মোহনার মা কোন নরক দেখে ফেলেছিল?

পাঁচ বছরের মোহনার মা মাহফুজা খাতুনের (২৮) সত্যদর্শন ঘটে গেছে। সত্যটা নারকীয়। সেই সত্যের জ্বালা সইতে না পেরে তিনি দুই সন্তান মোহনা ও মাহফুজকে (১০) হত্যা করে নিজে ঘরের কড়িবরগায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়েছেন। গত বৃহস্পতিবার যখন এসব ঘটে, তখন তাঁর স্বামী দূরের জেলায় কাজ করতে গেছেন।  

সাতক্ষীরায় দুই সন্তানসহ মায়ের লাশ উদ্ধারকী সেই সত্য? পাঁচ বছরের মোহনাকে যখন প্রতিবেশী মাদক কারবারির ছেলে ধর্ষণ করে বা ধর্ষণের চেষ্টা করে, তখনো মাহফুজা বিচারের ভরসায় বাঁচতে চেয়েছেন। স্বামীকে ডেকেছেন। কিন্তু হয়তো ট্রাক্টর চালানোর কাজ ছেড়ে আসা তাঁর পক্ষে তখনই সম্ভব হয়নি। তিনি আসতে পারেননি। মাহফুজা তখন শ্বশুরের কাছে গিয়েছেন। তিনকাল পেরোনো গরিব শ্বশুর আর কী বলবেন। শ্বশুর সমাজ-রাষ্ট্রটাকে তো চেনেন। তাই বলেন, মামলা করলে টাকাপয়সা যাবে, প্রভাবশালীর সন্তানের বিচার হবে কি না, তারও ভরসা নাই। অতএব মেনে নাও।

কিন্তু মায়ের মন মানতে চায়নি। পাঁচ বছরের মোহনা বুঝতে না শিখলেও তাকে মেয়েজীবনের চূড়ান্ত যে কষ্টটা দেওয়া হয়েছে, তার আঘাত বোঝার ক্ষমতা একমাত্র মায়েদেরই থাকে। মাহফুজা মানেননি। তিনি তারপর গেছেন গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্যর কাছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচন চলে, জনপ্রতিনিধির কি তখন জনগণের কথা ভাবলে চলে? তাঁকে ভাবতে হয় মাদক ব্যবসায়ী লাল্টু গাজীর মতো দুঁদে লোকের কথা। মাদকের কারবার যার, তার টাকা আছে, হাতে লোকও আছে। তার ধর্ষক সন্তানের বিরুদ্ধে মাহফুজাকে সাহায্য করলে তিনি জনপ্রতিনিধি থাকবেন কী করে?

মাহফুজা সমাজের অসহায়ত্ব দেখেছেন শ্বশুরের চোখে। রোজগার নামক অর্থনৈতিক গোলামি দেখেছেন তাঁর কন্যার পিতা, তাঁর স্বামীর সময়মতো আসতে না পারার অসহায়ত্বে। সরকার (স্থানীয়) দেখা আরও বাকি ছিল তাঁর। তিনি গেলেন চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যানও দায়িত্ব নিলেন না। তিনি নির্যাতনের শিকার শিশুর মাকে পাঠিয়ে দিলেন নারী ইউপি সদস্যের কাছে। চেয়ারম্যান যেখানে দায়িত্ব নেননি, সেখানে নারী ইউপি সদস্য কী করবেন। তিনি দায় এড়িয়ে পরামর্শ দিলেন স্থানীয় গণমান্যদের সঙ্গে কথা বলে থানায় মামলা করতে।

দশচক্রে ভগবান নাকি ভূত হয়। দোরে দোরে ঘুরে মাহফুজা হয়ে গেলেন আরও একা, পরিত্যক্তা আর দুঃখে জর্জর। মাহফুজার রাষ্ট্র ও সমাজ দর্শনের আরও বাকি ছিল। মামলা হবে শুনে ধর্ষকের গর্বিত পিতা মাহফুজাকে হুমকি দেন। মাহফুজা সেই কথা প্রাণের ভাইকে জানান, আপন স্বামীকে জানান। ভাই আর কী করবে, স্বামীই–বা কীভাবে আসবে? পেট চালাতে হবে না?

