মোটরসাইকেলে কড়াকড়ি কি পুলিশের ঘুষ–বাণিজ্য বাড়িয়ে দেবে?

ঈদের আগে বাড়ি পৌঁছাতেই হবে। যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছাড়ছে, ছাড়ছে বিভাগীয় ও জেলাশহরও। বাস ও ট্রেনের টিকিটের জন্য হাহাকারও সেই ঈদযাত্রাকে ঠেকিয়ে রাখার কোনো সুযোগ নেই। শত কষ্ট হলেও, নানা ত্যাগ–তিতিক্ষার মাধ্যমে প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে শহর ছাড়তেই হবে। এ যাত্রা মাটি ও প্রকৃতির কাছেও ফেরা। শেকড়ের কাছেও ফেরা। নাড়ির কাছে ফেরা। ফেরা পৃথিবী ছেড়ে যাওয়া প্রিয়জনের কবরের সামনে দাঁড়ানোরও। নাগরিক জীবনের নানা বাস্তবতায় অনেকের জন্য সারা বছরে গ্রামে যাওয়ার জন্য ঈদের ছুটিই একমাত্র সুযোগ।

ফলে শত ঝুঁকি নিয়ে হলেও ফিরতে হবে মানুষকে। এ জন্য আমরা দেখি, একটি মোটরসাইকেলে দুই ছোট শিশুপুত্রসহ গাদাগাদি করে রওনা দিয়েছেন এক দম্পতি। গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোতে বড় করে সেই ছবি ছাপানো হয়েছে। রাজধানীর গাবতলী থেকে তোলা। যাতে দেখা যাচ্ছে, চারজনের মাথাতেই হেলমেট পরা থাকলেও, চালক বাবা হাতে পায়ে যথেষ্ট সুরক্ষা নিলেও তার সামনে বসা ছোট শিশুটি ঘুমে কিছুটা বাবার হাতে গা এলিয়ে দিয়েছে। ছবিটি দেখেই যে কারও মনে হতে পারে, কী বিপজ্জনক যাত্রা!

ঠিক একদিন আগে এ দম্পতির মতোই ঈদযাত্রায় দিনাজপুর থেকে গ্রামের বাড়ি চাপাঁইনবাবগঞ্জের দিকে রওনা দিয়েছিলেন আরেক দম্পতি। সঙ্গে ছিল দুই শিশু ছেলে–মেয়ে। তেলবাহী একটি লরি মোটরসাইকেলটিকে ধাক্কা দিলে সড়কেই নিমিষেই শেষ হয়ে গেল পরিবারটি। মারা যান দুই শিশু ও তাঁদের মা।

এমন মর্মান্তিক উদাহরণ প্রতিনিয়তই আমরা পাই। ঈদযাত্রায় সেটি হয় আরও বেশি বেদনাদায়ক। রোড সেইফটি ফাউন্ডেশনের এক জরিপ বলছে, গত ঈদুল ফিতরের সময় ১২৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৫৬ জন। সংস্থাটির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্তে এ ৬ মাসে দেশে মোট সড়ক দুর্ঘটনায় যত মানুষ মারা গেছেন, তার প্রায় ৪০ শতাংশই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার কারণে।

যার কারণে এবারের ঈদে মহাসড়কে বিশেষত ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল চলাচলের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে সরকার। স্বাভাবিকভাবে ঈদুল আজহার আগে সবচেয়ে বেশি আলোচনা থাকে কোরবানির পশু নিয়ে, চায়ের দোকান থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তেমনটিই দেখি আমরা। এবার সেখানে জায়গা করে নিয়েছে মোটরসাইকেল। এ নিয়ে তর্ক–বিতর্কের শেষ নেই। মোটরসাইকেল চালকেরা অনেক জায়গায় বিক্ষোভও করেছেন।

