এমন কোনো দিন নেই যেদিন পত্রিকার পাতা খুললে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির খবর নেই। কোনো কোনো দিন খবর হয় একই পরিবারের একাধিক লোক নিহত। একটি পরিবার প্রায় নিশ্চিহ্ন, এমন হৃদয়বিদারক খবরও পড়তে হয়। বরযাত্রীর গাড়িবহর সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়ায় কয়েকজন নিহত বা আহত হয়ে সব হাসি-আনন্দ নিমেষে শেষ। আগামীকাল বিয়ে, আজ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত। দুই যুগ পর বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন মায়ের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু এয়ারপোর্ট থেকে বাড়ি যাওয়ার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত।
খেয়াল করলে দেখা যায়, প্রতিদিনের এসব দুর্ঘটনার মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ঘটনায় মোটরসাইকেল জড়িত থাকেই। এসব দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলের এক বা একাধিক যাত্রী নিহত হন। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে কমই আছে, যেখানে চালক রক্ষা পান। মাত্র কয়েক দিন আগে ঢাকার উত্তরাতে মোটরসাইকেল আরোহী ত্রিশের কোঠার দুই ভাই বাসের ধাক্কায় নিহত হন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় যাঁরা মারা যান, তাঁরা যুবক ও কিশোর বয়সী।
বাংলাদেশের ঘরে ঘরে একজন কিশোর যুবক হতে না হতেই মা-বাবার কাছে বায়না ধরে একটা মোটরসাইকেলের। মা-বাবা ছেলেকে শিগগির এই বাহনটি কিনে দিতে চান না। তাঁরা জানেন এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ বাহন। এমন কোনো মা-বাবাই পাওয়া যাবে না, যাঁরা অতি আদরে বড় করা সন্তানকে জেনে-বুঝে দেড়-দুই লাখ টাকা খরচ করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে চান। শেষ পর্যন্ত যদি মা-বাবাকে রাজি করিয়ে ছেলে একটা মোটরসাইকেল কিনে ফেলতে পারে, তবে বাহনটির সঙ্গে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে সবাইকে জানিয়ে দেয় অনেক দিনের আশা পূরণ হওয়ার খবর। এ থেকে ছেলের মোটরসাইকেল কেনার আকাঙ্ক্ষা কতটা প্রবল ছিল, তা বোঝা যায়।
এ ধরনের ক্ষেত্রে মোটরসাইকেলটি আসলে প্রয়োজনীয় কিছু নয়। তবে পরিবারে একটা মোটরসাইকেল থাকলে কাজে যে লাগে না, তা তো নয়। কিন্তু এর পেছনে কতটা মৃত্যুঝুঁকি আছে, তা নিয়ে ভাবার ফুরসত ছেলের নেই। বাসা থেকে কলেজ হয়তো কাছে কিন্তু রাজপথের রাজা হওয়ার জন্য মোটরসাইকেল লাগে। মোটরসাইকেল থাকলে বন্ধু-বান্ধব নিয়ে চলাফেরা করা খুব সহজ হয়। মা-বাবা কিনে না দিতে চাইলে ছেলে বাড়িতে মাঝেমধ্যে অনশন ধর্মঘটও করে থাকে। ফলাফল অনেক ক্ষেত্রে খুব বেশি দুঃখজনক ঘটনার জন্ম দেয়। পত্রিকায় এমনও পড়েছি, মা-বাবাকে শত জোরাজুরির পর যেদিন মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছিলেন, তার পরদিন ছেলে রাস্তায় প্রথমবার নেমেই দুর্ঘটনা ঘটিয়ে বন্ধুসহ পরপারে। এই মা-বাবার সান্ত্বনা দেওয়ার কোনো ভাষা কারও জানা আছে বলে মনে হয় না। শুধু মা-বাবা কেন, দেশের একজন কিশোর বা যুবক এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারালে জাতির হয় অপূরণীয় ক্ষতি।
