এক অনিশ্চিত যাত্রায় চলেছে পৃথিবী। কারও জানা নেই কোথায় এর শেষ। করোনাভাইরাস সামাল দেওয়ার টিকা-ইনজেকশন নিয়ে নানা কথা নানা দিক থেকে বলা হলেও মানুষ মনে হয় এখন আর এসব আশ্বাসে আস্থা রাখতে পারছে না। কোথা থেকে এই খুনি ভাইরাসের শুরু, সে বিতর্কে না গিয়েও পরিষ্কারভাবে যা বলা যায়, তা হলো এর সূচনার জন্য আমরা মানবজাতি সার্বিকভাবে দায়ী। ফলে এর সমাপ্তি টানতে হলে মানবজাতি হিসেবেই সম্মিলিতভাবে আমাদের কাজ করে যেতে হবে, বিচ্ছিন্ন ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হয়ে নয়।
প্রায় ছয় মাস ধরে আমরা শুনছি আজ এই কোম্পানি করোনার টিকা নিয়ে এগিয়ে তো কাল একে পেছনে ফেলে অন্য এক কোম্পানি সামনে এগিয়ে যাচ্ছে। এ যেন অলিম্পিকের ম্যারাথন দৌড়ে পাল্লা দেওয়া। তবে ম্যারাথন দৌড়ের সঙ্গে পার্থক্য হলো সংবাদমাধ্যমে এসব প্রচারের ফলে বাস্তবে অগ্রগতির দেখা না পাওয়া গেলেও কোম্পানির শেয়ারমূল্য ধাই ধাই করে উঠে যাচ্ছে ওপরের দিকে। আর এই অগ্রযাত্রার কেন্দ্রে যে মানুষের থাকা উচিত, সে মানুষ এখনো সূচনার সেই তিমিরে আটকা পড়ে আছে। বুঝে উঠতে পারছে না কোথায় আমাদের নিয়ে যাচ্ছে এই অদৃশ্য ভাইরাস।
বিশ্বের সবচেয়ে অগ্রসর বলে দাবিদার দেশ যুক্তরাষ্ট্রে কোভিডে মৃত্যুর মিছিলে যোগ দেওয়া মানুষের সংখ্যা আড়াই লাখ ছাড়িয়ে গেছে। সভ্যতার আরেক কর্ণধার ইউরোপের অবস্থাও খুব বেশি ভালো নেই। ভালো নেই আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা আর এশিয়া মহাদেশও। জাপান মৃত্যু ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হলেও বলা হচ্ছে তৃতীয় একটি তরঙ্গ এখন দরজায় করাঘাত করছে। কতজনকে নিয়ে যেতে সে আসছে, তা বলার উপায় নেই। ধনীর অবস্থা যদি এই হয়, দরিদ্রের ভাগ্যে কী রয়েছে, তা বলা কারও পক্ষেই সম্ভব নয়। একমাত্র ভাগ্যের হাতে নিজেকে ছেড়ে দেওয়া ছাড়া দরিদ্রের সামনে মনে হয় আর কোনো পথ খোলা নেই।
পৃথিবীতে যতবার মহামারি আর প্রাণঘাতী অসুখ আঘাত হেনেছে, ঠিক ততবারই দেখা গেছে ওষুধ কোম্পানিগুলোর আগ বাড়িয়ে ‘মানবসেবায়’ নিজেদের নিয়োজিত করা প্রতিযোগিতা। তবে এর পেছনে যে টাকাপয়সার হিসাবের বাইরে অন্য কিছু নেই, সেটা মনে হয় বিগত মাসগুলোয় অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে এসেছে। বড় বড় ওষুধ কোম্পানি আবার যেহেতু বিজ্ঞাপনদাতা হিসেবে সংবাদমাধ্যমের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক, ফলে সংবাদমাধ্যমও এ খেলায় পিছিয়ে নেই। চীন কিংবা রাশিয়া যতই চালিয়ে যাক না কেন, তাদের গবেষণা, পশ্চিমের বিজ্ঞাপনী অর্থে পুষ্ট সংবাদমাধ্যম দুই দেশকেই হেয় করার জন্য যেন ওষুধ কোম্পানির হয়ে লড়ছে। তুলাধোনা করছে চীন ও রাশিয়ার বিজ্ঞান গবেষণা কার্যক্রমকে।
কারণ বুঝে নিতে আমাদের তো অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। বাতাসে এখন টাকা গন্ধ ছড়াচ্ছে। বিশ্বের সব কটি ধনী দেশ হয় পশ্চিমের ওষুধ কোম্পানিকে টিকা কেনার জন্য আগাম টাকাপয়সা দিয়ে বসে আছে, অথবা প্রতিশ্রুতির ঝোলা দিনকে দিন ভারী করে তুলছে। ফলে সেই টাকায় অন্য কেউ যেন ভাগ বসাতে না পারে, সেদিকে ওষুধ কোম্পানিগুলো খুবই সচেতন। এই সচেতনতা থেকেই সংবাদমাধ্যমের সহায়তায় তারা শামিল হচ্ছে অন্যকে হেয় করার লড়াইয়ে।
মাত্র অল্প কিছুদিন আগেও কিন্তু ওষুধ নিয়ে মুনাফার এই খেলা আমরা লক্ষ করেছি। মরণব্যাধি এইডস আফ্রিকা মহাদেশজুড়ে তোলপাড় তোলা আঘাত হানার পর ওষুধ আবিষ্কার হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও সেই ওষুধ আফ্রিকা কিংবা পিছিয়ে পড়া অন্যান্য অঞ্চলকে দিতে তারা রাজি হয়নি। রাজি হলেও যে মূল্য তারা হেঁকেছে, আফ্রিকার দরিদ্রদের পক্ষে সেই মূল্য পরিশোধ করতে পারা ছিল একেবারেই অসম্ভব। জাতিসংঘ এবং বিশ্বের অন্য বেশ কিছু সংগঠনের দীর্ঘ সময় ধরে চালানো সক্রিয় দেনদরবারের শেষেই কেবল দরিদ্রদের জন্য এইডসের ওষুধের চালান পাঠানো সম্ভব হয়েছিল। তত দিনে অবশ্য পশ্চিমের দেশগুলোয় এইডসকে বাগে আনা সম্ভব হয়ে ওঠায় ওষুধের চাহিদায় পতন শুরু হলে কোম্পানিগুলো তাদের ‘বদান্যতার’ দুয়ার দরিদ্রের জন্য খুলে দিয়েছিল।
এবারও আমরা একই খেলা দেখছি করোনাভাইরাসের টিকাকে ঘিরে। টিকা এই আসছে, এই আসছে বলে ধুয়া তুলে একদিকে তারা যেমন টিকার দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি শেয়ারবাজারেও নিজেদের অবস্থান পোক্ত করে নিচ্ছে, অন্যদিকে আবার আগাম ওষুধ বিক্রি করে জানান দিয়ে দিচ্ছে যে বিনা পয়সার পণ্য এগুলো নয়, এমনকি লাখ লাখ মানুষ মরে গেলেও নয়। ফলে করোনাভাইরাস শেষ পর্যন্ত কোথায় আমাদের নিয়ে যাবে, তা কিন্তু বলে ওঠা মুশকিল।
দ্রুত মুনাফার সন্ধানে অল্প সময়ের মধ্যে টিকা আবিষ্কারের বিপজ্জনক দিক হচ্ছে এ রকম যে দীর্ঘমেয়াদি সময়ে এসব টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, তা না জেনেই প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ছি অজানা সেই সাগরে। আমাদের এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখে নিশ্চয় হাসছে করোনা জীবাণু। মানুষের প্রাণ বধের জন্য এত কিছু আমরা করে ফেললাম, অথচ ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর হাত থেকে এমনকি নিজের দেশের মানুষকে রক্ষা করতেও আমরা এখন অপারগ। এটাই বোধ হয় হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর উভয়সংকট, যা আমাদের বলে দিচ্ছে, এখন সময় হয়েছে নতুন করে চিন্তাভাবনা শুরু করার, যে চিন্তাভাবনার মূলে থাকবে মানুষের প্রাণ হরণ নয়, বরং মানুষকে কীভাবে বাঁচানো যায়, সেই হিসাব–নিকাশ। কেননা, করোনার সংক্রমণ আরও যে নিষ্ঠুর বাস্তবতার মুখোমুখি আমাদের দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে, তা হলো রোগ যেহেতু মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ার মতো সাফল্য অর্জন করে ফেলেছে, ফলে এখন আর সময় নেই কে ধনী, কে দরিদ্র, কে কালো, কে সাদা—সেসব হিসাব–নিকাশ করার। করোনা তো আঘাত হানছে সেই হিসাব না করেই। তবে আমরা কেন পারব না চলমান সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে গিয়ে পুরো মানবজাতিকে একক হিসেবে ভেবে নিতে? বাক্যটি সহজ শোনালেও এর বাস্তবায়ন খুবই কঠিন। ফলে করোনাই হয়তো তৈরি করে দিতে পারে সে রকম এক সমতল ভূমি। তবে তার আগে বড় এক মূল্য যে সে আদায় করে নেবে, তা মনে হয় প্রায় নিশ্চিত।
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক