পরিমাণ প্রভাব ফেলতে ইতিমধ্যে নিষেধাজ্ঞাগুলো ব্যর্থ হয়েছে। এসব নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে। নতুন আরও নিষেধাজ্ঞা দিলে তা ব্যর্থ হতে পারে—এমন ঝুঁকি আছে এবং সে ব্যর্থতা অর্থনৈতিক যুদ্ধে পশ্চিমের হাতকে আরও দুর্বল করে দেবে।

যদি ইউরোপীয় দেশগুলো তাদের ব্যয় সাশ্রয়ের কৌশল রপ্ত না করেই রাশিয়ার ওপর আরও নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাহলে তা পুতিনকে অর্থনৈতিকভাবে বাধাগ্রস্ত করার বিরুদ্ধে যায়, এমন ডানপন্থী যুক্তিগুলোকে জোরালো করতে পারে। যেমন ফ্রান্সের বিরোধীদলীয় ডানপন্থী নেতা মারি লো পেন ইতিমধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে হাইড্রোকার্বন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় কীভাবে ফ্রান্সে মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে এবং কীভাবে তা তাদের অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে, তা বর্ণনা করে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

হাঙ্গেরির নেতা ভিক্তর ওরবান কিংবা ইতালির মাত্তিও সালভিনির মতো জনপ্রিয় ডানপন্থী রাজনীতিবিদেরাও পুতিনের বিরুদ্ধে বাড়তি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তবে রাশিয়ার ওপর আরোপ করা পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করা উচিত হবে—এটা কিছুতেই বলা যাচ্ছে না। ইউক্রেনীয়রা টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা বিনা যুদ্ধে এক ইঞ্চি জায়গাও রাশিয়াকে দিতে রাজি নন। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধকে টিকিয়ে রাখতে এবং জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সমর্থন তৈরি করতে পশ্চিমাদেরও সময়োপযোগী কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে।

রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক যুদ্ধ চালানোর ক্ষেত্রে পশ্চিমাদের কিছু দুর্বলতা রয়েছে। যেমন রাশিয়ার বিরুদ্ধে শিপিং নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে গ্রিস বিরোধিতা করেছে। গ্রোনিংজেন এলাকা থেকে আরও গ্যাস তুলতে নেদারল্যান্ডসকে যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন অনুরোধ করলেও তারা তাতে রাজি হয়নি। আবার খোদ আমেরিকায় ট্রাম্পবাদী ডানপন্থীরা ইউক্রেনের জন্য আরও সাহায্য বরাদ্দের বিরুদ্ধে বাইডেন প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা করছেন।

নিষেধাজ্ঞাকে কার্যকর করতে হলে পশ্চিমের আরও অনেক দেশের সমর্থন প্রয়োজন। এর জন্য পশ্চিমকে কেবল নিজেকে রক্ষা করলেই হবে না, সম্ভাব্য মিত্রদেরও নিরাপত্তা দিতে হবে। যেমন সার্বিয়ার মতো দেশকে বিকল্প জ্বালানি না দিয়ে তাদের রাশিয়ার সঙ্গে থাকা গ্যাস চুক্তি বাতিল করতে বললে তা তারা শুনবে না।

বাইডেন প্রশাসন যে চার হাজার কোটি ডলারের তহবিল দিচ্ছে, তার এক–চতুর্থাংশ রাখা হয়েছে ইউক্রেন এবং সংশ্লিষ্ট অন্য দেশগুলোতে যুদ্ধের অর্থনৈতিক প্রভাব প্রশমিত করার জন্য। বেশ কিছু পশ্চিমা দেশ ইতিমধ্যে রাশিয়ার সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অনেক ইউরোপীয় রাষ্ট্র প্রতিরক্ষা ব্যয় বাড়িয়েছে। তাদের পাশেও যুক্তরাষ্ট্রকে দাঁড়াতে হবে।

সবশেষে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তার যে শক্তিশালী রিজার্ভ রয়েছে, তার চেয়ে শক্তিশালী হলো তার ভূ-অর্থনৈতিক শক্তি। তার অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় মিত্রদের সমর্থন আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মিত্রদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। এ যুদ্ধে পশ্চিমকে একযোগে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় নামতে হবে। নইলে যুদ্ধ আরও ব্যয়বহুল ও দীর্ঘমেয়াদি হবে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একজন ফেলো এবং লন্ডনভিত্তিক একজন রাজনৈতিক ঝুঁকিসংক্রান্ত একজন পরামর্শক