‘মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি’—গোবিন্দ হালদারের লেখা ও আপেল মাহমুদের সুর করা ও গাওয়া এই গান ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা জোগাতে গাওয়া হতো।
লেখার শিরোনামে ‘ফুল’ শব্দটির পরিবর্তে ‘গাছ’ শব্দটি প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। এখন বিজয়ের মাস। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে আমরা বিজয় লাভ করেছি। কিন্তু দারিদ্র্য, আর্থিক বৈষম্য, দুর্নীতি, ভোটাধিকার প্রয়োগ, টেকসই উন্নয়নের যুদ্ধ এখনো অব্যাহত আছে। এসব ক্ষেত্রে বিজয় এখনো আমাদের অধরা রয়ে গেছে। বিজয়ের মাসে তাই জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্কিত এসব বিষয় আলোচনা প্রয়োজন।
টেকসই উন্নয়ন প্রসঙ্গ নিয়েই আজকের আলোচনা। সবারই জানা আছে যে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের শিকার দেশগুলোর মধ্যে প্রথম সারির একটি দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার অন্যতম উপায় হচ্ছে বনায়ন ও বনভূমির সংরক্ষণ। বলা হয়ে থাকে, পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য যেকোনো দেশের ভৌগোলিক এলাকার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর পরিমাণ ১৫ শতাংশের কম এবং যা দ্রুত কমছে। এটা দক্ষিণ এশিয়ার গড় ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে কেবল মালদ্বীপ, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের অবস্থা বাংলাদেশ থেকে খারাপ। তবে এ জন্য দেশ দুটির ভৌগোলিক অবস্থান, গঠন, পানির প্রাপ্যতাও খানিকটা দায়ী। বিরূপ এ পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য পাকিস্তান এক হাজার কোটি গাছ লাগানোর একটি কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভুটান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভারতে বনাঞ্চলের পরিমাণ এসব দেশের মোট জমির পরিমাণের ৭১ দশমিক ৪, ৪১ দশমিক ৬, ৩৪ দশমিক ২, ও ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো প্রতিদিন নির্বিচার গাছ কাটা চলছেই।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বৃক্ষনিধন কর্মসূচি চলছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজের সুবিধায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কের দুই ধারের কয়েক শ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় ৩০০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশিসংখ্যক গাছই ছিল ৩০-৪০ বছর বয়সী। এ রকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।
সাম্প্রতিক একটি অভিজ্ঞতা দিয়ে বিষয়টি ব্যাখ্যা করি। আমরা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা মিলে ধামরাইয়ের শৈলানে একটি প্রবীণনিবাস প্রতিষ্ঠা করছি। প্রায় ৮০ জন দুস্থ প্রবীণ নাগরিককে এখানে বিনা মূল্যে বাসস্থান, পোশাক, আহার ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হবে। প্রকল্পের চারতলা ভবনের নির্মাণকাজ এখন শেষ পর্যায়ে। শোয়ার ঘর, অফিস কক্ষ, ডাইনিং ও মেডিকেল রুমকে আসবাবে সজ্জিত করা এবং তৈজস সংগ্রহের কাজও শুরু হয়েছে। অচিরেই বাসিন্দা নির্বাচনের কাজ শুরু করা হবে।
গত সপ্তাহে, সাতসকালে শৈলান প্রবীণনিবাসের সাইট ইঞ্জিনিয়ারের নিচের ছবিসহ খুদে বার্তা পেলাম, ‘স্যার, সিকিউরিটি রুমের ফাউন্ডেশনের মধ্যে কাঁঠালগাছের শিকড় পড়ছে, এখন কী করব?’
আমি জবাবে লিখলাম, ‘কোনো অবস্থাতেই কোনো গাছ কাটা চলবে না। অন্য সমাধান বের করতে হবে।’
‘তাহলে ওইখানে সিকিউরিটি রুম দেওয়া যাবে না’—ত্বরিত জবাব এল।
‘বললাম তো, কোনো অবস্থাতেই কোনো গাছ কাটা চলবে না। অন্য সমাধান বের করতে হবে। মাথা খাটাও’—আমি বিরক্ত হয়ে লিখি।
‘আর যদি ওইখানেই শিকড় না কেটে সিকিউরিটি রুম করি তাহলে ভবিষ্যতে ফ্লোর ক্র্যাক করবে।’ —সাইট ইঞ্জিনিয়ার হাল ছাড়ে না। গাছ সে কেটেই ছাড়বে।
‘দরকার হলে সিকিউরিটি রুম দক্ষিণ পাশে খালপাড়ে সরাও’—আমি জবাবে লিখি।
‘ইনশা আল্লাহ সমাধান বের করে জানাচ্ছি’—সাইট ইঞ্জিনিয়ার হাল ছেড়ে দেয়। এ দফায় আর তার গাছ কাটা হলো না।
শৈলান প্রবীণনিবাসে মাত্র দুটি ফলদ গাছ আছে। ছায়া দেওয়া ছাড়াও গাছ দুটিতে বছরে ৩০-৪০টি কাঁঠাল ধরে, যা দিয়ে নিবাসের বাসিন্দাদের অন্তত দুই-তিন দিন এ মৌসুমি ফল খাওয়ানো সম্ভব। এর আগেও সীমানাপ্রাচীর লাগানোর আগে প্রবীণনিবাসের সভাপতির সযত্নে লাগানো ২০-৩০টি গাছ ঠিকাদার কেটে ফেলে। গাছ কেটে ফেলার পর আমরা তা জানতে পারি। এতে আমাদের সভাপতি অত্যন্ত রুষ্ট হন। পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে আমরা আমাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাই। দেশের সর্বত্রই এ চিত্র। আমাদের স্থপতি, প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের গাছ হত্যা বিষয়ে কোনো বিকার নেই। তাঁরা গাছ নিধন করেই চলেছেন। পৃথিবীর অনেক দেশেই স্থানীয় সরকারের অনুমতি ছাড়া কোনো গাছই কাটা যায় না। এমনকি নিজের জমিতে বা আঙিনায় হলেও।
বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় বৃক্ষনিধন কর্মসূচি চলছে উন্নয়ন প্রকল্পের নামে। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কাজের সুবিধায় ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সড়কের দুই ধারের কয়েক শ গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রায় ৩০০টি গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। এর মধ্যে এক-তৃতীয়াংশের বেশিসংখ্যক গাছই ছিল ৩০-৪০ বছর বয়সী। এ রকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়।
সম্ভবত ২০১৮ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে এক আলোচনা শেষ করে আমি ও আমার স্ত্রী আমাদের বন্ধু সুনীল ও প্রতিভা ঘোষের ওয়ালনাট স্ট্রিটের বাড়িতে বেড়াতে যাই। পাহাড়ের মাঝ দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তা। দুই পাশে ভারি দৃষ্টিনন্দন বাড়িঘর, গাছগাছালি ও বনভূমি। অনুমান করি, পাহাড়ের ভূমির বন্ধুরতা অক্ষুণ্ন রেখেই রাস্তা, বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছে। বৃক্ষ নিধন করা হয়েছে যৎসামান্য। অনেক বাড়ির ভেতরেই মাথা উঁচু করে আছে গাছ। গাছ না কেটে, তাকে যথাস্থানে রেখেই বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্থাপনা তৈরির সময় এসব বিবেচনায় নেওয়া হয় না। কোনো প্রকল্প ডিজাইন করার আগে জায়গাটিকে যেন সমতল ও বিরানভূমি হিসেবে বিবেচনা করে নেওয়া হয়। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এটাই মূল সমস্যা। পরিবেশ অক্ষুণ্ন রেখে ভবন, অবকাঠামো নির্মাণের ডিজাইন করতে হবে।
এ সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় কী? প্রথমেই উন্নয়ন প্রকল্পে ভূমির বন্ধুরতা ও গাছগাছালি যথাসম্ভব অক্ষুণ্ন রাখার নীতি গ্রহণ করতে হবে। যাতে ভূমির বন্ধুরতা রক্ষা ও গাছ না কাটার পদ্ধতিও অন্তর্ভুক্ত থাকবে। ভূমিতে কোনো পরিবর্তন আনার আগে এর বিকল্প অনুসন্ধান করতে হবে। গাছ কাটার আগে, তা না কেটে ডিজাইন করার চেষ্টা করতে হবে। এসব প্রযুক্তি এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোথাও ভূমিতে পরিবর্তন ও গাছ কাটা অনিবার্য হলে, এর বিরূপ প্রভাব প্রশমনের জন্য অন্য জায়গায় গাছ লাগাতে হবে।
আমাদের স্থাপত্য, প্রকৌশল ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠক্রমে ভূমির বন্ধুরতা রক্ষা করে, গাছ না কেটে নির্মাণপদ্ধতির আলোচনা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্থপতিদের পেশাগত সংগঠন ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টস বাংলাদেশ (আইএবি), প্রকৌশলীদের সংগঠন ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি), ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি) এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। ভূমির বন্ধুরতা রক্ষা করে, গাছ না কেটে নির্মাণপদ্ধতি বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে পারে।
এতসব করে কাজ না হলে, প্রতিটি তিন বছর পুরোনো বা ৩ ফুটের বেশি লম্বা গাছ কাটা ও ভূমির বন্ধুরতা রক্ষায় উদাসীন ও ব্যর্থতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির আইনি বিধান করার বিষয় ও বিবেচনা করা যেতে পারে। বন অধিদপ্তরের মহাপরিকল্পনায়, দেশে প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের মধ্যে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট বা সুন্দরবন ছাড়া প্রায় সব (৬৬%) বনভূমিই ধ্বংসের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে বলা হয়েছে। নির্মাণকাজে বন নিধন বন্ধ করার পাশাপাশি বিদ্যমান বনভূমি সংরক্ষণ ও এর বিস্তারের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
যেকোনোভাবেই হোক, ভূমির বন্ধুরতা ও বনভূমি রক্ষা করতে হবে। নতুন নির্মাণের ক্ষেত্রে বৃক্ষনিধন বন্ধ করতেই হবে। এবং তা করলেই যুদ্ধক্ষেত্রের বিজয় ও বিজয় দিবস উদ্যাপন অর্থবহ হবে।
মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