কলকাতার চিঠি

মোদি-ঝড় ও বিজেপির স্বপ্ন

জনসংখ্যার দিক থেকে ভারতের সর্ববৃহৎ রাজ্য উত্তর প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচনে মোদি-ঝড়ে তছনছ হয়ে গেছে বিরোধী দলের সাজানো বাগান। সেই ঝড়ের ঝাপটা প্রকারান্তরে আঘাত হেনেছে গোটা ভারতেই। ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল এমনটা ভাবতে পারেনি যে উত্তর প্রদেশজুড়ে ভেতরে ভেতরে মোদির পক্ষে একটি চাপা হাওয়া চলেছে। সেই হাওয়াই বেগবান হয়ে ঝড়ের রূপ নিয়ে আছড়ে পড়েছে গত শনিবার, ১১ মার্চ। সেই ঝোড়ো হাওয়াই তছনছ করে দিয়েছে সমাজবাদী পার্টি, কংগ্রেস ও বহুজন সমাজ পার্টির এত দিনকার সাজানো বাগান।
প্রধানমন্ত্রী মোদি জিতলেন। উত্তর প্রদেশে সৃষ্টি করলেন এক ঐতিহাসিক রেকর্ড। ১৯৯১ সালের বিজেপির নিজের রেকর্ডও ভেঙে দিলেন। বাবরি মসজিদ ইস্যুকে সামনে নিয়ে সেবার উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতেছিল ২২১ আসন। আর এবার ২০১৭ সালে মোদি জিতলেন ৩২৫টি আসন। সত্যিই এক ঐতিহাসিক রেকর্ড। তবে ২০১৪ সালের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনেও মোদি-ঝড় আঘাত করেছিল উত্তর প্রদেশকে। তখন লোকসভায় বিজেপি আসন পেয়েছিল ৭১টি। আসন ছিল ৮০টি। আর এবার বিধানসভা নির্বাচনে ৪০৩ আসনের মধ্যে বিজেপি একাই জয় করেছে ৩২৫টি আসন।
১৯৯১ সালে বিজেপির ছিল বাবরি মসজিদ ইস্যুর হাওয়া। কিন্তু এবার? এবার সে ধরনের কোনো হাওয়া প্রকাশ্যে প্রবাহিত হয়নি। তবে তা হয়তো ভেতরে ভেতরে বইছিল উত্তর প্রদেশের মানুষের হৃদয়ে। নোট বাতিলের বিরুদ্ধে হাওয়াও এবার কোনো কাজ দেয়নি উত্তর প্রদেশে। তা ছাড়া এমন ফলাফল হবে, তা ভারতের কোনো সংবাদমাধ্যম বা সংস্থা নির্বাচনপূর্ব জনমত সমীক্ষা বা বুথফেরত সমীক্ষায়ও ইঙ্গিত দিতে পারেনি।
কিন্তু গত ১১ মার্চ ফলাফল প্রকাশের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের হিসাব-নিকাশ ওলট-পালট হয়ে যায়। বিজেপি-বিরোধীদের মাথায় হাত ওঠে। এমন ফলাফল তো কল্পনার বাইরে! সবার মনে প্রশ্ন জাগে, কেমন করে সম্ভব হলো এই ফলাফল? ঝড়ের আগে তো আলামত দেখা যায়, সংকেত মেলে, এবার তার কিছুই মেলেনি। এ তো সত্যিই মোদি-ম্যাজিক। এ জন্যই মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ‘দেবতা’র সঙ্গে তুলনা করতে দ্বিধা করেননি। বলেছেন, তিনি দেবতা। তাঁর প্রশস্তিও গেয়েছেন।
উত্তর প্রদেশের ফলাফলে আপ্লুত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে বিজেপি-শিবিরে উঠছে পদ্মফুলের গেরুয়া পতাকা। বিজেপির নেতারা স্বপ্নও দেখা শুরু করেছেন। ভাবছেন, এরপর হয়তো পশ্চিমবঙ্গেও প্রায় বন্ধ থাকা বিজেপির দরজা খুলে যেতে পারে। তাঁরা ২০১৯ সালে পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনে মোদি-ঝড় সঙ্গে নিয়ে পার পাওয়ার আশা করছেন।
২০১৪ সালের সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২ আসনের মধ্যে বিজেপি মাত্র ২টি আসন পেয়েছিল। আর গত বছরের পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে ২৯৪ আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল মাত্র ৩টি আসন। এখন মোদি-ঝড়ে উত্তর প্রদেশে বিধ্বস্ত হওয়া কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টির দুরবস্থা দেখে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গ শাখা জয়ের স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। তাইতো উত্তর প্রদেশের নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার দিন বিজেপি গোটা পশ্চিমবঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। রাজ্যজুড়ে উৎসব ছড়িয়ে পড়ে।
কংগ্রেস, বাম দল বা শাসক তৃণমূল কংগ্রেসও ভাবতে পারেনি এবার এমন ফলাফল হবে। সবারই ধারণা ছিল মোদির বিজেপির সঙ্গে অখিলেশ যাদবের সমাজবাদী পার্টি ও কংগ্রেস জোটের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। কিন্তু মোদি-ঝড়ে সব হিসাব উল্টে গেল। তবু এই রাজ্যের বিজেপিবিরোধীরা বলেই দিয়েছেন, উত্তর প্রদেশের ফলাফল এই রাজ্যে কোনো প্রভাব ফেলবে না। পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি-বিরোধীরা বিজেপিকে গুরুত্ব দিতে নারাজ।
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ উত্তর প্রদেশের নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণার দিন বিজেপির জয়যাত্রা দেখে কলকাতায় তাঁর দলীয় কার্যালয়ে আনন্দে মেতে ওঠেন আবির খেলায়। ঘোষণা দেন, আগামী বছরের পঞ্চায়েত নির্বাচনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির জয়যাত্রা শুরু হবে। মানুষ বাম দল ও কংগ্রেসকে আগেই ছুড়ে দিয়েছে। এবার ছুড়ে দেবে তৃণমূলকে। সামনে আসছে বিজেপির দিন।
বিজেপির এই আনন্দ-উল্লাস দেখে তৃণমূল কংগ্রেসের এক নেতা বলেছেন, উত্তর প্রদেশ আর পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা এক নয়। এখানকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে উত্তর প্রদেশের মিল নেই। এখানের মানুষ মমতার ওপর আস্থা রেখেছেন। সুতরাং, উত্তর প্রদেশের ফলাফল এখানে কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ও রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন যেমন ছিল, তেমনই থাকবে। এই ফলাফলে আহ্লাদিত হলে চলবে না। আগামী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল ৪০ থেকে ৪২ আসন পাবে। যদিও এই রাজ্যে রয়েছে লোকসভার ৪২টি আসন।
অন্যদিকে সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘এ ধরনের জয় গোটা দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উৎসাহ দেবে, যে রাজনীতি দেশের অন্দরে বিভাজন তৈরি করে।’ আর পশ্চিমবঙ্গ কংগ্রেসের সাবেক রাজ্য সভাপতি ও বর্তমান সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘উত্তর প্রদেশের ফলাফল পশ্চিমবঙ্গে কোনো প্রভাব ফেলবে না। পাঞ্জাব, মণিপুর ও গোয়া কংগ্রেসের জয় এনে দিয়েছে। ভবিষ্যতে কংগ্রেস আরও ভালো ফল করবে।’
অন্যদিকে উত্তর প্রদেশের বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জয়ী প্রার্থীদের অভিনন্দন জানিয়ে বলেছেন, ‘নির্বাচনে হার-জিত আছে। কেউ জিতবে কেউ হারবে। পরাজিত প্রার্থীদের বলব, তাঁরা যেন ভেঙে না পড়েন। এটাই গণতন্ত্র। গণতন্ত্রে পরস্পরের মতামতকে সম্মান জানানো উচিত। বিশ্বাস রাখা উচিত মানুষের ওপর।’
বিজেপি-বিরোধী রাজনীতিকেরা যা-ই বলুন না কেন, এই রাজ্যে মোদি-ঝড়ের কিছুটা ঝাপটা যে পড়বে, এটা নিশ্চিত। তবে শঙ্কা, দেশ কোনদিকে যাবে সেই প্রশ্নে। ধর্মনিরপেক্ষতা লালন করে আসা ভারতে বিজেপি যেভাবে ধর্মান্ধতার বীজ বপন করে চলেছে, তা ভবিষ্যতের জন্য শুভ নয়। সবারই একটি কথা—ধর্মনিরপেক্ষ ভারত তার আদর্শে দৃঢ় থাকুক। ধর্মনিরপেক্ষতার পতাকা উড়ুক সর্বত্র।
অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।