ভারতের এবারের ভোটের বিশেষত্ব কোথায়? প্রথমে উত্তর প্রদেশের পশ্চিমাঞ্চল ও পরে গোটা গুজরাট ঘুরে দিল্লি ফেরার পর নিজেই নিজেকে প্রশ্নটা করলাম। উত্তর পেতেও দেরি হলো না। সত্যি, এমন ‘একমুখী’ ভোট আমি অন্তত আগে দেখিনি।
ভারতের ভোট দেখছি মোটামুটি ১৯৭৭ সাল থেকে। সেবারের ভোটের প্রধান ইস্যু ছিল জরুরি অবস্থা। ইন্দিরা গান্ধীকে দিতে হয়েছিল তাঁর ভুলের মাশুল। ইন্দিরাকে সরিয়ে অন্যদের ওপর ভরসা করাও যে ছিল আরও একটা ভুল, তিন বছর পর ১৯৮০ সালে ভারতবাসী তার প্রমাণ দিয়েছিল। ফিরে এসেছিলেন ইন্দিরা। এর চার বছর পর তিনি নিহত হলেন। ইন্দিরার চিতার আগুন সারা দেশে বইয়ে দিয়েছিল সমবেদনার বন্যা। রাজীব গান্ধীর উত্থান ও পতনের ইতিহাস আমাদের জানা। কোন পরিস্থিতিতে ১৯৮৯ সালের ভোট হয়েছিল, জানা তা–ও। ব্যক্তি নয়, বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি বিষয়। দুর্নীতি। পরবর্তী ভোটগুলোও ছিল নিছক ইস্যুভিত্তিক এবং পার্টিগণিতের অঙ্ক। জোটবদ্ধতা নির্ধারণ করেছে জেতা-হারা ও সরকার গঠনের প্রশ্ন।
এসবের তুলনায় ২০১৪ সালের ভোট ছিল কিছুটা ভিন্ন। রাষ্ট্রীয় স্তরে একেবারে আনকোরা নরেন্দ্র মোদি স্বপ্নের ফেরিওয়ালা সেজে দুর্নীতি-দীর্ণ কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে ছুড়ে ফেলে দিলেন। জোট বেঁধে ভোটে লড়াই সত্ত্বেও স্রেফ নিজের দলের শক্তিতে ভর দিয়ে গড়ে তুললেন সরকার। পাঁচ বছর পর ভারতীয় ভোট-রাজনীতির যাবতীয় সংজ্ঞা অস্বীকার করে নরেন্দ্র মোদি আজ এক নতুন চালচিত্র তৈরি করেছেন, যেখানে তিনিই একমাত্র সত্য। বাকি সব অনিত্য।
অনিত্যের সেই তালিকায় রয়েছে তাঁর দল ভারতীয় জনতা পার্টি, তার ঘটনাবহুল ইতিহাস, সংঘ পরিবার, অতীত নেতৃত্ব, বিরোধী দলসমূহ ও তাদের তোলা বহুবিধ রাজনৈতিক ইস্যু। ভারতের কোনো লোকসভা ভোট কখনো এইভাবে ‘একের বিরুদ্ধে অনেক’ হয়ে ওঠেনি। কখনো এমন ‘একমুখী’ হয়নি। দেশের ৫৪৩টি কেন্দ্রে শাসক দল ও গোষ্ঠীর প্রার্থীরা আজকের মতো কখনো এইভাবে এলেবেলে হয়ে ওঠেননি। সব কেন্দ্রে একদিকে একটাই মুখ। নরেন্দ্র মোদি। বিপরীতে অন্যরা।
ভোটের সময় নিজের ইচ্ছামতো কেউ দেশের রাজনৈতিক ‘অ্যাজেন্ডা’ তৈরি করছেন এবং কিছুদিন পর পাল্টেও দিচ্ছেন, সেটাও আগে কোনো দিন দেখিনি। এটাকে সহজেই গোলপোস্ট সরানোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। একটা উদাহরণ দিই।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যেদিন ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট বাতিল করার সিদ্ধান্ত নিলেন, সেদিন ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর, রাত আটটায় জাতির প্রতি ভাষণে তিনি কালোটাকা উদ্ধারকে কারণ হিসেবে খাড়া করেন। সারা দেশে টাকার হাহাকার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠার সময় তিনি দ্বিতীয় কারণটা ছেড়ে দিলেন। বললেন, নোটবন্দীর জন্য সন্ত্রাসবাদীদের টাকার জোগান বন্ধ হয়ে যাবে। তাদের পালের হাওয়া আমি কেড়ে নিয়েছি। কিছুদিন পর তৃতীয়বারের মতো গোলপোস্ট সরিয়ে বলেছিলেন, নতুন নোট প্রযুক্তির দিক থেকে এতটাই মজবুত যে তা জাল করা যাবে না। ওমা, কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে জাল নোট ধরা পড়তে শুরু করল। এরপর তিনি চতুর্থবারের মতো গোলপোস্ট সরালেন। বললেন, সরকারের উদ্দেশ্য দেশকে ক্যাশলেস অর্থনীতি উপহার দেওয়া।
শেষমেশ দেখা গেল, যে পরিমাণ টাকা বাতিল হয়েছিল, তার প্রায় পুরোটাই রিজার্ভ ব্যাংকে জমা পড়েছে। অথচ সরকারের দাবি ছিল, চার থেকে পাঁচ লাখ কোটি কালোটাকা জমা পড়বে না। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের আসল কারণ কতটা অর্থনৈতিক আর কতটাইবা রাজনৈতিক, সে নিয়ে আজও দেশে গবেষণার শেষ নেই। বিরোধী নেতারা অনেকে অনেক কথা বলছেন। সে বিতর্ক নাহয় থাক।
অবিতর্কিত যা, তা হলো এবারের ভোট পুরোপুরি মোদিকেন্দ্রিক হয়ে ওঠা। এটা এমনি এমনি হয়ে ওঠেনি। অনেক ভাবনাচিন্তা করে খুব সুন্দরভাবে এটা গড়ে তোলা হয়েছে। উত্তর প্রদেশে প্রথম দেখি, তারপর গুজরাটেও, কোথাও কোনো কেন্দ্রে কোনো হোর্ডিংয়ে অটল বিহারি বাজপেয়ি, লালকৃষ্ণ আদভানি অথবা দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ছবি নেই! অতীত গরিমাকে অস্বীকার করে ভোটকে এইভাবে ‘একমুখী’ করে তোলার মধ্য দিয়ে মোদি স্থানীয় প্রার্থীদেরও গৌণ করে তুলেছেন। ঘুরে ঘুরে দেখছি, অধিকাংশ ভোটারকে বলতেও শুনেছি, এটা প্রধানমন্ত্রী বাছাইয়ের ভোট। বহু মানুষ স্থানীয় প্রার্থীর নামও জানেন না। প্রশ্ন করলে বলেছেন, ‘ভোট তো দেব মোদিকে’।
কেন মোদিকে? একেক জায়গায় একেক রকমের উত্তর। উত্তরগুলো সাজালে তালিকার প্রথমেই রাখতে হবে মোদির ‘দৃঢ় নেতৃত্ব’। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি শক্তপোক্ত, তিনি কঠিন সিদ্ধান্ত (বালাকোট) নিতে দেরি করেন না, পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দেওয়ার ক্ষমতা তাঁরই আছে, এই ধারণা বহু মানুষের মনে গেঁথে গেছে। এ ছাড়া ‘উজ্জ্বলা’, ‘প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা’র পাশাপাশি বিদেশে ভারতের ‘মাথা উঁচু’ করার কৃতিত্বও অনেকে তাঁকে দিচ্ছে। শহরাঞ্চল তো বটেই, গ্রামেও যেখানে কৃষক ক্ষোভ চূড়ান্ত, সেখানেও কিছু মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা জন্মেছে যে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আরেকবার সুযোগ তাঁর পাওয়া উচিত। তারপর না হয় মূল্যায়নে বসা যাবে।
সেই সুযোগ তিনি যে পাবেন না, খুব জোর দিয়ে সে কথা বলা যাচ্ছে না। মোদি জমানায় যে তিন রাজ্য বিজেপির কাছ থেকে কংগ্রেস ছিনিয়ে নিয়েছে, সেই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে বিজেপির ফল গতবারের তুলনায় খারাপ হলেও কংগ্রেস কিন্তু বিজেপিকে শুইয়ে দেওয়ার মতো অবস্থায় যেতে পারেনি। এই তিন রাজ্যের সঙ্গে গুজরাট মোট ৯১ আসনের মধ্যে বিজেপি গতবার পেয়েছিল ৮৮। গুজরাটের ২৬টির মধ্যে কংগ্রেস লড়াইয়ে রয়েছে মাত্র ৮টি আসনে। এগুলোর মধ্যে ৫-৬টি পেলে সেটাই তার সাফল্য ধরা হবে। মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে দুই দলের লড়াই টান টান। বিধানসভার ভোটে রাজ্য নেতাদের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ দেখা দিয়েছিল, লোকসভার ভোটের ছবিটা বিজেপির পক্ষে, কিন্তু তেমন করুণ নয়। একমাত্র ছত্তিশগড়ে বিজেপি তার প্রার্থী তালিকার খোলনলচে বদলে দিয়েছে। সব প্রার্থীই সেখানে নতুন। কংগ্রেস এখানে ভালো ফলের আশা করতেই পারে।
উত্তর ভারতে কংগ্রেস তার আসন বাড়াবে। বিজেপির কমবে। কিন্তু তা সত্ত্বেও মোদির মাহাত্ম্যে তেমন টোল কোথাও প্রায় খায়নি। হ্যাঁ, প্রতিশ্রুতিমতো চাকরি তিনি দিতে পারেননি। কৃষি সমস্যার সুরাহাও করতে পারেননি। কালোটাকা দেশে এনে প্রত্যেকের ব্যাংক খাতায় ১৫ লাখ করে জমাও করেননি। রাফাল নিয়ে কংগ্রেসের প্রচার তীব্র। ‘চৌকিদার চোর’ স্লোগানও বেশ জনপ্রিয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও কংগ্রেস আমলে দুর্নীতির অভিযোগ যেভাবে জনমনে ছায়া ফেলেছিল, রাফাল ততটা পারেনি। সন্দেহ যে জাগেনি তা নয়, কিন্তু তাতে মোদির উঁচু মাথা বিশেষ খাটো হয়নি। পাঁচ বছর আগে মোদি হাওয়ায় আর্যাবর্তে বিরোধীরা উড়ে গিয়েছিল। এবার সেই হাওয়া না থাকলেও মোদির বিরুদ্ধে মানুষ যে ক্ষুব্ধ, তেমন প্রমাণও পাইনি। বিরোধিতা যতটুকু, তা জোটবদ্ধতার পার্টিগণিতে। উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খন্ড, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকের জোট পার্টিগণিত ঠিক করে দেবে, গতবারের তুলনায় কতগুলো আসন বিজেপির খাতায় কম জমা পড়বে।
জোটবদ্ধতার চ্যালেঞ্জ উত্তর প্রদেশ, বিহার ও ঝাড়খন্ডে যতটা, মহারাষ্ট্র ও কর্ণাটকে ততটা নয়। গোবলয়ের ঘাটতি পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশা মেটাতে পারবে না। কংগ্রেস এই ভোটে তার আসন অবশ্যই দ্বিগুণ করবে। বিজেপির আসনও কমবে। এই বাড়া-কমা কতটা, ভারতবাসী তা দেখার অপেক্ষায়।
এই প্রথম লোকসভার কোনো ভোট দেশের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে-বিপক্ষে গণভোটের রূপ নিল। নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি নিজেই ভোটকে ‘মোদিময়’ ও ‘একমুখী’ করে তুলে তাকে গণভোটে পরিণত করেছেন। আরও একবার সরকার গড়লে সেটা হবে তাঁর একার কৃতিত্ব, না পারলে পরাজয়। ভারতের আর কোনো প্রধানমন্ত্রী নিজেকে নিয়ে কখনো এভাবে বাজি ধরেননি।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি