মাঝেমধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের বক্তব্যে মনে হয়, সংবিধানকে তারা সবকিছুর ঊর্ধ্বে স্থান দেয় এবং সংবিধান অনুসরণ করেই সব কিছু করে। ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে আগের দুটি নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত না হওয়ায় তত্ত্বাবধায়ক ধরনের সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনের দাবি অনেকেই তুলেছেন। সরকার প্রত্যাশিতভাবেই এই দাবি নাকচ করছে এবং প্রধান যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে সংবিধানের দোহাই। অথচ এই সরকারকেই আবার সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অনেক কাজ করতে দেখা যায় এবং সেই তালিকা বেশ দীর্ঘ। এই তালিকায় নতুন সংযোজন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরোধিতা করতে না পারা।
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার ইউক্রেন আগ্রাসনের নিন্দা জানানো এবং যুদ্ধ বন্ধের দাবির প্রস্তাবে বাংলাদেশ ভোটদানে বিরত ছিল। এটা প্রকারান্তরে রাশিয়াকে সমর্থন করা। নানা দিক থেকে বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হলেও বাদ গেছে এর গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক দিকটি। বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সংবিধানের আলাপ তোলা অনেকের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। তবু কথাগুলো আমাদের জানা থাকা দরকার।
বাংলাদেশ সংবিধানের রাষ্ট্রপরিচালনার মূলনীতি অংশের ২৫ অনুচ্ছেদে বাংলাদেশ সংঘাত এড়ানো এবং নিরস্ত্রীকরণের পক্ষে কথা বলে। নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কেমন হবে, সেটা বলা আছে তিনটি উপধারায়। এর মধ্যে দুটি উপধারা হচ্ছ—
২৫(খ) প্রত্যেক জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করিবেন; এবং (গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতাবাদ বা বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করিবেন।
অর্থাৎ ২৫(খ) অনুযায়ী ইউক্রেনের জনগণ এবং সরকারের তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং ন্যাটো জোটে যোগ দেওয়া বা না দেওয়ার অধিকার আছে বলে আমরা স্বীকার করছি এবং সেই অধিকারকে আমাদের সমর্থন করতে হবে। একই সঙ্গে রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ইউক্রেনের নাগরিকেরা যে প্রতিরোধযুদ্ধ করছেন, সেটা আমাদের সংবিধানের ২৫(গ) অনুযায়ী ‘ন্যায়সংগত’ এবং সেই ন্যায়সংগত যুদ্ধকে সমর্থন করা আমাদের রাষ্ট্রের কর্তব্য।
নীতিগতভাবে শান্তির পক্ষে এবং যুদ্ধের বিরুদ্ধে থাকলেও বাংলাদেশ তার সংবিধানে বাস্তব জ্ঞানের প্রতিফলন রেখেছে। না চাইলেও পৃথিবীতে যুদ্ধ হবে এবং সেই যুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের পক্ষে থাকতে হবে এবং আগ্রাসনের বিপক্ষে অবস্থান নিতে হবে। এটা যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রও আওড়ানো ‘সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ বাক্যটিকে একেবারেই শিশুতোষ বলে মনে হওয়ারই কথা।
প্রচণ্ড মার খাওয়া ইয়েমেনের হুতিরা মাঝে মাঝে সৌদি আরব এবং ইদানীং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ড্রোন অথবা মিসাইল দিয়ে কিছু আক্রমণ করছে। সৌদির সঙ্গে ২০১৯ সালের সামরিক চুক্তির আগে হুতিদের ওপর বর্বর হামলা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবাদ তো দূরে থাক কোনো কথাও বলেনি। কিন্তু এখন হুতিদের প্রতিটি হামলার ব্যাপারে বাংলাদেশ নিন্দা জানায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় এ-সংক্রান্ত প্রতিটি তথ্য পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ কেন জাতিসংঘ প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল, সেটা নিয়ে সরকারের দিক থেকে দেওয়া নানা ব্যাখ্যা জানলেও একটা কৌতূহলোদ্দীপক নতুন বক্তব্য পেয়েছি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখ থেকে। প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি কলামে হাসান ফেরদৌস লিখেছেন, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রস্তাবটি আনার সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিউইয়র্কে ছিলেন এবং বাংলাদেশের ভোটদানে বিরত থাকা নিয়ে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জনাব ফেরদৌসকে জানান, ‘আমরা যুদ্ধটুদ্ধ চাই না। আমরা শান্তি চাই।