যৌনকর্মীর সরদারনীদের সম্ভ্রম জানিয়ে ‘ম্যাডাম’ নামে ডাকা হয়। হাইডি ফ্লেইস সে রকমের একজন ম্যাডাম। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে হলিউডের ‘হাই সোসাইটির’ এই যৌনকর্মী সবার ঘাম ছুটিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই তাঁকে এখনো হলিউড ম্যাডাম নামেই চেনে। দেশের নামীদামি সব মানুষ তাঁর খদ্দের ছিলেন। হলিউডের খ্যাতিমান তারকা থেকে জাতীয় পর্যায়ের মস্ত রাজনীতিক, সবাই একসময় তাঁর দ্বারস্থ হয়েছেন। আরব বাদশাহজাদারা তাঁর সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন। বানানো গল্প নয়, প্রমাণ হিসেবে তাঁদের প্রত্যেকের নামধামসহ তাবৎ তথ্যের একটি কালো রঙের নোট বুক রয়েছে তাঁর। কবে কে তাঁর দরজায় এসে কড়া নেড়েছে, ফুর্তি কিনতে কাকে কী পরিমাণ রেস্ত ঢালতে হয়েছে, সব পাক্কা অ্যাকাউন্ট্যান্টের মতো লিপিবদ্ধ করা ছিল সে খাতায়। কর ফাঁকি দেওয়ার অভিযোগে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর হাইডি ঘোষণা করেছিলেন, জোরাজুরি করলে নোট বইয়ের সবার নাম তিনি ফাঁস করে দেবেন। এ কথা শোনার পর কত রাঘববোয়ালকে কত রাত নির্ঘুম কাটাতে হয়েছে, তা বোঝা খুব কঠিন নয়।
কিছুদিন হলো আমাদের এক ম্যাডাম ধরা পড়েছেন। নাম পাপিয়া। তাঁরও রয়েছে একটি ‘কল লিস্ট’, তাতেও সবার নামধাম। এই তালিকায় যাঁরা রয়েছেন, অনুমান করি, তাঁদের অধিকাংশই সমাজের নামীদামি লোকজন। শোনা যাচ্ছে, বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতা, আইন সভার সদস্য ইত্যাদি সমাজের সব রাঘববোয়াল ঢাকার এক পাঁচতারকা হোটেলে স্বনামে-বেনামে আসতেন তাঁর সাজানো মধু খেতে। তবে পাপিয়াকে শুধু ম্যাডাম বলে পরিচয় দিলে অন্যায় হবে। পুলিশের হাতে ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন ক্ষমতাসীন দলের একটি অঙ্গসংগঠনের জেলা পর্যায়ের নেতা। তিনি একা নন, তাঁর স্বামীও। সহযোগী হিসেবে তাঁরা সঙ্গ পেয়েছিলেন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের। এখন যদিও ‘চিনি না জানি না’ বলে তাঁরা দূরত্ব বজায় রাখতে চাইছেন, এই নেতাদের সঙ্গে পাপিয়ার রঙিন ছবি পত্রপত্রিকা ও ইন্টারনেটে সয়লাব। তাঁর সঙ্গে গায়ে গা মিলিয়ে কারও হাসি হাসি ছবি, আবার কারও হাতে পাপিয়ার দেওয়া ফুলের তোড়া। জানা গেছে, দুই সাংসদের ঘাড়ে হাত রেখে পাপিয়া ও তাঁর স্বামী সমাজে আসন করে নিয়েছিলেন।
মেয়ে মানুষের কেচ্ছা নিয়ে আমাদের উৎসাহের অন্ত নেই। পাপিয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। আমাদের পত্রপত্রিকার অতি উৎসাহী সাংবাদিকেরা তাঁর ঠিকুজি কুষ্ঠি খুঁজে বের করেছেন। কোথায় কতগুলো বাড়ি, কোথায় কোন অ্যাকাউন্টে কত টাকা, তাঁদের কল্যাণে এসব এখন আমাদের জানা হয়ে গেছে। কিন্তু খদ্দেরদের ব্যাপারে তাঁরা স্পিকটি নট। দু-চারটে ভিডিও এসেছে সামাজিকমাধ্যমে, অধিকাংশই ভাইরাল হয়েছে। অনুমান করি কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে অথবা অনুমোদনে এসব ভিডিও ও ফটো বাজারে এসেছে। লক্ষ করার বিষয়, যেসব রাঘববোয়াল পাপিয়ার নিয়মিত খদ্দের, তাঁদের কারও নাম নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ প্রকাশ করেনি। বরং উল্টো অভিজ্ঞ উকিলের মতো যুক্তি দেখিয়ে বলেছে, নামীদামি মানুষের সঙ্গে কত লোকই তো ছবি তোলে, তাঁদের অনুমতি ছাড়া এসব ছবি প্রকাশ করা অনৈতিক হবে। অকাট্য যুক্তি!
কিন্তু সভয়ে প্রশ্ন করতে চাই, এই যে ম্যাডাম পাপিয়া মাসের পর মাস বেআইনি ব্যবসা চালিয়ে গেলেন, সবার নাকের ডগার ওপর দিয়ে, আমাদের অতি সতর্ক আইন প্রয়োগকারী সংস্থা এত দিন সেসবের কোনো খোঁজ কেন রাখেনি? কোনো কিছুই তো তিনি লুকিয়ে-ছাপিয়ে করেননি। শহরের পাঁচতারকা হোটেলে তাঁর আনন্দধাম সাজানো হয়েছিল। পাপিয়ার খদ্দেররা কেবল সমাজের মালদার নন, অতি দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তি, তাঁরাই বা কী মনে করে নীরবে অপকর্ম চালিয়ে গেলেন? জানা গেছে, যে পাঁচতারকা হোটেলে প্রতিদিন তাঁরা পাপিয়ার আতিথ্য গ্রহণ করতেন, সেখানে এই সরদারনী প্রতি রাতে কয়েক লাখ টাকার মদের বিল মেটাতেন। এখানে যে বেআইনি একটা কিছু হচ্ছে, সে কথা হোটেল কর্তৃপক্ষ নির্ঘাত জানত। তারাও মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। অর্থাৎ চোরে চোরে সব মাসতুতো ভাই (ও বোন)।
বাংলাদেশের সর্বত্রই এখন এসব মাসতুতো ভাইয়ের রাজত্ব। কিছুদিন আগে গোপন ক্যাসিনো ব্যবসা ফাঁস হয়েছে। বেআইনিভাবে এসব ক্যাসিনোতে কোটি কোটি টাকা হাতবদল হতো। এখানেও সব অপকর্মের হোতা ক্ষমতাসীন মহলের কেউকেটারা। খদ্দেরদের অধিকাংশই তাই। শুধু তা-ই নয়, দরজার বাইরে পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে তাঁদের পাহারা দিয়েছে, যাতে নির্বিঘ্নে তাঁরা জুয়ার কারবার চালিয়ে যেতে পারেন। আমার ধারণা, পাপিয়ার যাঁরা খদ্দের ছিলেন, তাঁদের অনেকেই এসব ক্যাসিনোয় এসে দুই পেগ নামিয়ে জুয়ার আসর সাজাতেন।
সত্যি কথা হলো, ক্ষমতার আশ্রয় ও প্রতিপালন ছাড়া কোনো অপরাধকর্মই খুব বেশি দিন চালানো সম্ভব নয়। সব দেশেই, যাঁরা সবচেয়ে ক্ষমতাশালী, তাঁরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার অপব্যবহারকারী। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তার কেন্দ্রে রয়েছে আইনকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেওয়ার দুঃসাহস।
দুঃসাহস ছাড়া একে আর কোন নামে ডাকব? ভাবুন তো, এক বালিশের দাম ২৭ হাজার টাকা ধরে যাঁরা প্রকল্প বাস্তবায়নের আবদার জানান, তাঁরা কতটা সাহসী মানুষ? গত বছর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এ রকম এক সাহসী ঘটনা ধরা পড়েছে। শুধু তা-ই নয়, ধরা পড়ে যাওয়ার পর এসব সাহসী মানুষই আবার যুক্তি দেখান, হয়তো ছাপার ভুল ছিল। হতেই পারে, কিন্তু প্রকল্প অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণের আগে বিষয়টা তদন্ত করা হয়নি কেন? অনুমান করি, এর কারণ বখরার নিষিদ্ধ আমন্ত্রণ।
ক্ষমতার অপব্যবহারের সঙ্গে নিকট সম্পর্ক রয়েছে অর্থের। আমাদের দেশে কিছু মানুষের হাতে এখন বিপুল পরিমাণ বিত্ত। এই সব মানুষের অধিকাংশই একইসঙ্গে ব্যবসায় ও রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বলাই বাহুল্য, এই দুইয়ের মধ্যে একটি প্রচ্ছন্ন সমচিহ্ন রয়েছে, একটি ব্যবহার করা হয় অপরটি অর্জনে। ব্যবসা করে দুই-চার পয়সা হাতে এলে আমরা ছুটি দলীয় মনোনয়ন পেতে। আর একবার লটারির সে টিকিট হাতে পেলে তো কথাই নেই। ছপ্পর ফেড়ে ব্যবসা। আমার হাতে কোনো প্রমাণ নেই, কিন্তু অনুমান করি, যাঁরা পাপিয়া ম্যাডামের খদ্দের ও যাঁরা ক্যাসিনোয় ঘন ঘন যাতায়াত করতেন, তারা এই দুই পেশার একই মানুষ। পাপিয়ার কল লিস্টটি তালাশ করে দেখুন, কথাটা পরিষ্কার হবে।
সবাই আমরা এখন পাপিয়া কেচ্ছায় মেতে রয়েছি, ভাবখানা এই নারীর চরিত্র উদ্ধার করলে আমাদের অন্য সবার চরিত্র ধোয়া তুলসীপাতার মতো হবে। কিন্তু সত্যি কথা হলো, পাপিয়া শূন্য থেকে গজাননি। ঠিক যেমন শূন্য থেকে গজায়নি বেআইনি ক্যাসিনো ব্যবসা। অথবা ২৭ হাজার টাকার বালিশের টেন্ডার। এর পেছনে একটা ‘ডিমান্ড-সাপ্লাই’ সমীকরণ রয়েছে। যত দিন চাহিদা থাকবে, সরবরাহের অভাব কখনোই পড়বে না। এক পাপিয়া যাবে, আরেক পাপিয়া গজাবে। এক ক্যাসিনো বন্ধ হবে, আরেক ক্যাসিনো হবে। মনে রাখা ভালো, সব ধরনের দুর্নীতিই চরিত্রগতভাবে ‘বণ্টনভিত্তিক’ বা ‘রি-ডিস্ট্রিবিউটিভ’। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই, যাঁদের হাতে দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার বন্ধের চাবি রয়েছে, তাঁরাই সে চাবি দিয়ে যখন-তখন দুর্নীতির তালা খোলেন।
শুরুতে যে হাইডি ফ্লেইসের কথা বলেছিলাম, এই দামি কথাটা তাঁর কাছ থেকেই শোনা। তিন বছর জেল খাটার পর বেরিয়ে এসে তিনি প্যান্ডারিং নামের একটি স্মৃতিকথা লিখেছেন। তাতে তিনি জানিয়েছেন, তিনি যা করেছেন তা যদি অপরাধ হয়ে থাকে, তো যেসব পুরুষ মানুষ তাতে ফায়দা নিয়েছেন, তাঁরাও সমান অপরাধী।
একই কথা আমাদের পাপিয়া ম্যাডামের বেলাতেও খাটে। তাঁর কল লিস্টটি বের করুন, সেই সব অপরাধী পুরুষের মুখোশ খসে পড়বে।
হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক