চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করে এরই মধ্যে ‘ট্যারিফ ম্যান’ খেতাব পেয়ে গেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। অবশ্য শুধু চীনের ওপর শুল্কারোপের কারণেই এ খেতাব পাননি তিনি। কাছাকাছি সময়ে মেক্সিকোর ওপরও শুল্কারোপ করেছেন তিনি। চীনের ক্ষেত্রে বাণিজ্য অসাম্যের কথা বলা হলেও মেক্সিকোর ক্ষেত্রে এসেছে অভিবাসন সংকটের বিষয়টি। অর্থাৎ সংকট সে অর্থনৈতিক হোক, আর রাজনৈতিক হোক, ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘ট্যারিফের অস্ত্রটি’ খেলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ। কিন্তু এই প্রবণতাই বিশ্বকে ঠেলে দিচ্ছে এক ভীষণ অনিশ্চয়তার দিকে।
মেক্সিকোর ক্ষেত্রে হুমকিটি খুব দ্রুত কাজ করেছে। ঘোষণার পরপরই দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তারা ছোটেন ওয়াশিংটনে। এই একই পদক্ষেপ চীনের ক্ষেত্রে ঠিক কাজ করছে না। কাজ করার কথাও নয়। চীন মুখে আলোচনায় আগ্রহ দেখালেও পাল্টা পদক্ষেপই শুধু নেয়নি, আরেকটি লং মার্চের ডাক দিয়ে দিয়েছে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প আদতে একজন ব্যবসায়ী। নিজের ব্যবসায়িক জীবনের সমীকরণগুলোই তিনি রাজনীতির ময়দানে প্রয়োগ করছেন। একজন ব্যবসায়ী হিসেবেই ট্রাম্প চীনকে যুক্তরাষ্ট্রের বড় প্রতিপক্ষ বলে বিবেচনা করে আসছেন অনেক আগে থেকেই। ২০১১ সালে সিএনএনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি চীনকে ‘সবচেয়ে বড় শত্রু’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। নির্বাচনী প্রচারের সময়ই চীনকে দেখে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। প্রেসিডেন্ট পদে বসার পর শুরুতে সে পথে না হাঁটলেও পরে ঠিকই ‘ট্যারিফ ম্যান’ হিসেবে আবির্ভূত হন। এরই মধ্যে ২০ কোটি ডলার মূল্যমানের চীনা পণ্য আমদানিতে ২৫ শতাংশ হারে শুল্কারোপ করেছেন। আরও ৩০ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের পণ্যে একই হারে শুল্কারোপের হুমকি দিয়ে রেখেছেন। এই হুমকিটি সত্যে পরিণত হলে তা এমনকি চীনা প্রযুক্তি কোম্পানি হুয়াওয়েকে নিষিদ্ধ করার ঘটনাকেও ছাড়িয়ে যাবে।
ডোনাল্ড ট্রাম্প এই সব পদক্ষেপই নিচ্ছেন একজন ব্যবসায়ীর মতো করে, যেখানে প্রতিপক্ষকে হুমকি দেওয়া, কোনো ছাড় না দেওয়া এবং পিছু না হটে শুধু জেতার জন্য লড়ে যাওয়াটাই দস্তুর। কিন্তু ট্রাম্প ভুলে যাচ্ছেন যে, এই খেলাটা খেলছেন তিনি বৈশ্বিক রাজনীতির ময়দানে। যেখানে জয়ও অনেক সময় পরাজয়ের কারণ হয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর প্রশাসন এমনকি চীনের ইতিহাসের দিকেও তাকাচ্ছে না, যেখানে নিজেদের চেয়ে শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার বহু নিদর্শন রয়েছে চীনের। মাইক পম্পেওর যেমন বলছেন, ‘ইন্টারনেট হয় পশ্চিমা মূল্যবোধ নয়তো কমিউনিস্ট মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হবে।’ অর্থাৎ তিনি এ দুইয়ের কোনো সমন্বয়ের ক্ষেত্র রাখতে চান না।
এই বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় আবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের ‘নয়া লং মার্চের’ ডাকের মধ্যে। চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে সৃষ্ট সব বাধা মোকাবিলার লক্ষ্যে তিনি এ লং মার্চের ডাক দিয়েছেন, যা চীনাদের কাছে অনেক অর্থবহ। এ ডাক তাদের সামনে হাজির করছে ১৯৩৪ সালে শুরু হওয়া লং মার্চকে, যেখানে তারা বিজয় দেখেছিল। এ ক্ষেত্রেও বিজয়কেই একমাত্র সত্য মানছে তারা।
এটা সত্য যে, অর্থনৈতিক চাপে চীন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের হিসাব এ ক্ষেত্রে ঠিকই আছে। শুল্ক-যুদ্ধের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চীনের অর্থনীতিই বেশি চাপে পড়বে। বিষয়টির প্রভাব মূলত খোলাচোখে বাজার ও পণ্য আমদানি-রপ্তানি দিয়েই হাজির করা হচ্ছে। কিন্তু এর মূল প্রভাবটি তো পড়বে দুই দেশেরই শ্রমজীবীদের ওপর। রাষ্ট্রের হিসাবে যে অর্থনৈতিক চাপের সমীকরণ আসছে, তার চেয়ে সাধারণ মানুষের ওপর সৃষ্ট এর প্রভাব হাজারগুণ বেশি। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকেরা এই পরিস্থিতির ফল হিসেবে ‘আরেকটি অর্থনৈতিক মন্দার’ কথা বলছেন। এটি হয়তো রাতারাতি দৃষ্টিগ্রাহ্য হবে না। কিন্তু এই বাণিজ্য যুদ্ধ চলতে থাকলে যে, তা দৃষ্টিসীমায় দ্রুতই চলে আসবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এই দ্বৈরথে উলুখাগড়ার মতো বহু দেশ জড়িয়ে যাবে বা যাচ্ছে সন্দেহ নেই। বিশ্বের ১২০টি দেশের শীর্ষ আমদানি উৎস হচ্ছে চীন। দেশটির ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড’ উদ্যোগের সঙ্গে বহু দেশ যুক্ত হয়েছে। ফলে এই দ্বৈরথ দীর্ঘ সময় চলতে থাকলে, তা বিশ্বকে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে একটি পক্ষকে বেছে নেওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি করবে দেশগুলোর সামনে। এ ক্ষেত্রে এক বড় সংকটের সৃষ্টি হবে। কারণ বাণিজ্য শক্তির জায়গা থেকে চীন ব্যাপক প্রভাবশালী হলেও রাজনীতি-অর্থনীতি দুই বিবেচনাতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবের সঙ্গে তা তুলনীয় নয়। ফলে দীর্ঘ সংকটাবস্থার সৃষ্টি হবে। এ কারণে বাণিজ্যযুদ্ধকে শুধু প্রযুক্তি কোম্পানি বা সয়াবিনের লড়াই হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।
যুক্তরাষ্ট্র অবশ্য এটিকে শুধু বাণিজ্যযুদ্ধ হিসেবে দেখছেও না। দেখলে, যুক্তরাষ্ট্রে চীনা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষায় বাধা তৈরি করত না তারা। সব বিচারেই এটি বাজার অর্থনীতির বিশ্বকাঠামোয় আধিপত্য বিস্তার ও আধিপত্য ধরে রাখার লড়াই। ফলে চলতি মাসে জাপানে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের আলোচনায় তড়িৎ কোনো সমাধান আসার সম্ভাবনা কম বলেই মনে করছেন অনেক বিশ্লেষক। আর তেমনটি হলে এর ক্ষতি বহন করতে হবে গোটা বিশ্বকেই। মার্কিন বিনিয়োগ ব্যাংক মরগান স্ট্যানলিকে উদ্ধৃত করে মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্কার বলছে, ‘যদি কোনো সমঝোতা না হয় এবং আরও ৩০ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের চীনা পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ হয়, তাহলে বৈশ্বিক অর্থনীতি আরেকটি মন্দার মুখে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’
বিরোধটি মিটবে কি মিটবে না, তার অনেকটাই নির্ভর করছে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদাকে এ ক্ষেত্রে অত্যধিক মনে করছে চীন। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের এক প্রতিবেদনে যেমন বলা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে বাণিজ্য অসাম্য রোধ করাটা অসম্ভব এক ব্যাপার। কারণ, এটি বৈশ্বিক উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ভোগ করলেও যুক্তরাষ্ট্র উৎপাদন করে মাত্র ১৩ শতাংশ। ফলে উভয় পক্ষই মুখে স্বীকার না করলেও জানে যে, তাদের এ দ্বৈরথ বাণিজ্যকেন্দ্রিক শুধু নয়। যুক্তরাষ্ট্র চায় চীন তার শিল্প খাতে দেওয়া ভর্তুকি ও বিদেশি কোম্পানির স্বার্থ রক্ষায় নতুন নীতি গ্রহণ করুক, যা বাণিজ্য বলয় বৃদ্ধির নীতি নেওয়া সি চিন পিং প্রশাসনের জন্য রীতিমতো সাংঘর্ষিক।
যুক্তরাষ্ট্র মূলত বিশ্বমোড়ল হিসেবে চীনের কাছ থেকে পূর্ণ আনুগত্য চাইছে। এ ক্ষেত্রে বাণিজ্য একটি অস্ত্র, যা ওয়াশিংটন এর আগে সফলভাবে বহু দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেছে। হালে ইরানকে বশে আনতেও একই অস্ত্র ব্যবহার করছে। কিন্তু ইরানের মতোই এ দ্বৈরথ আর বাণিজ্যযুদ্ধে সীমাবদ্ধ থাকছে না বলেই মনে হয়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান ব্রিজওয়াটার অ্যাসোসিয়েটসের প্রধান নির্বাহী রে ডালিওর মতো অনেকেই বর্তমান অবস্থাকে বেশ আশঙ্কাজনক হিসেবে বিবেচনা করছেন। মার্কিন এ প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিতে, ‘পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, যুদ্ধটি বাণিজ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি প্রতিটি ফ্রন্টের জন্য উন্মুক্ত।’ এই বক্তব্যের প্রমাণ অবশ্য রয়েছে। কারণ গত কয়েক বছর ধরেই দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে চীনের উত্তেজনাতেই এর স্বাক্ষর রয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর এই মুহূর্তে সর্বোচ্চ মনোযোগ দাবি করে। কারণ, কোনো সামরিক সংঘর্ষের আশঙ্কা তৈরি হলে, তা এ জায়গাটি থেকেই হবে। চীনকে চটানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের হাতে রয়েছে আরও দুটি বড় অস্ত্র—তাইওয়ান ও তিব্বত। এই তিনটির যেকোনোটিতে উসকানি এবং তাতে চীনের সাড়া দেওয়া এক ভয়াবহ সংকটের মুখে ফেলতে পারে বিশ্বকে।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের নামে যে দ্বৈরথে জড়িয়েছে, তার ফল কী হবে তা এখনো নিশ্চিত নয়। গ্রিক ঐতিহাসিক থুসিডিডিসের একটি তত্ত্ব এ ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক হতে পারে। থুসিডিডিস বলেছিলেন, উদীয়মান শক্তির সঙ্গে ক্ষমতাসীনের দ্বন্দ্ব অবশ্যম্ভাবী এবং এই দ্বন্দ্ব রক্তপাতে শেষ হতে বাধ্য। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র শেষ পর্যন্ত এই দ্বন্দ্বকে কোথায় নিয়ে যাবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে তা দীর্ঘায়িত হোক, তা কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত নয়। কারণ, এই দ্বন্দ্ব দ্রুত নিষ্পত্তি না হলে গোটা বিশ্বকেই এর মূল্য চোকাতে হবে।
ফজলুল কবির: সাংবাদিক
ই-মেইল: fazlul.kabir@prothomalo.com