যদি সম্মানটাও যায়, শিক্ষক কি আর শিক্ষক থাকবেন?

১৯৯৪ সাল। আমি মাত্র শিক্ষকতা পেশায় ঢুকেছি। এক সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নিউমার্কেটের ‘ডায়মন্ড’ রেস্তোরাঁয় আমার দুই বন্ধুর আমন্ত্রণে চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য দ্রব্যাদির সদ্ব্যবহার করে তৃপ্ত শরীরে বাইরে এসে অলস পায়ে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছি। আমার দুই বন্ধুই কীর্তিমান। আমার মতো সদ্য চাকরিতে ঢুকেছেন। একজন কর বিভাগে এবং আরেকজন শুল্ক বিভাগে। সদ্য চাকরি পাওয়ায় আমাদের সবার মেজাজই ফুরফুরে। স্বাভাবিকভাবেই কার চাকরি কেমন, তা নিয়ে গল্প উঠল। আমি লক্ষ করলাম, চেষ্টা করেও সেই গল্পে ঢুকে আমি খুব একটা সুবিধা করতে পারছি না। ওরা দুজনই গর্ব, খুশি আর প্রাপ্তিতে উদ্বেলিত। কী করলে কী পাওয়া যায়, কার কত সুযোগ-সুবিধা, কার ক্ষমতার স্বাদ কত মজার—এসব বলতে বলতে ক্রমাগত ওদের কণ্ঠ উচ্চকিত আর বক্ষ বিস্ফারিত হচ্ছে।

এদিকে আমি ওদের কথা শুনছি, ওদের সঙ্গে নিজের তুলনা করছি এবং ক্রমাগত নিশ্চুপ ও সংকুচিত হচ্ছি। এমন সময় কোত্থেকে এক বিশালদেহী তরুণ হুড়মুড় করে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল, একগাদা লোকের সামনে অনেক কষ্টে মাথা নুইয়ে দোয়া পাওয়ার আশায় আমার পা ছুঁয়ে সালামটাও সেরে ফেলল। ওর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছিল, জনাকীর্ণ সেই শপিং মলে আমি ছাড়া কোথাও কেউ নেই। ওর দৃষ্টি, কণ্ঠ আর দেহভঙ্গি যেন অন্য সবকিছুকে মুহূর্তে লুপ্ত করে দিল। দেখলাম সে আমার রাঙামাটি কলেজের ছাত্র। আমার এখনো মাঝেমধ্যে মনে হয়, ওই দিন যদি ওই ছাত্রের হঠাৎ উদয় না হতো, আমি হয়তো আমার বন্ধুদের সাফল্য, আনন্দ ও চমকে চমকিত হয়ে হন্যে হয়ে অন্য চাকরির পেছনে ছুটতাম।

যা–ই হোক, এরপর কী হলো, তা সহজেই অনুমেয়। আমার ওই দুই বন্ধু একটু মিইয়ে গেল। আলাপ আর তেমন জমল না। বাসায় ফেরার সময় খেয়াল করলাম, আমি নিজের অজান্তেই মাথা উঁচু করে হাঁটছি। কারণটা হলো সম্মান। টাকাপয়সা, ক্ষমতা-প্রতিপত্তি, জাঁক-জৌলুশ সবকিছু ছাপিয়ে ওই তরুণের সম্মান প্রদর্শন আমার মাথাকে আকাশছোঁয়া করে দিয়েছিল। আমার সৌভাগ্য, এরপর আমি যত দিন শিক্ষকতা করেছি—দেশে কিংবা বিদেশে—আমাকে কখনো মাথা নিচু করতে হয়নি। মাথা নিচু করতে হলে হয়তো আমি আর শিক্ষকতা করতে পারতাম না বা বাধ্য হয়ে চাকরি করে গেলেও একজন শিক্ষক হয়ে ওঠা হতো না।

শুধু আমি কেন, মাথা নিচু করে কাজ করতে হলে কারও পক্ষেই সত্যিকারের শিক্ষক হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। একজন শিক্ষক নিজের জ্ঞান-গরিমা, চলন-বলন, নীতি-নৈতিকতায় শুধু নয়, সমাজের দৃষ্টিতেও যত উঁচুতে উঠবেন, তিনি তত বড় শিক্ষক হবেন। এত দিন সেটাই হয়ে আসছে, ভবিষ্যতেও তা–ই হবে। এটা জানতেন বলেই কবি কাদের নেওয়াজের কবিতায় বাদশাহ আলমগীর ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’-কে এত গুরুত্ব দিয়েছেন। আমি জানি অনেকেই আছেন যাঁরা ভাবছেন, এখনকার আবার শিক্ষক! তঁার না আছে জ্ঞান, না আছে চলন-বলন আর নীতি-নৈতিকতার কথা তো বাদ-ই দিলাম, তাঁকে আবার সম্মান! শুধু ভাবলেও একটা কথা ছিল, অনেককে দেখে মনে হচ্ছে, শিক্ষককে অসম্মান করে বীরত্ব জাহির করার মধ্যেও একটা বাহাদুরি আছে; অসহায় শিক্ষককে বিব্রত, অপমান, ও অপদস্থ করেও উল্লাস করা যায়। সাম্প্রতিক কালে যেসব ঘটনা পত্রপত্রিকায় আসছে—শিক্ষককে কান ধরে ওঠ-বস করানো, তাঁকে কারও পায়ে হাত দিয়ে মাফ চাইতে বাধ্য করা, জেলে পাঠানো, জুতার মালা গলায় পরিয়ে জনসমক্ষে হাঁটিয়ে নেওয়া, এমনকি পিটিয়ে মেরে ফেলা—সেসব তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু লোকচক্ষুর আড়ালে প্রতিনিয়ত কিছু কিছু ম্যানেজিং কমিটির সদস্য বা ক্ষমতাবান মানুষের যে দাপট তাঁদের সহ্য করতে হয়, আমাকে অনেক শিক্ষক বলেছেন, তা অসহনীয়।

শিক্ষকেরা ফেরেশতা নন। একেবারে শেষ সম্বল না হোক, তাঁদের সবচেয়ে বড় যে সম্বল, সেই সম্মান যদি তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, এ ধরনের প্রতিশোধ নেওয়ার অপরাধ তাঁরা করতেই পারেন। তার জন্য তাঁদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তবে অন্য সব ক্ষেত্রে যেমন নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়াটা অপরাধ, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও সেটা মানতে হবে। একদিকে তাঁদের ওপর ইচ্ছেমতো যত্রতত্র যেমন তেমন শাস্তি আরোপ করা, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতাদিতে পিছিয়ে রাখা আর অন্যদিকে তাঁদের কাছ থেকে গুণগত শিক্ষা দান আশা করা সোনার পাথরবাটির চেয়ে কম হাস্যকর নয়।

শিক্ষকদের এভাবে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা চলতে থাকলে কিছুদিন পর দেশে আর শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যাবে না। অন্য কোথাও যাওয়ার সুযোগ নেই বলে কেবল বেতনভুক কর্মচারী হিসেবে তাঁরা হয়তো ক্লাসরুমে যাওয়া-আসা করবেন, কিন্তু গুণগত শিক্ষা দেওয়ার তাগিদ, শক্তি বা সদিচ্ছার কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট থাকবে না। এতে ক্ষতির মাত্রা যে কত বেশি হতে পারে, সেটা আন্দাজ করার জন্য নিচের ছোটগল্পটিই যথেষ্ট।

বহুদিন আগে কোনো এক নিরক্ষর গ্রামে কোথা থেকে এক শিক্ষক এসে বাচ্চাদের পড়ানো শুরু করলেন। একদিন সেই গ্রামের বুদ্ধিমান মাতবর ভাবলেন, ওই ব্যাটা মাস্টার তো অসহায় বলেই এখানে আছে। ওকে এত বেতন দিয়ে কী হবে! বেতন কমিয়ে দিলেন। দেখলেন, কোনো অসুবিধা নেই। ও আছে, পড়াচ্ছে। তাহলে তো আরও কমানো যায়; কমালেন। তা–ও যায় না। এরপর মাতবর ভাবলেন, ওকে আসলে বেতন না দিলেও হবে। চাল, ডাল, লাউ, মুলা দিলেই ওর দিব্যি চলে যাবে। তা–ও চলল কিছুদিন। কিন্তু একদিন হঠাৎ সেই শিক্ষক উধাও। কী আর করা! অন্য এক শিক্ষককে ধরে আনা হলো। তিনি একদিন পড়িয়েই আগের শিক্ষক প্রথম যে বেতন পেতেন, তার তিন গুণ দাবি করে বসলেন। কেন? কারণ, এ গ্রামের শিশুরা সব অক্ষর উল্টো করে লেখে। আগের শিক্ষক এভাবেই নীরবে তাঁর অপমান ও বঞ্চনার প্রতিশোধ নিয়ে গেছেন।

শিক্ষকেরা ফেরেশতা নন। একেবারে শেষ সম্বল না হোক, তাঁদের সবচেয়ে বড় যে সম্বল, সেই সম্মান যদি তাঁদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, এ ধরনের প্রতিশোধ নেওয়ার অপরাধ তাঁরা করতেই পারেন। তার জন্য তাঁদের অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে। তবে অন্য সব ক্ষেত্রে যেমন নিজের হাতে আইন তুলে নেওয়াটা অপরাধ, শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও সেটা মানতে হবে। একদিকে তাঁদের ওপর ইচ্ছেমতো যত্রতত্র যেমন তেমন শাস্তি আরোপ করা, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ও বেতন-ভাতাদিতে পিছিয়ে রাখা আর অন্যদিকে তাঁদের কাছ থেকে গুণগত শিক্ষা দান আশা করা সোনার পাথরবাটির চেয়ে কম হাস্যকর নয়।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক