ভারতের নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জয়লাভে ধারাবাহিকতা বজায় থাকার সম্ভাবনায় অনেকেই আশাবাদী হয়েছেন। তাঁদের আশাবাদের কারণ সরকার বদল না হওয়ায় ভারতের অর্থনৈতিক নীতিকৌশলে কোনো বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে না। দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীরাসহ বিশ্বের অধিকাংশ দেশই মোটামুটিভাবে আশা করছে যে তাদের পররাষ্ট্রনীতিতে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে রদবদল বা খাপ খাওয়ানোর প্রয়োজন পড়বে না।
দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত যে প্রতিবেশীর সঙ্গে এযাবৎকালের সেরা সম্পর্ক উপভোগ করছে, সেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর অভিনন্দনবার্তায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে লিখেছেন, ‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আমাদের উভয়ের প্রতি নিজ নিজ জনগণ যে ম্যান্ডেট নবায়ন করেছেন, তাতে ইতোমধ্যে সুপ্রতিবেশীর রোল মডেলের রূপ লাভ করা বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্ক আরও সংহত হবে এবং নতুন উচ্চতায় পৌঁছুবে।’
শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট মাইথ্রিপালা সিরিসেনা ও প্রধানমন্ত্রী রনিল বিক্রমা সিংহেও একই ধরনের বার্তা পাঠিয়ে সহযোগিতার সম্পর্ক সংহত করার কথা বলেছেন। ফল ঘোষণার আগেই বুথ–ফেরত সমীক্ষার ওপর ভিত্তি করে অভিনন্দন জানিয়েছেন মালদ্বীপের নেতা মোহাম্মদ নাশিদ। মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কায় রাজনৈতিক পালাবদলে ভারতের প্রচ্ছন্ন ভূমিকার কথা মোটামুটি সুবিদিত। নেপাল ও পাকিস্তানও প্রধানমন্ত্রী মোদির সাফল্যে তাঁকে অভিনন্দিত করেছে। তবে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টিতে জটিলতা সহসা কাটবে বলে কেউই মনে করেন না। বস্তুত পাকিস্তানের বালাকোটে বিমান হামলার বিতর্কিত সাফল্যে ভারতের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতার প্রহরীর ভাবমূর্তিকে ভর করার বিষয়টি মোদির নির্বাচনী সাফল্যের অন্যতম কারণ।
বিজেপির এবারের প্রচারণায় জাতীয়তাবাদের বিষয়টি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে। সে কারণে ৬৫ জন মুসলমানকে হত্যার মামলায় প্রধান আসামি প্রজ্ঞা ঠাকুরকে মনোনয়ন দিতেও দলটি কুণ্ঠাবোধ করেনি। শুধু প্রজ্ঞা ঠাকুরই নন, এবার মনোননয়ন পাওয়া নির্বাচিতদের মধ্যে আরও অনেকেই আছেন, যাঁরা বারবারই ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে রূপান্তরের প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন। লন্ডনপ্রবাসী ভারতীয় লেখক সলিল ত্রিপাঠি একটি বাক্যে এই নির্বাচনের ফলাফল মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, ‘বিশ্ব যে বছরটিতে (অহিংসার বাণী প্রচারক) গান্ধীর ১৫০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করছে, সে বছরেই ভারত নির্বাচিত করেছে এমন একজন সন্ত্রাসীকে, যে গান্ধীর হত্যাকারী নাথুরাম গডসেকে প্রকৃত দেশপ্রেমিক মনে করে।’
প্রশ্ন হচ্ছে ভারতে সরকারের ধারাবাহিকতা বজায় থাকায় বাংলাদেশ আসলে কতটা লাভবান হবে? নাকি এতে বাংলাদেশের জন্য বাড়তি উদ্বেগ তৈরি হলো? নির্বাচনের সময় উচ্চারিত উত্তেজক রাজনৈতিক বক্তৃতাগুলোর অংশবিশেষ বাস্তবায়নের উদ্যোগে যেমন উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ আছে, তেমনই ঝুঁকি আছে কথিত ধারাবাহিকতার সম্ভাবনাতেও।
২০১৪ সালের নির্বাচনের বিপরীতে ২০১৯ একেবারেই অনন্য। আগের নির্বাচনে ছিল অর্থনৈতিক সংস্কার, ভারতকে সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী করার অঙ্গীকার। তখনকার স্লোগান ছিল ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ হবে বিশ্বপরিসরে ভারতের মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর দর্শন। কিন্তু এবারের নির্বাচনে বলা চলে অর্থনীতি তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি। রেকর্ড বেকারত্ব, নোট বাতিলের ভোগান্তি, বিক্রয় কর আরোপ নিয়ে অসন্তোষ, ঋণগ্রস্ত কৃষকদের রেকর্ড আত্মহনন ও বিক্ষোভ, গরুর পবিত্রতা রক্ষায় সংঘবদ্ধ নজরদারি ও হত্যার ঘটনাগুলোয় সংখ্যালঘু মুসলমানদের সুরক্ষা দেওয়ায় ব্যর্থতা এবং রাফায়েল জঙ্গি বিমান কেনায় দুর্নীতির অভিযোগের মতো বিষয়গুলোর কোনোটিই ভোটের মাঠে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে কাজ করেনি। বিপরীতে, জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নটি ভারতজুড়েই বিজেপির প্রতি মানুষকে আস্থা রাখতে সহায়তা করেছে। সেখানে মেঘের কারণে পাকিস্তানের রাডার ব্যর্থ হওয়ার মতো হাস্যকর ব্যাখ্যাতেও নরেন্দ্র মোদির ভাবমূর্তি খুব একটা ম্লান হয়নি।
হিন্দু জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় নিরাপত্তার ইস্যুকে নির্বাচনে প্রাধান্য দেওয়ায় ভারতের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশও বিতর্কের বিষয় হয়েছে। সীমান্তবর্তী রাজ্যগুলোর প্রচারণায় বাংলাভাষী মুসলমানদের অবৈধ বাংলাদেশি অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁদের ঘুণপোকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এসব সীমান্তবর্তী জেলায় বিজেপির সাফল্যও লক্ষণীয়। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য আসামে মুসলমান বাংলাভাষীদের বিতাড়নের লক্ষ্যে নাগরিকত্বের তালিকায় নাম থাকা বাধ্যতামূলক করার উদ্যোগ নিয়ে গত বছর যে তোলপাড় হয়েছে, তা কারোরই ভুলে যাওয়ার কথা নয়। ৪০ লাখের বেশি মানুষের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়ে। তবে সংসদে বিরোধীদের বিরোধিতায় এনআরসি কার্যকরের চেষ্টা ব্যর্থ হলেও বিজেপির সভাপতি এবারের নির্বাচনী সভায় ঘোষণা দিয়ে গেছেন যে পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য সীমান্তবর্তী রাজ্যেও তা চালু করা হবে। এই এনআরসির কারণে তখন আশঙ্কা তৈরি হয় যে শুধু আসাম থেকেই দশ থেকে ত্রিশ লাখের বেশি বাংলাভাষীকে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা হতে পারে। এখন সেই সংখ্যা কত গুণ বাড়তে পারে, তা অনুমান করা মোটেও কঠিন নয়।
দ্বিতীয় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর মানুষের নিরাপত্তা। এমনিতেই ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পরিচিতি ছিল বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত হিসেবে। কাঁটাতারের বেড়ার কারণে সেই মৃত্যুর হার কমে এলেও সীমান্তে যত প্রাণহানি ঘটে, তার ৯৫ শতাংশের বেশি শিকার হন বাংলাদেশিরা। ভারতের গরু, মাদক ও নানা ধরনের পণ্যের চোরাচালানকে কেন্দ্র করে সীমান্তের এই বিপত্তি। নির্বাচনী ফলে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বিজেপির যে সাফল্য লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে সীমান্তের আশপাশে যেসব বাংলাদেশির পৈতৃক ভিটা ও জমি আছে, তাঁদের ঝুঁকি বাড়বে বৈ কমবে না।
তৃতীয় উদ্বেগের কারণ রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতের অবস্থান। মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা জোরদার করার আশায় ভারত অদ্যাবধি জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক কোনো ফোরামেই রোহিঙ্গাদের জাতিগত নিপীড়ন এবং গণহত্যার বিচারের দাবিকে সমর্থন দেয়নি। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারের ওপর বাকি বিশ্ব চাপ সৃষ্টি করলেও চীনের মতোই ভারত এ বিষয়ে খুব একটা উৎসাহী নয়। ভারতের রোহিঙ্গা নীতি চীনেরই অনুরূপ, যার মূল কথা হচ্ছে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে কোনো একটা সমঝোতায় পৌঁছাক। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেওয়ার নীতিতেও উৎসাহিত হওয়ার কিছু নেই। কেননা, এই মানবিক সহায়তা উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনের জন্য মোটেও সহায়ক নয়, বরং তা তাদের অবস্থান দীর্ঘায়িত করার কারণ হতে পারে। মোদি সরকারের ধারাবাহিকতায় ভারতের এই নীতিতে পরিবর্তন আনা তাই বাংলাদেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়েই থাকবে।
চতুর্থত, তিস্তাসহ অভিন্ন নদীগুলোর পানি ভাগাভাগির প্রশ্নে সম্ভাব্য সমঝোতার বিষয়টিও জটিল হয়ে উঠতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির অভাবিত সাফল্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ তৈরি করায় তিনি যে তাঁর রাজ্যের স্বার্থরক্ষায় আরও কঠোর হবেন, সেই সম্ভাবনাই প্রবল। বিশেষ করে আগামী দুবছরের মধ্যে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা থাকায় ওই সময়টুকুতে তিস্তার প্রশ্নে তিনি কোনো ধরনের ছাড় দেবেন বলে মনে হয় না।
পঞ্চমত, ভারতের সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতার পরিচিতি হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের কারণে কার্যত বিলুপ্তির পথে এগিয়ে গেল। বিভিন্ন উগ্রবাদী হিন্দু দল-উপদলের কথিত নজরদারি (ভিজিল্যান্টিজম), হয়রানি এবং পিটিয়ে হত্যার ঘটনাগুলোর কারণে সংখ্যালঘু মুসলমানদের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে, তা আরও বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা নাকচ করা যায় না। এর প্রতিক্রিয়া দেশটির সীমান্তের বাইরেও সংক্রমিত হতে পারে। ফলে, বাংলাদেশে উগ্রবাদী ইসলামপন্থীদের তৎপরতা বাড়বে। এর পরিণতিতে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রশ্নে ভারতের উদ্বেগ বাড়বে। অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে ধারণা করা অন্যায় হবে না যে এর ফলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে তার প্রভাব বাড়বে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যথার্থই বলেছেন যে ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক প্রতিবেশীদের মধ্যকার সম্পর্কের রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, উভয় দেশের জনগোষ্ঠীর মধ্যে যোগাযোগ, নিরাপত্তা সহযোগিতা কিংবা সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মতো বিষয়গুলোতে গত ১০ বছরে যে নাটকীয় পরিবর্তন ঘটেছে, সরকার বদল না হওয়ার ধারাবাহিকতায় তা নিঃসন্দেহে আরও সংহত হবে। কিন্তু বাংলাদেশকে এই সুফল যথাযথভাবে পেতে হলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নীতি প্রয়োজনমতো ঝালিয়ে নেওয়ার (recalibration) কথাটাও ভাবা প্রয়োজন।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক