যদিও করোনাকাল, তবুও স্বপন কার...

স্রোতে যেমন শেওলা ভাসে, তেমনি করে ভাসতে ভাসতে বছর দশেক আগে ছোট্ট স্বপন এসেছিল হাজেরা মায়ের কাছে। আর তারই খোঁজে সোমবার আমি ঢাকার আদাবরের শেষ প্রান্তে পৌঁছাই।

সেখানে বেড়িবাঁধের কাছাকাছি রাস্তাজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। পেছনের গরিব গলিতে মলিন তিনতলা বাড়ি। একতলা-দোতলার ঘরে ঘরে খেটে খাওয়া মানুষ ভাড়া থাকেন। ওপরের তলায় ‘শিশুদের জন্য আমরা’ সংগঠনের আশ্রয়কেন্দ্র।

লাল সিমেন্টের চলটা ওঠা এবড়োখেবড়ো সিঁড়ির দখল নিয়েছে গা-ভর্তি-ঘা রাস্তার কুকুরটা। তিনতলার দরজার মুখে স্বপনকে নিয়ে এসে দাঁড়ান ৪৫ ছেলেমেয়ের মা হাজেরা বেগম।

এই ছেলের কথা জানতেই আমি এসেছি। কেননা, সেটা জীবনের কথা। এই করোনাকালেও সে জীবনকে চলতে হয়। তার দাবি থাকে।

ছেলেটা হাজেরা আম্মুর হাতের বেড়ি ভেঙে ছুট দিতে চায়। হাসিমুখে এদিক-ওদিক তাকায়। গলা চিরে আঁ আঁ চিৎকার করে।

দরজায় মা ও ছেলে।

ভেতরে ঢুকি। টিনের চালা বড় ঘরের মতো বারান্দা। একটা গোল টেবিল, কয়েকটা প্লাস্টিকের চেয়ার। এক কোনায় ছাদের নিচে কবুতরের খোপ।

হাজেরা ফাইল খোলেন। ২০০৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আখাউড়ায় লালবাজার বটতলা এলাকায় হাফপ্যান্ট আর সবুজ গরম জামা পরা চার-পাঁচ বছর বয়সী ছেলেটা ঘোরাঘুরি করছিল। অসুস্থ, ডান হাতের কড়ে আঙুলের মাথাটা কাটা।

বুদ্ধি ও বাক্‌প্রতিবন্ধী শিশুটিকে স্থানীয় লোকজন একটি ক্লিনিকে নেয়। পরদিন এলাকাবাসী মোহাম্মদ আলীর বাসায় তার ঠাঁই হয়।

হাজেরা তখন ঢাকার ভাসমান যৌনকর্মীদের সংগঠন দুর্জয় নারী সংঘের শিশুযত্ন প্রকল্পের পরিচালক। যৌনকর্মীদের বাচ্চাদের জন্য দুর্জয়ের আশ্রয়কেন্দ্র ছিল। প্রথম আলোয় মানসুরা হোসাইনের একটি রিপোর্ট পড়ে মোহাম্মদ আলী একবার বাচ্চাদের জন্য চাল কিনে এনেছিলেন।

আখাউড়া থানায় জিডি করে ‘আলীভাই’ ছেলেটাকে হাজেরার কাছে দিয়ে যান। অন্য বাচ্চারা তার নাম রাখে স্বপন।

হাজেরার মনে আছে, স্বপন গুঙিয়ে ডাক ছাড়ত, ‘ভাত দে, আল্লাহ ভাত দে!’ এ ছাড়া, টাক টাক টাক টাক একটা আওয়াজ তুলে বলত ‘আ-আ-আলিয়া’—‘আর ও দৌড়াত। পেশাব পড়ত। হাঁটত, পায়খানা পড়ত।’

ঝাল কি তিতা বুঝত না স্বপন—‘যত ঝাল দিত, ভাতের মতো ওগুলা খাইত। নিমপাতা নিয়ে খাইত। খাওয়াটা এমন ছিল যেন, খুব ভালো একটা খাবার খাচ্ছে।’

হাজেরারা ওকে ডাক্তার দেখান, যত্ন করেন। নিয়মিত ভাত পেয়ে ছয় মাসের মাথায় স্বপন ঝাল-তিতা ছাড়ান দেয়।

তারপর তহবিল সংকটে দুর্জয়ের চাইল্ডকেয়ার সেন্টার বন্ধ হয়ে যায়। কিছু বাচ্চাকে মায়েদের কাছে, কিছু বাচ্চাকে আরেকটি এনজিওর হোমে পাঠানো হয়। স্বপনের যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না।

দুর্জয়ের সেন্টারে শিশুদের নানা কিছু শেখাত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছেলেমেয়ে। সমমর্মী আরও মানুষ ছিলেন। সবার সহযোগিতায় নিজের সারা জীবনের সঞ্চয় ভেঙে হাজেরা দ্রুত সাভারের এক ভাড়া বাসায় আজকের সংগঠন আর সেন্টারটি প্রতিষ্ঠা করেন।

সেটা ২০১০ সালের জুলাইয়ের কথা। মায়েরা কিছু বাচ্চাকে দিয়ে যান। আর দুর্জয়ের আয়া জ্যোৎস্না বেগম একদিন কোলে করে স্বপনকে নিয়ে চলে আসেন। অযত্নে-অবহেলায় স্বপন তখন হাড্ডিসার, গা-ভর্তি ঘা।

পরের বছর সেন্টার আদাবরে আসে। স্বপন বড় হতে থাকে। কিন্তু তার পায়খানা-পেশাব নিয়ন্ত্রণের জ্ঞান হয় না। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা গোঙানির বাইরে কথা ফোটে না। খাওয়া দিতে দেরি করলে, সবজি পাতে দিলে প্রচণ্ড রেগে ‘ক্কী! ক্কী!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠে।

ও কিন্তু সেন্টারের সকলকে চেনে। চেনে নিজের এবং অন্য সবার ভাতের থালা। হাজেরা বলেন, ‘পেট ভইরা খাওয়াইয়া যদি ওকে দেন, তবুও একটু পরে কইবে, ভাত দে।’

স্বপন হাজেরাকে ভালোবাসে।

আমরা কথা বলার সময় চানাচুর আর দামি চিপসের আকর্ষণে আবার বারান্দায় আসে স্বপন। দুচোখ বন্ধ করে হাসিতে মুখ কুঁচকে হাজেরার গালে চুমু খায়। তারপর বাটি কোলে চেয়ারে বসে একমনে চানাচুর খায়।

হাজেরা চাইলে স্বপন ওর হাতের তালুতে একটুখানি তুলে দেয়। তারপর হাতটা টেনে নিয়ে নিজের মুখে খাবারটা ঢেলে দিয়ে মিটিমিটি হাসে। দেখাতে বললে ঘিয়া রঙের আঁটসাঁট শার্টের বোতামের ফাঁক দিয়ে বেরোনো পেট আর কালো চুলে ভরা মাথা দেখিয়ে দেয়।

বড় বড় চোখের পাপড়ি ওর ফরসা গালে ছায়া ফেলে। নাক দিয়ে সর্দি গড়ালে সেন্টারের বড় ছেলে রবিন তা যত্ন করে মুছিয়ে দেয়। বলে, ‘স্বপন তো আমার ভাই!’ একটু পরে দেখি হাজেরার ঘরে টিভির সামনে এক দঙ্গল বাচ্চার মধ্যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে।

নিজেকে বাঁচাতে পারে না স্বপন।

নিজেকে সামলে চলার জ্ঞান নেই। খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে দেওয়ালে ঘষা লেগে কপাল-গাল ছিলে গেছে। হাজেরা বলেন, একবার সিঁড়ি থেকে পড়ে ঊরু ভেঙে ফেললে সাড়ে ছয় মাস স্বপনকে নিয়ে হাসপাতালে ছিলেন।

একটি এনজিওর বিশেষ স্কুলে যেত স্বপন। এখন বিশেষ শিশুদের জন্য পরিচালিত আরেকটি এনজিওতে থাকে। তাকে লম্বা ছুটিতে নিয়ে এসেছেন হাজেরা।

বললেন, ‘ওকে কিছু শিখানোর জন্য দিছিলাম। তেমন কিছু শেখেনি। আগে যে কথাগুলো বলত, ডাকত আমাদের, এগুলা ভুলে গেছে।’ শরীরে কালো দাগ ছিল। ওখানে নাকি বাচ্চারা মারপিট করে।

জন্মসনদে স্বপনের মায়ের নাম হাজেরা বেগম। বাবা মনু ফকির। সেটা হাজেরার দাদার নাম। এই সেন্টারে মনু ফকিরের সন্তান অনেক।

মনু ফকিরের সন্তান।

হাজেরা নিজে শিশুকাল থেকে রাস্তায় বড় হয়েছেন। একটা সময় যৌনকর্মী হতে হয়েছিল। রাস্তায় থাকা শিশুদের, বিশেষ করে যৌনকর্মীর বাচ্চাদের বিপদগুলো তিনি জানেন।

হাজেরার এই সেন্টার এমন সহায়হীন শিশুদের জন্য। তাঁর সঙ্গে এখানে থাকে ৩৫ জন। একেবারে শিশু ছাড়া সবাই স্কুলে পড়ে। একটু বড়রা বাইরে থেকে পড়ে, কাজ করে। মোট ৪৫ জনের আম্মু তিনি।

সংগঠনটিতে বিদেশি বা সরকারি সাহায্য নেই। হাজেরার কথা, ‘আমাদের দেশে যে ভালো মানুষগুলা আছে না? তাদের সহযোগিতায় চলে।’

সাহায্য করেন ব্যক্তি, কিছু সংগঠন আর ট্রাস্ট। কেউ চাল দেন, কেউ দুধ। কেউ বাড়িভাড়ার টাকায়, কেউ লেখাপড়ার খরচে হাত মেলান। সীমিত সাধ্য, কিন্তু ব্যবস্থাপনা পাকা।

স্বপন মায়ায় বেঁধেছে।

স্বপন এখানে একমাত্র প্রতিবন্ধী। কিন্তু হাজেরা বলেন, সবার আগে সে একজন মানুষ—‘মানুষ হয়া একজন মানুষকে তো আর ফেলে দেওয়া যায় না!’

তা ছাড়া, স্বপনকে দেখেই খুব মায়া লেগেছিল—‘ওর মুখের দিকে তাকায়া আমি বলতে পারি নাই যে না, আমি রাখব না। ...ওর হাসিটা দেখছেন? স্বপনের হাসি খুব সুন্দর। স্বপনের চোখটা খুব সুন্দর। স্বপনকে খুব ভালো লাগে। আমাদের প্রতিটি বাচ্চা খুব ভালোবাসে।’

এত বছরে কেউ স্বপনের খোঁজ করেনি। হাজেরা বলেন, আল্লাহ ছাড়া ওর তো কেউ নেই! নিজের রোজকার কাজগুলো করতে শেখানোর ভালো কোনো জায়গায় যদি ওকে দেওয়া যেত!

কেউ বড় ভাই, কেউ বন্ধু।

পাড়া-প্রতিবেশী কেউ কেউ বলেছিল ফেলে দিতে। হাজেরা বলেন, ‘স্বপনরে যদি আমি ছেড়ে দিই রাস্তায়, ও কী করবে আপা? খাবার দেখলেই চায়। কেউ মারবে। রাস্তাঘাটে হর্ন বোঝে না।’

স্বপনের ভবিষ্যৎ ভেবে কূলকিনারা পান না হাজেরা, কিন্তু তিনি দুর্জয় সাহসী, হাল ছাড়তে জানেন না।

কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা: বিশেষ বার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো
qurratul.tahmina@prothomalo.com