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উত্তরটা একেবারেই উদ্ভট, কারণ কোনো রাষ্ট্র যদি এই মুহূর্তে শান্তি চেয়ে থাকে, তাহলে তার উচিত ছিল প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেওয়া। কারণ, প্রস্তাবে বলা হয়েছিল রাশিয়াকে ‘অবিলম্বে, পুরোপুরি ও নিঃশর্তে’ ইউক্রেনের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সীমানা থেকে তাদের সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে। বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ইউক্রেন আগ্রাসনের পক্ষে নীরব সমর্থন দিয়েছে।
ফিরে আসি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে। বাংলাদেশ সরকার কি আসলেই এতই শান্তিকামী যে ‘যুদ্ধটুদ্ধ’ চায় না? প্রশ্নটির জবাব জানার আগে দীর্ঘদিন ধরে চলা এক ভয়ংকর আগ্রাসন নিয়ে মোটা দাগে কিছু কথা জেনে নেওয়া যাক।
ইয়েমেনের ওপর সৌদি আরবের আগ্রাসন আমাদের সংবাদমাধ্যমে বেশি মনোযোগ বেশি পায়নি। আর মানুষের মধ্যেও এই ব্যাপারে খুব বেশি আলোচনা দেখিনি। অথচ আমরা দেখতে পাই মধ্যপ্রাচ্যের ঘটা এ ধরনের আগ্রাসন নিয়ে এই দেশের জনগণের তুমুল আগ্রহ রয়েছে। এমনকি এখন রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর পুতিনের সমর্থকদের কাছ থেকে সেগুলো রেফারেন্স হিসেবেও আসছে।
আঞ্চলিক কয়েকটি পরাশক্তির প্রত্যক্ষ আর বৈশ্বিক কিছু পরাশক্তির পরোক্ষ প্রভাব ইয়েমেন যুদ্ধকে ভয়ংকর জটিল এক সংকটে পরিণত করেছে। এই সংকট নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটা নয়। তবে এটুকু জেনে রাখি, আরব-বসন্তের প্রভাবে ২০১১ সালে ইয়েমেনে ২২ বছর ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখা তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহ পদত্যাগে বাধ্য হন। তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন তাঁর ডেপুটি মনসুর হাদির কাছে।
ক্ষমতায় এসে হাদি দেশের সেনাবাহিনীসহ সব প্রতিষ্ঠানের ওপর তাঁর নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারেননি। এই সুযোগে ইয়েমেনের শিয়া (হুতি) জনগোষ্ঠী সশস্ত্র লড়াই শুরু করে। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় অনেক সুন্নি এমনকি সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ সালেহ এবং সেনাবাহিনীতে তাঁর অনুগত অংশ। এদের অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে এবং ২০১৪ সালে রাজধানী সানার দখল নেয় তারা। এরপর সেখান থেকে পালিয়ে যান মনসুর হাদি।
সৌদি আরবের সঙ্গে দীর্ঘ সীমান্ত থাকা একটি দেশের শিয়া সম্প্রদায় ক্ষমতা দখল করে ফেলবে, এটা মেনে নিতে রাজী নয় সৌদি আরব। তাই সৌদি আরবের নেতৃত্বে একটি জোট ইয়েমেনে বিমান হামলা শুরু করে ২০১৫ সালের মার্চে। হামলায় সরাসরি অংশ না নিলেও এই জোটকে অস্ত্রসহ যুদ্ধসরঞ্জাম, গোয়েন্দা তথ্য ইত্যাদি দিয়ে সাহায্য করেছে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও ফ্রান্স।
জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর থেকে জানিয়ে দেন, ইয়েমেন যুদ্ধে সৌদি আরবকে তিনি আর কোনো সাহায্য করবেন না। তিনি সৌদি আরবের ওপর এই যুদ্ধ থেকে সরে আসার ব্যাপারে চাপ দেন। সম্প্রতি তেল উৎপাদন বাড়ানোর প্রস্তাবে সৌদি আরবের সাড়া না দেওয়ায় দীর্ঘকালীন মার্কিন-সৌদি সুসম্পর্কের যে টানাপোড়েন আমাদের সামনে আসে, তার পেছনে ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে মার্কিন সমর্থন প্রত্যাহার একটা বড় কারণ।