গ্রামগঞ্জে এলজিইডির সড়ক ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মোটরসাইকেলের ব্যবহার বাড়ছে। অনেক যুবক রাস্তায় নেমে পড়ে দুই পয়সা রোজগার করছেন। গ্রামগঞ্জে দুর্ঘটনা কম হলেও হাইওয়ে ও আন্তজেলা সংযোগ-সড়কে বেশি। মহাসড়কে মোটরসাইকেল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ একটি বাহন।
বাংলাদেশে মোটরসাইকেল বলতেই ১০০-১৫০ সিসির একটি যান। এটাই একটি বড় সমস্যা। ভিয়েতনামে এই বাহন এতই জনপ্রিয় যে দেশের প্রতি দুজন লোকের একটি মোটরসাইকেল আছে। কিন্তু আসলে সেগুলো মোটরসাইকেল নয়, ৫০ সিসির স্কুটার, যা মোটরসাইকেলেরই আদলে বানানো। তবে অপেক্ষাকৃত ছোট। রাজধানী হ্যানয় শহরের যেকোনো ক্রসিংয়ে কর্মদিবসে সকালের ব্যস্ত সময়ে দেখা যায় হাজার হাজার স্কুটার কোনো এক দিকে সবুজ সিগন্যালের অপেক্ষায়। কিন্তু এর মধ্যে একটিও ১০০-১৫০ সিসির মোটরসাইকেল খুঁজে পাওয়া যাবে না। সবই ৫০ সিসি স্কুটার। জাপানে ৫০ সিসি স্কুটার নারীরা পারিবারিক কাজে ও ইউনিভার্সিটি পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা নিজ এলাকায় ব্যবহার করেন। বাংলাদেশে একটি স্কুটারের মূল্য ৫০ হাজার টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এর তেল খরচও খুব কম। স্কুটার একটি গোবেচারা টাইপের বাহন, যা ২০-৩০ কিলোমিটার বেগে চালানো হয়। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা খুব কম। স্কুটার চালানোর লাইসেন্স প্রদানও খুব সহজ হতে পারে। ৫০ সিসির বাহন বলে শুধু লিখিত পরীক্ষায় পাস করলেই লাইসেন্স দেওয়া যায়। কারণ, বাহনটি চালানো খুবই সহজ, তবে ট্রাফিক সিগন্যালগুলো জানা সবার জন্যই জরুরি।
মোটরসাইকেল নয় বরং ভিয়েতনামের মতো স্কুটার ব্যবহার বাংলাদেশের জন্য অনেক কার্যকরী হতে পারে। ভিয়েতনামের সঙ্গে বাংলাদেশের অবকাঠামোগত মিল আছে। দূরপাল্লার যাত্রা নয়, বরং স্থানীয় চলাচলে একটি ৫০ সিসি স্কুটার যথেষ্ট। বাংলাদেশে স্থানীয় চলাচলেও সর্বত্র দেখা যায় মোটরসাইকেল। একটি মোটরসাইকেলের দামের তুলনায় একটি স্কুটারের দাম যেমন তিন ভাগের একভাগ, তেমনি রক্ষণাবেক্ষণের খরচও অনেক কম। তা ছাড়া, ৫০ সিসি স্কুটারগুলো খুবই নারীবান্ধব। যেকোনো নারী এই বাহন ব্যবহার করে সহজেই কর্মক্ষেত্রে যেতে পারবেন। শহরে যেমন তেমনি উপজেলা পর্যায়েও এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে এই বাহন নিয়ে আসা-যাওয়া সম্ভব। উপজেলা পর্যায়ে নারী স্কুলশিক্ষকেরা সহজেই এই বাহন ব্যবহার করতে পারেন।
যাকে দূরপাল্লার সড়ক বা মহাসড়কে যাতায়াত করতে হয়, তিনি বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেল ব্যবহার করবেন। তবে যানবাহন চালানোতে ধৈর্যশীল হওয়ার বিকল্প নেই, যার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কম গতিতে (২০-৩০ কিলোমিটার) চলা। দরকার না হলে বা অল্পস্বল্প দরকারে ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনটি ব্যবহার না করা ভালো। নিজ এলাকার মধ্যে যাতায়াতে ৫০ সিসি স্কুটারের ব্যবহার ভিয়েতনামের মতো বাংলাদেশেও জনপ্রিয় করার উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
ড. আলী আকবর মল্লিক: কাঠামো প্রকৌশলী ও ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