যানজট ও চিকুনগুনিয়া-বৃত্তান্ত

পত্রিকার খবরে প্রকাশ, বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুসারে যানজটের কারণে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন ৩২ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, আর প্রতিবছর যে আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে অঙ্কের হিসাবে সেটা প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ঢাকায় এখন যানবাহনের গতি ঘণ্টায় সাত কিলোমিটার। এভাবে চললে আর কিছুদিন পর লোকজন হেঁটেই গাড়ি-ঘোড়ার আগে যেতে পারবে; কেননা ২০২৫ সালে ঢাকায় যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় গড়ে চার কিলোমিটার এবং মনে করা হয় যে মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় পাঁচ কিলোমিটার।

পত্রিকার পাতায় এ খবরটি পাঠ করে একাধিক কারণে আমি মনে মনে খুব কৌতুক বোধ করেছি।

প্রথমত, অনেক দিন আগে গল্প শুনেছিলাম: দক্ষিণবঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের লোকাল লাইনে ট্রেন এত মন্থর গতিতে চলত যে জনৈক যাত্রী চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে নেমে হেঁটে যেতে যেতে বলেছিলেন, ‘আমার একটু তাড়া আছে।’ আজকাল দেখা যাচ্ছে, সড়কপথেও এ ধরনের ঘটনা অহরহ ঘটছে ও ভবিষ্যতে ঘটতে থাকবে।

দ্বিতীয়ত, সেদিন তাহলে আর বেশি দূরে নয়, যেদিন মানুষ যন্ত্রদানবের কবল থেকে মুক্ত হয়ে আদি অকৃত্রিম পায়ে ভরসা করে হাঁটতে থাকবে; বিশেষ করে আমার মতো ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সেটা শাপে বরই হবে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সভ্যতার প্রতি’ শীর্ষক কবিতায় লিখে গেছেন, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর/ লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর/ হে নব সভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী!’ কবিরা স্বভাবতই ভবিষ্যদ্রষ্টা হয়ে থাকেন।

আর তৃতীয়ত, ‘বাংলাদেশ উন্নয়নগামী দেশগুলোর রোল মডেল’ এবং ‘এ দেশ শিগগিরই মধ্যম আয়ের দেশ হতে যাচ্ছে’ ইত্যাদি বলে যাঁরা অহর্নিশ জিগির তোলেন, তাঁরা নিশ্চয়ই ঢাকার ইদানীংকালের যানজটের কবলে খুব একটা পড়েন না। পড়লে তাঁরা এসব বলার পূর্বে খানিকটা চিন্তাভাবনা করতেন।

সে যাকগে। যানজট অবশ্য আজকাল দুনিয়ার প্রায় সর্বত্র। ব্যাংককে একসময় যানজটহেতু অনেকে প্লেন মিস করতেন বিধায় মোটরসাইকেল দ্বারা হেলিকপ্টার সার্ভিস নামক প্রথার প্রচলন হয়েছিল; ওরা বিস্তীর্ণ ফ্লাইওভার নির্মাণ করে সেটা সামাল দিয়েছে। লন্ডনে অফ-রোডগুলোতে ঘন ঘন স্পিডব্রেকার তৈরি করে শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলোকে যানজটমুক্ত রাখা হয়েছে। আর আমেরিকায় দেখে এলাম, ওরা যানজট কমানোর লক্ষ্যে মহাসড়কের সমান্তরালে প্রাইভেট সেক্টরে টোলযুক্ত বিকল্প রাস্তা তৈরি করেছে এবং শহরের জনবসতি এলাকার রাস্তাগুলোকে পর্যায়ক্রমে ‘ওয়ান ওয়ে’ করে দিয়েছে। সদিচ্ছা থাকলে উপায় একটা হয় বটে।

আমাদের দেশে কর্তাব্যক্তিরা অনেক সময় যানজট এড়ানোর লক্ষ্যে গাড়ি নিয়ে উল্টো পথে গমনাগমন করে থাকেন। এ প্রসঙ্গে বিলেতে একটি মজার গল্প আছে: একটি মেয়ে গাড়ি নিয়ে একমুখী রাস্তায় উল্টো পথে যাচ্ছিল। পুলিশ তাকে থামিয়ে দিতেই সে বলে উঠল, ‘আমাকে থামাবেন না, প্লিজ। আমার মনে হয় আমি আজ অফিসের জন্য রওনা দিতে দেরি করে ফেলেছি, কারণ সবাই অফিস শেষে বাড়ি ফিরে আসছে।’