তিন কোটির বেশি জনসংখ্যার ইয়েমেনে হুতি ৩৫ শতাংশ। কারও কাছে মনে হতে পারে সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নিদের ক্ষমতা থেকে ফেলে দিয়ে শিয়াদের ক্ষমতা দখল করার ‘অনৈতিক’ কাজটিকে তো বাধা দেওয়াই উচিত। তাহলে এটা জেনে রাখা দরকার যে সৌদি আরবের সীমান্তের আরেক দেশ বাহরাইনের জনসংখ্যার ৭০ শতাংশ শিয়া। আরব-বসন্তের সময় ২০১১ সালে বাহরাইনেও সুন্নি রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শিয়াদের নেতৃত্বে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন হয়েছিল। তখন সৌদি আরবের নেতৃত্বে কয়েকটি দেশের সেনাবাহিনী বাহরাইনে ঢুকে নির্দয়ভাবে বলপ্রয়োগ করে সেই আন্দোলন নস্যাৎ করে। আবার উল্টো ঘটনা ঘটছে সিরিয়ায়, মাত্র ১৩ শতাংশ শিয়ার দেশ সিরিয়ার অবকাঠামো ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটিয়ে শিয়া প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে ইরান রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে কী ভয়ংকর কাণ্ড করছে, তা আমরা জানি। আসলে মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাতময় দেশগুলো হয়ে দাঁড়িয়েছে সৌদি আরব আর ইরান এবং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়ার নামে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর এক প্রক্সি যুদ্ধক্ষেত্রে; পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধ বা সামরিক অভিযান পরিচালনার জন্য আর যা যা বলা হয়, সেগুলো সব আসলে বাহানা।
যুদ্ধের আগেই মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে দরিদ্র দেশগুলোর একটা ছিল ইয়েমেন। ২০১৫ সালে শুরু সাত বছরের যুদ্ধে (২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত) গুলি-বোমায় নিহত মানুষের সংখ্যা দেড় লাখের মতো। আর যুদ্ধের সময় খাদ্য এবং চিকিৎসার অভাবে মৃত্যু হয়েছে আরও অন্তত আড়াই লাখ মানুষের। এই আড়াই লাখের ৭০ শতাংশই শিশু। এই যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত হয়েছে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা চরম খাদ্যসংকটে আছে। একসময় ইথিওপিয়া আর সোমালিয়ায় দুর্ভিক্ষের সময়ের মানুষের ছবি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল, এখন ইয়েমেনের ঠিক সে রকম মানুষ, বিশেষ করে শিশুদের কঙ্কালসার ছবিতে সয়লাব হয়ে আছে ইন্টারনেট।
বাংলাদেশ ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে সৌদি আরবের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। চুক্তির বিস্তারিত না জানা গেলেও সংবাদমাধ্যম থেকে এটুকু আমরা জানতে পারি, এই চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ন (১৮০০ সৈন্য) সৌদি-ইয়েমেন সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে। বলা হয়েছে বাংলাদেশ ইয়েমেনে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেবে না, বরং সীমান্ত অঞ্চলে মাইন পরিষ্কার করার কাজ করবে।
কোনো যুদ্ধে শুধু সম্মুখযুদ্ধে থাকা মানেই যুদ্ধ করা নয়। এ কারণেই একটা সেনাবাহিনীর নানা রকম বিভাগ থাকে। কেউ সম্মুখযুদ্ধ করে, কেউ যোগাযোগ নিশ্চিত করে, কেউ যুদ্ধের অস্ত্র-গোলাবারুদ এবং খাবারের রসদ সরবরাহ করে, কেউ রাস্তা বানায় আবার কেউবা মাইন পরিষ্কার করে রাস্তা নিরাপদ রাখে। প্রতিটি কাজই যুদ্ধের অংশ। সরকারের বলা কথাটুকু থেকে নিশ্চিতভাবেই ধারণা করা যায়, বাংলাদেশ কার্যত সৌদি আরবের হয়ে ইয়েমেনে যুদ্ধ করছে।
প্রচণ্ড মার খাওয়া ইয়েমেনের হুতিরা মাঝে মাঝে সৌদি আরব এবং ইদানীং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ড্রোন অথবা মিসাইল দিয়ে কিছু আক্রমণ করছে। সৌদির সঙ্গে ২০১৯ সালের সামরিক চুক্তির আগে হুতিদের ওপর বর্বর হামলা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিবাদ তো দূরে থাক কোনো কথাও বলেনি। কিন্তু এখন হুতিদের প্রতিটি হামলার ব্যাপারে বাংলাদেশ নিন্দা জানায়। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পাতায় এ-সংক্রান্ত প্রতিটি তথ্য পাওয়া যাবে।
হ্যাঁ, ‘যুদ্ধটুদ্ধ’ না চাওয়া বাংলাদেশ সরকার কিন্তু ইয়েমেনে যুদ্ধের একটি পক্ষ। সেখানে গুলিতে, বোমায়, খেতে না পেয়ে, চিকিৎসার অভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাচ্ছে সাধারণ ইয়েমেনিরা।
ডা. জাহেদ উর রহমান ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক