কথাটা বলছিলেন গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। সেদিন প্রথম আলোর গোলটেবিল বৈঠকে দলিত জনগোষ্ঠীর একজন নেতার বক্তব্যের সূত্র ধরে তিনি এ মন্তব্য করেন।
আমরা হয়তো অনেকে খেয়ালও করি না যে কিছু সম্প্রদায়ের মানুষকে শুধু পেশাগত ও বংশগত পরিচয়ের কারণে সমাজে ‘ছোট জাত’ বা ‘নীচু জাত’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ওঁরা হয়তো পরিচ্ছন্নতাকর্মী। কেউ জুতা সেলাই করেন। এ ছাড়া আছে ঋষি, পাড়ই, বেয়ারা, কাপালি, হরিজন প্রভৃতি। এককথায় সমাজে ওদের দলিত বলে চিহ্নিত করা হয়। ওরা সামাজিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। কেউ কেউ ওদের বলেন ‘অচ্ছুত’। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার। তাদের নেতা সেদিন বলেন, প্রায়ই তাঁদের ‘দূর হ’ বলে তাড়িয়ে দেওয়া হয়। এমনকি কোনো চায়ের দোকানে সবার সঙ্গে বসে চা খাওয়ার সৌভাগ্যও অনেক সময় তাদের হয় না। এই ঢাকা শহরেই তো আমরা দেখি পরিচ্ছন্নতাকর্মী কোনো নারী হাতে সব সময় একটি চায়ের মগ নিয়ে চলেন। কারণ, চা খেতে হলে ওদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। হোটেলের প্লেট-গ্লাস-কাপে তাদের খেতে দেওয়া হয় না।
গ্রামের দিকে অবস্থা আরও খারাপ। কেউ যদি চায়ের জন্য কোনো হোটেলে হঠাৎ ঢুকে পড়েন, তাহলে সেখান থেকে অন্য সব লোক বেরিয়ে যায়। দলিতদের সঙ্গে এক টেবিলে বসলে ওরা মনে করে মানসম্মান আর থাকবে না। সমাজের চোখে ওরা অপাঙ্ক্তেয়! নির্বাচনের সময় কোনো কোনো পক্ষ এদের ব্যবহার করে। তখন অন্য পক্ষ তাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। অচ্ছুত বলে গালমন্দ করে। ওরা প্রায়ই নানা রকম নির্যাতনের শিকার হয়। বাংলাদেশে দলিতদের সংখ্যা প্রায় এক কোটি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী প্রায় ৬৪ লাখ। সঠিক পরিসংখ্যানও নেই। এরা সমাজে এখনো ‘বাদ পড়া’ জনগোষ্ঠী।
গোলটেবিল বৈঠকের আলোচনায় সবাই বললেন, একটি গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের বৈষম্য কীভাবে চলে? এ তো ধনী-গরিবের ব্যাপার নয়। স্রেফ সামাজিকভাবে অপমান করা, উপেক্ষা করা। একজন মানুষ যখন অন্য একজন মানুষকে নিম্নমানের প্রাণী বলে মনে করে, তখন তো তার নিজেরই মানুষ বলে দাবি করার ভিত্তি থাকে না। গোলটেবিল বৈঠক আয়োজনে সহযোগিতা করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও ব্রিটিশ উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা ডিএফআইডি। ওরা দলিতদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের অধিকারের কথা বলছে। সমাজে তাদের অন্তর্ভুক্তির জন্য কাজ করছে।
বেশ কয়েক বছর আগে আমার পরিচিত একজন তার মেয়ের চাকরির ব্যবস্থা করে দেওয়ার অনুরোধ করে। এম এ পাস। ভালো ফল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এত ভালো ফল করেও চাকরির জন্য কেন সুপারিশ করতে হবে? আমি জিজ্ঞেস করলে সে কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, অনেক অফিস থেকেই ইন্টারভিউয়ের জন্য ডাকে। কিন্তু সামান্য দু-চারটা প্রশ্ন করে বিদায় করে দেয়। চাকরি হয় না। সে মন খারাপ করে বলল, ‘আমাদের সমস্যা হলো কি, নামের শেষে “রবিদাস” পদবিটা থাকে। বাপ-দাদার পদবি তো ছাড়তে পারি না। আর সেটাই হলো আমাদের কাল। ওই পদবিটা দেখলেই কেউ আর চাকরি দিতে চায় না। কারণ আমরা জুতা বানাই, তাই আমরা নাকি “ছোট” জাতের মানুষ! আমাদের চাকরি দিলে নাকি অফিসের অন্য কর্মীদের “জাত” যাবে।’ সেই হতভাগা পিতা মেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। সে বলে, ‘আমরা কি সমাজের বাইরের মানুষ?’
আমি অনেক চেষ্টা করেও চাকরির ব্যবস্থা করতে পারিনি। লজ্জায় সেই বন্ধুর সঙ্গে আর যোগাযোগও করিনি। অথচ সে আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল। ছোটবেলায় কত যাওয়া-আসা করেছি ওদের পাড়ায়। ছোট ছোট ঘরে খুব কষ্ট করে থাকত ওদের পরিবার। এক ঘরে সবাই থাকে, আবার ঘরের এক অংশে জুতা তৈরি করে। আমরা বড় বড় স্কুল-কলেজে পড়েছি। কিন্তু সে নিজে লেখাপড়া করতে পারেনি। তবে মেয়েকে পড়িয়েছে অনেক আশা নিয়ে। কী হলো তাতে? আমাদের এই সংকীর্ণ সমাজ তো তার মেয়ের একটা চাকরির ব্যবস্থাও করতে পারল না।
শুনেছি ওদের অনেকে মনের দুঃখে অ্যাফিডেভিট করে নামের শেষের রবিদাস বা এ ধরনের পদবি বাদ দিয়েছে। কিন্তু তাতেও মুক্তি নেই। কারণ, কাগজে কী লেখা হয়েছে, সেটা কে দেখতে যাচ্ছে? এলাকার সবাই তো জানে সে রবিদাস। তাই তাকে সমাজের বাইরে রাখো!
অবশ্য সবখানে যে এই অবস্থা তা নয়। আমাদের বাসায়ই দেখেছি পরিচ্ছন্নতাকর্মীর সঙ্গে বাসার নিরাপত্তাকর্মীদের খুব বন্ধুত্ব। একই চুলায় ওরা রান্না করে। একই গ্লাসে পানি খায়। ভেদাভেদ করে না। এটা নির্ভর করে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির ওপর।
আমাদের সংবিধানে বলা আছে সব নাগরিক সমান। আমরা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের পথে চলেছি। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার মূল কথা হলো সবাইকে নিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গড়তে হবে। কেউ পেছনে পড়ে থাকবে না। বিশ্বে আমাদের সুনামও হয়েছে। আমরা অপুষ্টি, নারী, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার অনেকটা কমিয়ে এনেছি। আমাদের গড় আয়ু বাড়ছে। দারিদ্র্যের হার কমিয়ে আনছি। এত বড় বড় সাফল্যের পরও কেন আমাদের কেউ কেউ প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করতে পারছি না? কেন তাদের ‘দূর দূর’ করে তাড়িয়ে দিচ্ছি?
জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল নামে একটি নীতিমালা অবশ্য আছে। কিন্তু এখনো আইন হয়নি। খসড়া হয়েছে। আইন হলে হয়তো দলিতদের বৈষম্য বিলোপের সুযোগ সৃষ্টি হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, শুধু আইন দিয়ে হবে না। জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলে রয়েছে অনেকগুলো কর্মসূচি। সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, তারপর রয়েছে বৈষম্য দূর করা থেকে শুরু করে সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। একটা বিশাল কর্মযজ্ঞ। সেখানে দলিত-বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কথাও রয়েছে।
তবে কোনোটাতেই কিছু হবে না, যদি আমাদের নিজেদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে না পারি। জাতি, বর্ণ, ধনী-দরিদ্র, রবিদাস না হরিজন—এই সব নিয়ে আমরা যদি এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে উঠতে না পারি, তাহলে কিছু হবে না। এটা দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্ন। আমি মানুষ, কিন্তু আমার চোখটা মানুষ হয়েছে কি না সেটাই প্রশ্ন। খুব দুঃখের কথা, এই পরীক্ষায় আমাদের সমাজের অনেক মানুষই কিন্তু উত্তীর্ণ হতে পারছেন না। এই কথাটাই রাশেদা কে চৌধূরী খুব সুন্দরভাবে বলেছেন, আমরা ক্ষণে ক্ষণে মোবাইল সেট বদলাই, কিন্তু মাইন্ডসেট বদলাই না।
আসুন আমরা মনটাকে একটু উঁচু করি। কাল আমাদের মোবাইল সেটটি বদলানোর আগে যেন সমাজের প্রতি, সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি মাইন্ডসেট, মানে দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই। তাহলে হয়তো বলতে পারব আমরা মানুষ হয়েছি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
quayum@gmail.com