 পত্রিকার খবরে আরও প্রকাশ, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাবের কারণে মশারির বিক্রি অনেক বেড়ে গেছে। বাজারে একধরনের নতুন মশারি বেরিয়েছে, যেগুলোর নাম দেওয়া হয়েছে ‘ম্যাজিক মশারি’। কেন, জানেন? এযাবৎকাল পর্যন্ত মশারির চালে মোটা মার্কিন কাপড় ব্যবহৃত হতো বিধায় ভেতরে সিলিং ফ্যানের বাতাস প্রায় ঢুকতই না, ফলে মশার কবল থেকে রক্ষা পেলেও গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যেত। নতুন এই মশারিগুলোর চালেও একই নেটের কাপড় দেওয়াতে সেই সমস্যাটি আর থাকছে না; তাই ওটার নাম দেওয়া হয়েছে ম্যাজিক মশারি। তা এই সহজ সমাধানটা বের করতে বাঙালির বহুকাল লেগেছে, বোধ করি হাজার বছর লেগেছে বলেই আমার মনে হয় যানজটের সমাধান খুঁজে পেতেও অন্তত হাজারখানেক বছর লাগবে। তত দিন আমরা কে কোথায় থাকব আল্লাহই ভালো জানেন।

তবে বাঙালির রসবোধ বরাবরই প্রখর, তাই চিকুনগুনিয়া প্রসঙ্গেও অনেক মজার মজার কথা পত্রপত্রিকায় বেরিয়েছে। পত্রিকান্তরে সমগোত্রীয় একজন লেখক একটি মজার কথা লিখেছেন। সেটা আমার খুব ভালো লেগেছে বিধায় প্রথম আলোর পাঠকদের উদ্দেশে এ স্থলে সামান্য সম্পাদনাসহ উপস্থাপন করছি:

চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে পরে হাত-পায়ের অস্থিসন্ধিগুলোতে বেদনা হয় বিধায় উঠতে-বসতে খুব কষ্ট হয়। কাজেই বিবাহিত পুরুষদের মধ্যে যাঁরা স্ত্রৈণ তাঁরা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে অধিকতর কষ্টের মধ্যে আছেন। কারণ, তাঁদের তো বরাবরের মতোই স্ত্রীর কথায় উঠতে-বসতে হচ্ছে।

শেষ করতে চাই যানজট সম্পর্কিত একটি প্রাসঙ্গিক চুটকি দিয়ে: একটি মেয়ে একা গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিল, যানজটে নাকাল হয়ে একসময়ে সামনের গাড়িকে একটা ধাক্কা মারতেই পুলিশ এসে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখতে চাইল। অতঃপর লাইসেন্সটি চেক করে পুলিশ তাকে বলল, ‘লাইসেন্স অনুসারে তো দেখা যাচ্ছে গাড়ি চালানোর সময় আপনার চশমা পরা উচিত, অথচ আপনি চশমা ব্যতিরেকেই গাড়ি চালাচ্ছেন।’

‘আমার কন্ট্যাক্ট আছে’, মেয়েটি বলে উঠল।

মেয়েটি বোঝাতে চাইছিল যে তার চোখে কন্ট্যাক্ট লেন্স আছে; কিন্তু পুলিশ সার্জেন্ট ভাবলেন সে বোঝাতে চাইছে উঁচু মহলে তার যোগাযোগ আছে। তিনি খেপে গিয়ে বললেন, ‘আপনার কী কন্ট্যাক্ট আছে, আমি সেটার পরোয়া করি না। আপনাকে আইন অমান্য ও ভুল করার জন্য অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে।’

পুনশ্চ: নিউইয়র্ক সম্পর্কে বলা হয়, এ সিটি দ্যাট নেভার স্লিপস (একটি নগরী, যা কখনো ঘুমায় না)। সেদিন মধ্যরাতে ঢাকার অফিসার্স ক্লাব থেকে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে বাসায় ফেরার পথে আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, বর্তমানে আমাদের ঢাকাও এ ব্যাপারে বোধ করি খুব একটা পিছিয়ে নেই।

আতাউর রহমান: রম্যলেখক৷ ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক৷