পাঠক, মনের ক্যামেরাকে এবার জুম করে আনুন। না না, মাহফুজার মুখের দিকে না, পারলে তার মনের ভেতরের ক্রোধের আগ্নেয়গিরি, দুঃখের দরিয়া আর অসহায়ত্বের অন্ধকারটায় ফোকাস করুন। এই রাগ, হতাশা আর অসহায়ত্ব নিয়ে মাহফুজা কীভাবে তাকাচ্ছিলেন তাঁর সন্তানদের দিকে? মায়ের মন কীভাবে নেবে পাঁচ বছরের শিশুর ওপর চালানো যৌন হয়রানি? কোন ভবিষ্যতের দিকে ওদের নিয়ে যাবেন তিনি? এই অবস্থায় আত্মহত্যার দিন সকাল সাতটার দিকে তিনি তাঁর ভাইকে বলেন, ‘আত্মহত্যা করা ছাড়া আমার আর উপায় নাই।’

প্রিয় পাঠক, আপনার দেখার চোখটাকে এবার বিস্তারিত করুন, ওয়াইড অ্যাঙ্গেলে এনে নজর ফেলুন ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দিকে। স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি, থানা-প্রশাসন, পুলিশ—সবার দিকে। স্বামী ও শ্বশুর কাদের ভয়ে চুপ ছিল? সমাজপতিরা কী করেছিল? জনপ্রতিনিধিরা কী করেছিল? পুলিশকে কি জানিয়েছিল কোনো মেম্বর যে আমার গ্রামে একটি নিষ্পাপ শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। আমরা পারছি না, আপনারা আসুন, দেখুন, বিচার করুন? কেউ কিছু করেনি।

কোথাও যে কেউ নাই, এই নারকীয় সত্যের সামনে আর দাঁড়াতে পারেননি মোহনার মা। আমরা কেবল জানতে পেরেছি ঘরের আড়ার সঙ্গে ঝুলে ছিল মায়ের মৃতদেহ। আর মেঝেতে পড়ে ছিল দুই ফোঁটা জীবন, দুটি শিশুর লাশ। বাংলা বিস্ময়বোধক চিহ্ন দেখতে এ রকম। একটা রেখার নিচে একটি ফোঁটা। মাহফুজার ভয়াবহ বিস্ময় আরও বেশি বলে তার আড়াআড়ি ঝুলে থাকা রেখার নিচে দুটি ফোঁটা: মোহনা ও মাহফুজ।

এটি হত্যা, নাকি আত্মহত্যা, তা ভেবে আমরা অবাক হই না। তিন বছর আগে হজরত আলী নামের এক বাবা পালিত কন্যা আয়েশাকে নিয়ে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দেন গাজীপুরে। মেয়েটিকে উত্ত্যক্ত করত বখাটেরা। তিনিও বিচারের আশায় দোরে দোরে ঘুরেছিলেন। সব দুয়ার বন্ধ পেয়ে মেয়েসহ নিজেদের জীবনের দুয়ারটাই চিরতরে বন্ধ করে দিয়েছেন।

সমাজবিজ্ঞান বলে, এসব কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। যখন সমাজকাঠামো কাউকে ঠেলে দেয় এমন হননের দিকে, যখন সমাজ-রাষ্ট্র বিপন্ন মানুষকে বাঁচাতে চায় না, তখন এসব অপমৃত্যুর দায় তো ওই সমাজ-রাষ্ট্রের কর্তাদেরই। অবশ্য প্রশাসন বলবে এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা।

এই ফাঁকে মাদক-মাফিয়া লাল্টু গাজীরা ঝাড়েবংশে আরও বড় হবে, নেতা হবে, জনপ্রতিনিধি হবে। শিশুকে যারা রহম করে না, তাদের সামনে কীভাবে বড় হয়েও নিরাপদ থাকবে মোহনারা? সেসব দেখার আতঙ্কেই মাহফুজারা মরে যাবে। কারণ, তারা নরকটা জীবদ্দশাতেই দেখে ফেলেছিল।

পাঠক, এবার ওই ক্যামেরাটা বন্ধ করুন, চোখে ঠুলি পরুন। দেখবেন, অন্ধকারে কিছুই যখন দেখা যায় না, তখন নিদ্রাই নিরাপদ। সব ঠিকঠাকই তো আছে, নাকি?

ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
Faruk.wasif@prothomalo.com