বাংলাদেশের মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা বেশ চোখে পড়ার মতো। পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে, টক শোতে হচ্ছে আলোচনা। খবরে প্রকাশ: সরকার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য লবিস্ট নিযুক্ত করেছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর ‘গণতন্ত্র’ সম্মেলনে বাংলাদেশকে ডাকেননি। বাংলাদেশের র্যাবের কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে! এই প্রেক্ষাপটে অনেকেই বলছেন, মানবাধিকারের সবক আর যার কাছেই নিই না কেন, যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে নিতে আমরা রাজি নই, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলার অধিকার নেই। এ ধরনের বক্তব্যকে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি যা–ই হোক, মানবাধিকার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের কথা বলার অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তোলার যৌক্তিক কারণ রয়েছে।
ইরাকের কাছে আছে গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র—এই অজুহাত দেখিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে ইরাক আক্রমণ করে বসে। তাতে লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ মারা যায়। আমেরিকার ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক হিসাবে বলা হচ্ছে, অন্তত ১ লাখ ৮৪ হাজার থেকে ২ লাখ ৭ হাজার বেসামরিক মানুষ আমেরিকার হামলার কারণে মারা গেছে। পরে যুক্তরাষ্ট্রই স্বীকার করেছে যে ইরাকের কাছে কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র যখন জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করেছিল, যাতে লাখ লাখ বেসামরিক মানুষ মারা যায়। যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁরা ঈর্ষা করেছেন মৃত ব্যক্তিদের। প্রেসিডেন্ট ট্রুম্যান তখন যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে বেসামরিক মানুষের জন্য একফোঁটা অশ্রু ছিল না, ছিল না একটুখানি দীর্ঘশ্বাস, ছিল শক্তির উন্মাদনা, ‘এটাকে বলা হয় অ্যাটম বোমা! এটা ২০ হাজার টন টিএনটির সমান ধ্বংসক্ষমতা রাখে। এটা ব্রিটিশদের গ্র্যান্ড স্লাম বোমার তুলনায় দুই হাজার টন শক্তিশালী!’
আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মানবাধিকার প্রশ্নে উপদেশ শুনতে রাজি নই, কিন্তু নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুখ দেখতে হবে! আমাদের নাগরিকদের মধ্যেই, আমাদের সমাজের মধ্যেই উগ্রতা, হিংস্রতা, সহিংসতার উপাদান খুবই আদিম পর্যায়ে রয়ে গেছে। এই দেশে মাত্র সেদিনও স্কুলের সামনে অপেক্ষারত অভিভাবককে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গণপিটুনিতে পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারীকে মারাটাকে এই দেশে স্বাভাবিক বলেই যেন ধরে নেওয়া হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে কী করেছে, আফগানিস্তানে কী করেছে, সেসব বলতে গেলে মানবতা অধোবদন হতে বাধ্য। দেশে দেশে গুপ্তহত্যা ঘটানো ছিল তাদের নিত্যদিনের কাজ। খোদ যুক্তরাষ্ট্রে কালো মানুষদের পুলিশ যেভাবে বিনা বিচারে গুলি করে মারে, গলায় বুট ঠেসে ধরে শ্বাসরোধ করে মারে, তাতে মানবাধিকারই চিৎকার করে ওঠে: উই ক্যান নট ব্রিদ। আমরা শ্বাস নিতে পারছি না। ওসামা বিন লাদেনকে কোন বিচারের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে? ভয়াবহ ব্যাপার যে ২০১১ সালে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদের দেয়ালঘেরা বাড়িতে কোনো রকমের প্রতিরোধেরই মুখোমুখি হতে হয়নি আমেরিকান কমান্ডোদের, তারা ঠান্ডা মাথায় লাদেনকে গুলি করে হত্যা করে, আর তারপর প্রেসিডেন্ট ওবামা একের পর এক মিথ্যা কথা বলতে থাকেন। ক্রসফায়ারের গল্পটা বানানো। হত্যা করার সিদ্ধান্ত পূর্বপরিকল্পিত।
আমেরিকার হাতভরা রক্ত আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের দাগ। পারস্যের সব সুগন্ধি ঢেলেও সেই হাতের গন্ধ দূর করা যাবে না। গুয়ানতানামো বে ডিটেনশন ক্যাম্পে ‘হেফাজতে মৃত্যু’ ঘটেছে ৯ জনের। ইরাকে মার্কিন সেনারা বন্দীদের ওপরে কী রকম যৌন ও নৃশংস অত্যাচার করত, তার ভিডিও দেখে বিশ্ববাসী স্তম্ভিত হয়ে যায়! এমনকি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম চলাকালে নিয়মনীতি ভেঙে পাকিস্তানিদের অস্ত্র সরবরাহ করা, বঙ্গোপসাগরের দিকে সপ্তম নৌবহর পাঠানো, চীনকে বলা ভারত আক্রমণ করতে, এমনকি দরকার হলে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকাতে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করবে বলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের উক্তি—সব মিলিয়ে বাংলাদেশে মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর জন্য নিক্সন-কিসিঞ্জারকে দায়ী করে বিচার করা উচিত বলে গবেষকেরা বলছেন।
অর্থাৎ মানবাধিকার প্রশ্নে হিতোপদেশ দেওয়ার অধিকার আমেরিকার থাকার কথা নয়।
২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটা উন্নত দেশ হবে বলে আমরা আশা করি। তবে এই উন্নতি কেবল অর্থনৈতিক উন্নতি বা মাথাপিছু আয়ের উন্নতি হলে চলবে না। উন্নতি হতে হবে আমাদের চিন্তাচেতনার, আমাদের সামাজিক অবস্থার, আমাদের উদারতার, সহনশীলতার, পরমতসহিষ্ণুতার, সুশাসনের, মানবাধিকারের, পরিবেশের, মাটি-পানি-বন-আকাশ দূষণমুক্ত রাখার প্রক্রিয়ার। আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে মানবাধিকার প্রশ্নে উপদেশ শুনতে রাজি নই, কিন্তু নিজেদের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মুখ দেখতে হবে! আমাদের নাগরিকদের মধ্যেই, আমাদের সমাজের মধ্যেই উগ্রতা, হিংস্রতা, সহিংসতার উপাদান খুবই আদিম পর্যায়ে রয়ে গেছে। এই দেশে মাত্র সেদিনও স্কুলের সামনে অপেক্ষারত অভিভাবককে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। গণপিটুনিতে পকেটমার কিংবা ছিনতাইকারীকে মারাটাকে এই দেশে স্বাভাবিক বলেই যেন ধরে নেওয়া হয়েছে। ডাকাত সন্দেহে গ্রামবাসী পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলে। কোথাও কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে জনতার প্রথম কাজ হয় গাড়ি ভাঙচুর করা, ড্রাইভারকে পিটুনি দিতে আরম্ভ করা।
আমরা সেই পাকিস্তান আমল থেকে ‘ফাঁসি চাই’, ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগান দিতে দিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রবণ একটা জনসমষ্টিতে পরিণত হয়েছি। আমেরিকায় এখনো বহু রাজ্যে মৃত্যুদণ্ড বহাল। টাইম ম্যাগাজিন ২০১৪–এর এপ্রিলে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আমেরিকায় মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামিদের ক্ষেত্রে অন্তত ৪ শতাংশ ভুল হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া উচিত নয়—এমন মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এটা যদি আমেরিকার বেলাতেই ঘটতে পারে, এই দেশে তাহলে কতটা ঘটতে পারে, তা আমাদের সহজবোধ্য। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশে ২০০৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ক্রসফায়ার, শুটআউট, বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন ২ হাজার ৮৫০ জন। এই সংখ্যা কমবেশি হতে পারে, কিন্তু এগুলো সংখ্যা নয়, একেকটা মানুষের জীবন! ২০০৬ সালে প্রকাশিত হুমায়ূন আহমেদের হলুদ হিমু কালো র্যাব বইয়ের খানিকটা উদ্ধৃতি:
বিনা বিচারে হত্যা, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে মৃত্যু—এই ধরনের কথা আমাদের দেশ থেকে চিরদিনের জন্য লুপ্ত হোক। এটা করতে হবে সরকারকে, রাষ্ট্রকে। এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিক। কিন্তু দেশের মানুষ যদি সচেতন না হয়, নাগরিকেরা যদি মানবাধিকার প্রশ্নে জাগ্রত না হয়, তাহলে ক্ষমতা তো সেই সুযোগ নিতে ছাড়বে না।
‘আপনি কেন আমাদের কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না, বলুন তো? আপনার যুক্তিটা শুনি। আপনি কি চান না ভয়ংকর অপরাধীরা শেষ হয়ে যাক? ক্যানসার সেলকে ধ্বংস করতেই হয়। ধ্বংস না করলে সেল সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।’
হিমু জবাব দিয়েছিল, ‘স্যার, মানুষ ক্যানসার সেল না। প্রকৃতি মানুষকে অনেক যত্নে তৈরি করে। একটা ভ্রূণ মায়ের পেটে বড় হয়। তার জন্য প্রকৃতি কী বিপুল আয়োজনই না করে! তাকে রক্ত পাঠায়, অক্সিজেন পাঠায়। অতি যত্নে শরীরের একেকটা জিনিস তৈরি হয়। দুই মাস বয়সে হাড়, তিন মাসে চামড়া, পাঁচ মাস বয়সে ফুসফুস। এত যত্নে তৈরি করা একটা জিনিস বিনা বিচারে ক্রসফায়ারে মরে যাবে—এটা কি ঠিক?’
আমরা ২০৪১ সালে যে উন্নত আলোকিত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি, সেখানে বিনা বিচারে হত্যা তো করা হবেই না, মৃত্যুদণ্ডও তুলে দেওয়া হবে, এই স্বপ্ন অবশ্যই আমাদের দেখতে হবে।
এই জন্য আমাদের সমাজকে উপযুক্ত হয়ে উঠতে হবে। প্রতিটি নাগরিককে উপযুক্ত হতে হবে। একটা তত্ত্ব আছে, যে দেশে মাথাপিছু আয় কম, সে দেশে সুশাসন আসে না। আমাদের মাথাপিছু আয় বাড়ছে, এখন সুশাসনও আমাদেরই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গণতন্ত্রকে আমরা রক্ষা করব চোখের মণির মতো, মানবাধিকার রক্ষায় আমরা হব চ্যাম্পিয়ন। আমরা এই দেশে নাগরিকদেরই বলতে শুনি, অপরাধীর কিসের মানবাধিকার? এটাই আসলে লিটমাস টেস্ট। এই কথা শুনলেই আমরা বুঝতে পারি আমাদের নাগরিকেরা এখনো সচেতন নন, প্রস্তুত নন। অভিযুক্তমাত্রই অপরাধী নয়। অভিযুক্ত অপরাধী কি না, তার চুলচেরা বিশ্লেষণ লাগবে, সেটাকেই বলে বিচার। আইনানুগ বিচার হবে। আইনানুগ শাস্তি হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিদ্ধান্ত নিতে পারে না, কে অপরাধী।
বিনা বিচারে হত্যা, ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে মৃত্যু—এই ধরনের কথা আমাদের দেশ থেকে চিরদিনের জন্য লুপ্ত হোক। এটা করতে হবে সরকারকে, রাষ্ট্রকে। এই সিদ্ধান্ত অবশ্যই রাজনৈতিক। কিন্তু দেশের মানুষ যদি সচেতন না হয়, নাগরিকেরা যদি মানবাধিকার প্রশ্নে জাগ্রত না হয়, তাহলে ক্ষমতা তো সেই সুযোগ নিতে ছাড়বে না।
২০৪১ সালে বাংলাদেশ হয়ে উঠুক সত্যিকারের উন্নত দেশ। সেই দেশে নাগরিকেরা থাকবে সচ্ছল, নিরাপদ, সুখী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সমাজ হবে বৈষম্যমুক্ত, হিংসামুক্ত; মানবাধিকার থাকবে অটল; নির্বাচন হবে সত্যিকারের নির্বাচন; প্রতিটা নাগরিক মান্য করবে আইন, আর আইন মেনেই তারা প্রত্যেকে হয়ে উঠবে প্রকৃত স্বাধীন। তারা কথা বলবে স্বাধীনভাবে, পথ চলবে নির্ভয়ে, মাথা উঁচু করে বলবে এই হচ্ছে সেই দেশ—চিত্ত যেথা ভয়শূন্য উচ্চ যেথা শির!
● আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক