আজ-কাল-পরশু

যানজট: স্বল্পমেয়াদি কয়েকটি পদক্ষেপ

.

রাজধানী ঢাকার যানজট অনেক আগেই অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। ঢাকায় বসবাসরত ও কর্মোপলক্ষে আগত কারও পক্ষে এখন ঢাকায় দিনে-রাতে দুটির বেশি প্রোগ্রাম করা সম্ভব নয়। যানজটকে বাস্তবতা মেনে নিয়ে রাজধানীর মানুষ এখন তাদের দিনের কর্মসূচি প্রণয়ন করে।
ঢাকার যানজট প্রচলিত অর্থে কোনো ‘স্থানীয়’ সমস্যা নয়। এ মহানগরে সারা দেশ থেকে প্রতিদিন মানুষ আসে নানা কাজে, নানা প্রান্তে তাদের যেতে হয়। এখানে সচিবালয়, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অফিস, মন্ত্রীদের অফিস, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের হেড অফিস, দূতাবাস, বিদেশি সংস্থার অফিস, বেসরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয়, আরও কত কী!
যেকোনো সমস্যার তিন ধরনের সমাধান থাকে। স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি। যানজট নিরসনে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি কয়েকটি সমাধানের কাজ করতে দেখা যাচ্ছে। ফ্লাইওভার ও মেট্রোরেল নির্মাণ। প্রথমটির ফল পেতে আরও দুই থেকে তিন বছর, দ্বিতীয়টির ফল পেতে পাঁচ থেকে সাত বছর লাগতে পারে। দুটোই গুরুত্বপূর্ণ ও প্রয়োজনীয় কাজ। মেট্রোরেল যানজট সমস্যার অনেকটা সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয়। কারণ, মেট্রোরেল একসঙ্গে কয়েক হাজার যাত্রী নিয়ে চলাচল করবে। কিন্তু ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে খুব একটা বড় ভূমিকা রাখতে পারবে না বলে অনেক বিশেষজ্ঞ বলেছেন। ফ্লাইওভার যেমন অনেক গাড়িকে রাস্তা থেকে ওপরে নিয়ে যাবে, তেমনি প্রতিবছর আরও হাজার হাজার নতুন গাড়ি রাস্তায় নামবে। গাড়ি কেনার ব্যাপারে বাংলাদেশে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। টাকা থাকলে পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য অনেকে গাড়ি কিনছেন। কাজেই ফ্লাইওভার যানজট নিরসনে বড় ভূমিকা পালন করবে না। ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার ও চট্টগ্রামে বহদ্দারহাটের ফ্লাইওভার তার দুটি প্রমাণ। কিন্তু সরকার ফ্লাইওভার নির্মাণে দারুণ উৎসাহী।
সরকার যেদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না, তা হলো স্বল্পমেয়াদি সমাধান। এ ব্যাপারে সরকার সক্রিয় নয় বলে যানজট সমাধানে সরকারের অনাগ্রহ প্রকাশ পায়। স্বল্পমেয়াদি সমাধান কী কী? এ ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমরা কয়েকটি ধারণা এখানে বলতে পারি।
১. সরকার পর্যায়ক্রমে এক বছরের মধ্যে ৫০০ আধুনিক এসি ও নন-এসি বাস রাস্তায় নামানোর জন্য প্রাইভেট সেক্টরকে নানা প্রণোদনা দিতে পারে। বাস কোম্পানি গঠন, রুট প্ল্যান, বাস স্টপ, বাসের রং নির্ধারণ করে দিতে পারে। ঢাকার জন্য যারা বড় বাস আমদানি করবে (দুই বছর), তাদের নানা আর্থিক প্রণোদনা (ঋণ, কর হ্রাস, আয়কর দুই বছর মওকুফ) দিতে পারে। রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও লক্কড়ঝক্কড় বাসের মালিকদের বাস আমদানির জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া যেতে পারে, যাতে তাঁরা ঢাকা শহরের মূল রাজপথে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা আর না চালান। রিকশা ও অটোরিকশার যাত্রীরা যেন প্রধান রাস্তার পাশে সব রকম গন্তব্যে বাসে করে যেতে পারে। পুরান ঢাকার জন্য কয়েকটি কোম্পানি করে নতুন ও পরিকল্পিত রুটে মাইক্রোবাস চালানোর ব্যবস্থা করা যায়। (বড় বাস সেখানে না চালানোই ভালো হবে।) ঢাকায় (এ মাথা থেকে ও মাথা, স্টপ, নন-স্টপ এক্সপ্রেস) পরিকল্পিত রুটে সীমিত কোম্পানির মাধ্যমে, এসি ও নন-এসি আধুনিক বাস চলাচল করলে আমাদের ধারণা ৫০ শতাংশ গাড়ির চলাচল কমে যাবে। পাশাপাশি নির্ধারিত স্থান ছাড়া গাড়ি পার্কিং করতে না দিলে, ‘নিষিদ্ধ’ জায়গায় গাড়ি পার্কিং করলে ন্যূনতম ৫০০ টাকা দণ্ড দিতে হলে, পার্কিং জোনেও এক বা দুই ঘণ্টার বেশি পার্কিং করলে ঘণ্টাপ্রতি টাকা দণ্ড দিতে হলে অনেকে কর্মদিবসে গাড়ি ব্যবহার করবেন না। শুক্র, শনি ও সরকারি ছুটির দিনে এসব শর্ত শিথিল করা যায়। এগুলো নতুন চিন্তা নয়। উন্নত দেশে এগুলো সবাই দেখেছেন। মন্ত্রী, সচিব, এমপিরাও দেখেছেন। কিন্তু তাঁরা বিদেশের এসব ভালো দৃষ্টান্ত নিজের দেশে বাস্তবায়ন করতে পারেননি। কেন পারেননি, সে কথা কোনো মন্ত্রী, সচিব ও এমপির মুখে কখনো শুনিনি।
সম্প্রতি উত্তর সিটির মেয়র আনিসুল হক বলেছেন, তিনি অচিরেই ঢাকায় ৫০০ বাস নামাবেন। তাঁর এই পরিকল্পনা বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে এটুকু বলতে পারি, বাস নামানো তাঁর কাজ নয়। তা ছাড়া সরকারি কোনো সংস্থা বাস না নামালেই ভালো হয়। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘সরকারের কাজ ব্যবসা করা নয়।’ আমরা বিআরটিসির ব্যর্থতা দেখেছি। মেয়র সাহেব তাঁর পরিকল্পনার কথা যোগাযোগমন্ত্রীকে বলতে পারেন, যাতে মন্ত্রী ঢাকায় ৫০০ বাস নামানোর জন্য একটা নীতিমালা ও প্রণোদনা ঘোষণা করেন। বাসের ব্যবসা করবে প্রাইভেট সেক্টর।
২. ঢাকার হকার-অধ্যুষিত ফুটপাত পর্যায়ক্রমে মুক্ত করতে পারলে অনেক নাগরিক রাস্তা ছেড়ে ফুটপাত দিয়ে চলাচল করতে পারবে। তবে তার আগে থানা পর্যায়ে হকারদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকা বরাদ্দ করতে হবে ঘণ্টা হিসেবে ভাড়া নিয়ে। সব হকারের দোকান হবে অস্থায়ী। তারও আগে হকারদের ফি দিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে। উন্মুক্ত জায়গা পাওয়ার ভিত্তিতে হকার-সংখ্যা নির্ধারণ হবে। এভাবে ছয় মাসের মধ্যে ঢাকার হকারবহুল সব ফুটপাত হকারমুক্ত করা সম্ভব। শুক্র ও শনিবার বড় মাঠে বা বিশেষ এলাকায় ‘হলিডে মার্কেট’ (হকারদের) বসার অনুমতি দেওয়া যায়। নাগরিকেরা ফুটপাত ব্যবহার করে হেঁটে কাছের গন্তব্যে যেতে পারলে অনেকে বাস, রিকশা বা অটো নিতে আগ্রহী হবে না। এতেও যানবাহনের ব্যবহার কিছুটা কমবে, রাস্তা পরিষ্কার হবে।
৩. গাড়ি পার্কিং ঢাকার একটি সমস্যা। পার্কিং সম্পর্কে ঢাকায় কোনো সরকারি নীতি নেই। শুধু কিছু জায়গায় ‘নো পার্কিং’ সাইন দেখা যায়। তবে ‘ইয়েস পার্কিং’ কোথায়, তা চিহ্নিত নয়। ঢাকার কোনো কর্তৃপক্ষ পার্কিং-নীতি ঘোষণা করেনি। এ ব্যাপারে একটা নীতিমালা ঘোষণা করা দরকার। ‘নো পার্কিং’ ও ‘ইয়েস পার্কিং’ চিহ্নিত করা দরকার। এই মুহূর্তে শহরে খালি জায়গায় অন্তত কুড়িটি বহুতল পার্কিং ভবন সরকারিভাবে তৈরি করা উচিত। জনবহুল, অফিসবহুল এলাকায় বহুতল পার্কিং ভবন তৈরি করতে হবে। ঘণ্টা হিসেবে ফি দিয়ে গাড়ি পার্কিং করতে হবে। সরকারের এই প্রকল্প সফল হলে একই মডেলে প্রাইভেট সেক্টরকে সরকারি জমিতে বহুতল পার্কিং ভবন তৈরির জন্য প্রণোদনা দিতে হবে। কোনো ব্যস্ত সড়কে গাড়ি পার্কিং করতে দেওয়া যাবে না। মতিঝিলে সিটি সেন্টারে গাড়ি পার্কিং করতে হবে। নিজের অফিসের সামনে বা পাশে গাড়ি পার্কিং নিষিদ্ধ করতে হবে। অনেক দূর হেঁটে পার্কিং জোনে গাড়িতে ওঠার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। বিভিন্ন গন্তব্যে আধুনিক এসি বাস রুট চালু হলে এমনিতে গাড়ি চলাচল হ্রাস পাবে। তাতে পার্কিং সমস্যাও হ্রাস পাবে।
৪. ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারে দিল্লির মতো জোড়-বেজোড় গাড়ি এক দিন পরপর চলাচলের নীতিটি ঢাকায়ও চালু করা যায়। তবে তার আগে ৫০০ নতুন বাস বিভিন্ন রুটে চালু করতে হবে। বিভিন্ন সরকারি অফিসে, সচিবালয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের (সচিবসহ) জন্য আধুনিক এসি মাইক্রোবাস (ছয়-সাতজন) দেওয়া যেতে পারে, যাতে এক যানবাহনেই ছয়-সাতজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এক অফিস ভবনে যাতায়াত করতে পারেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এভাবে চলাচল করেন। এতে তাঁদের সম্মানহানি হয়েছে বলে কেউ বলেননি।
৫. ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে গাড়ি ক্রয়ের ব্যাপারে একটা নীতিমালা করা দরকার। শহরের রাস্তায় কত গাড়ি চলতে পারে, তার সংখ্যা নির্ধারণ করতে হবে। এ রকম কয়েকটি স্বল্পমেয়াদি পদক্ষেপ নিলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের যানজট অনেকাংশে হ্রাস পেতে পাবে।
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, এই কাজগুলো কে করবে? আমাদের উত্তর: সরকার করবে। অনুমান করছি সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (ট্রাফিক পুলিশ ও পুলিশ), দুই সিটি করপোরেশন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (বাস আমদানির উদার ব্যবস্থা) প্রধানত এই কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে পারে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, এসব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীরা যদি এই উদ্যোগ নেন, তাহলে প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সহায়তা করবেন। তবে মন্ত্রীরা নিজের উদ্যোগে অনেকে কাজ করতে চান না। তাঁরা চান প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা। সে রকম সমস্যা হলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে কাজের তালিকাগুলো পৌঁছে দেওয়া যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সেভাবে নির্দেশনা দিতে পারেন। কে নির্দেশনা দিচ্ছেন, জনগণের কাছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। জনগণ চায় তাদের সমস্যার সমাধান হোক। দ্রুত হোক।
এসব পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে যদি ঢাকা ও চট্টগ্রামের যানজট হ্রাস পায়, তাহলে কৃতিত্ব পাবেন বর্তমান সরকার, প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর মন্ত্রী-মেয়ররা। বিএনপি বা কোনো বিরোধী দল এই কৃতিত্বের দাবিদার হবে না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।