গত রোববার সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে এক জরুরি সভা শেষে ঘোষণা আসে, ঈদের আগে তিন দিন, ঈদের দিন ও ঈদের পর তিন দিন—মোট সাতদিন এক জেলা থেকে আরেকজেলায় মোটরসাইকেল চলাচল করতে পারবে না। তবে যৌক্তিক ও অনিবার্য কারণে পুলিশের অনুমতি নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো যাবে। একই সময়ে ভাড়ায়চালিত মোটরসাইকেল (রাইড শেয়ারিং) মহাসড়কে চলতে পারবে না। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে বিব্রত পুলিশ। কারণ, এমন আদেশের আগে পুলিশের কোনো মতামতই চাওয়া হয়নি বলে পুলিশ সদর দপ্তরে আয়োজিত ত্রৈমাসিক অপরাধ পর্যালোচনায় সভায় বলেছেন কর্মকর্তারা ( ৭ জুলাই, বাংলাদেশ প্রতিদিন)। এখন মহাসড়কে চেকপোস্ট বসিয়ে মোটরসাইকেল আটকাতে গেলে সেটি যানজটের কারণ হতে পারে। তাছাড়া কোনটি রাইড শেয়ারিং আর কোনটি ব্যক্তিগত সেটি যাচাই–বাছাই করার সুযোগও পুলিশের কাছে নেই।

ফলে পুলিশের পক্ষে থেকে ঘোষণা আসে, মহাসড়কে যৌক্তিক কারণ দেখিয়ে মোটরসাইকেল চালানোর জন্য নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করতে হবে। মহানগরগুলোর পুলিশের ট্রাফিক বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) কার্যালয় ও জেলার ক্ষেত্রে পুলিশ সুপার (এসপি) কার্যালয় এবং প্রতিটি জেলার থানা ও তদন্ত কেন্দ্রে গিয়ে পাওয়া যাবে এই ফরম। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুলিশ কর্মকর্তাদের ‘বুদ্ধিমত্তা’ দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতেও বলা হয়েছে। এর মধ্যে নাগরিক মনে প্রশ্ন ওঠেছে, মোটরসাইকেলে এই কড়াকড়ি মহাসড়কে পুলিশের ঘুষ–বাণিজ্য বাড়িয়ে দেবে না তো? সেখানে পুলিশের ‘বুদ্ধিমত্তা’ ঘুষের মাধ্যমে পরিচালিত হওয়াটা একেবারেই অস্বাভাবিক নয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেরসক নাগরিক এমন মন্তব্যও করেছেন—তেলে নয়, মোটরসাইকেল চলবে ঘুষে।

গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না এনে, বিআরটিএ’র সক্ষমতা তৈরি না করে, ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল বন্ধ না করে, দুর্ঘটনার জন্য মালিক ও চালককে শাস্তির আওতায় না এনে, সড়কে অবৈধ বাস–ট্রাকের স্ট্যান্ড উচ্ছেদ না করে, মালিক–চালক–শ্রমিক সমিতি ও পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ না করে, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ না করে, পদে পদে যাত্রী হয়রানি বন্ধ না করে শুধু মোটরসাইকেলের ওপর কড়াকড়ি কোনোভাবেই সমাধান হতে পারে না। এ যেন মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলারই নামান্তর।

আমরা দেখতে পাচ্ছি, কড়াকড়ি শুরু হওয়ার আগেই অনেকে মোটরসাইকেল নিয়ে ঈদযাত্রায় শুরু করে দিয়েছেন। শত চেষ্টার পরেও বাস–ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করতে না পারা, বাসের টিকিটের বাড়তি ভাড়া আদায়, ঢাকায় মোটরসাইকেল রেখে বাড়ি যাওয়া নিরাপদ না—এমন সব কারণে অনেক মানুষ ইতিমধ্যে মোটরসাইকেলে করে গন্তব্যে রওনা দিয়েছেন (৭ জুলাই, দৈনিক ইত্তেফাক)। সেই সংখ্যাটা কত আমরা এখনও জানি না।

রোড সেইফটি ফাউন্ডেশন গত মে মাসে জানিয়েছিল, রোজার ঈদে গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে ঢাকা থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ মোটরসাইকেলে বিভিন্ন জেলায় গিয়েছিল। অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোর হিসাব ধরলে সংখ্যাটা নিশ্চয়ই আরও বড় হতো। বাড়ি ফিরতে সেবারই অন্যান্য বছরের তুলনায় মোটরসাইকেলের ব্যবহার ছিল বেশি (২২ মে, বিডি নিউজ ডট কম)। বিপুলসংখ্যক মানুষের ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলকে বেছে নেওয়ায় সেবার বাসের যাত্রী কমে গিয়েছিল বলে খবর হয়। সে কারণে এবারের ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলের ওপর কড়াকড়িতে বাসমালিকদের যোগসাজস আছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে। এ দেশের পরিবহনমালিক ও সরকারের যে স্বার্থসংশ্লিষ্ট যোগসূত্রতা আমরা দেখি, তাতে এ অভিযোগ একেবারেই অযৌক্তিক নয়। মোটরসাইকেলে করে রওনা দেওয়া এক যাত্রী বলছেন, ‘ট্রেনের লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট পাইনি। অন্যদিকে বাসের থেকেও মোটরসাইকেল জার্নি অনেক ভালো। আমার মনে হয়, বাসমালিকদের খপ্পরে পড়ে মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ করা দেওয়া হয়েছে’ (৭ জুলাই, দৈনিক ইত্তেফাক)।

এখন মোটরসাইকেল চলাচলে কড়াকড়ির কারণে বাসের টিকিটের জন্য আরও বেশি হাহাকার লেগে গিয়েছে। বাসটিকিটের মূল্য আরও বেশি চড়া হয়ে দ্বিগুণ (৮ জুলাই, দৈনিক প্রথম আলো)। গত রোজার ঈদের চেয়ে এবারে মোটরসাইকেল ব্যবহার কিছুটা কমলেও সেই সংখ্যাটা নিঃসন্দেহে অনেক বড়ই হবে। কারণ ঈদের আগের দুই দিনে প্রতিদিন গড়ে ২৫ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ে আর বাস, ট্রেন, লঞ্চে করে দিনে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা আছে সাড়ে দশ লাখের। ফলে কড়াকড়িকে উপেক্ষা করেও অনেকে মোটরসাইকেল নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা দেবেন বা দিচ্ছেন। যেমন, ঢাকার মিরপুর এলাকার এক চাকরিজীবী মোটরসাইকেলে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে সিরাজগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘ঈদের আগে বাসের কোনো টিকিট পাইনি। এখন যে বাসগুলো আছে, সেগুলোয় অনেক ভিড়। তাই স্ত্রী ও সন্তানকে নিয়ে মোটরসাইকেলেই বাড়ি যাচ্ছি’ (৭ জুলাই, প্রথম আলো)।

গণপরিবহনের নৈরাজ্যের কারণে এ ছাড়া প্রিয়জনের সাথে ঈদ করতে যাওয়ার জন্য আর কী উপায় আছে। আবার কয়জনেই বা আসতে–যেতে পুলিশের ফরম পূরণ করতে যাবেন। গেলেও কয়জনই বা তাদের যৌক্তিক কারণ প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন কিংবা সেটি বুঝতে সক্ষম হবে পুলিশ। সেখানে ঘুষই পারে গোটা বিষয়টি মুহুর্তেই মীমাংসা করতে। আর এটি নিশ্চিত করে বলা যায়, পুলিশের হাতে কিছু গুজে দিলেই হবে—এমন ধারণা থেকে ফরমের তোয়াক্কা না করেই মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় নেমে পড়বেন চালকেরা। মহাসড়কে গাড়ি আটকিয়ে পুলিশের টাকা নেওয়ার বিষয়টি তো এ দেশে ‘প্রতিষ্ঠিত’ বিষয়। মোটরসাইকেলের ক্ষেত্রে অনেক সময় সেটি আরও বেশি, যার কারণে রাগে ক্ষোভে আগুন দিয়ে মোটরসাইকল জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনাও দেখেছি আমরা। এমনও হতে পারে, এবারের ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেলে কড়াকড়ি ও পুলিশি বাধার কারণে জনরোষও তৈরি হতে পারে। কথা হচ্ছে, এরপরেও কি সড়ক দুর্ঘটনা কমবে? ঈদযাত্রায় মহাসড়কে দ্রুতগতির মোটরসাইকেল থামাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি আরও বাড়বে বলেই মনে করছে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি (৬ জুলাই, দৈনিক প্রথম আলো)। তবে সর্বশেষ খবর বলছে, কোনো বাধাহীনভাবে মোটরসাইকলের ঢল নেমেছে ঈদযাত্রায়। এটি অবশ্যই স্বস্তিদায়ক। আবার দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে ভর করে আশঙ্খাও।

তবে গণপরিবহনে শৃঙ্খলা না এনে, বিআরটিএ’র সক্ষমতা তৈরি না করে, ফিটনেসবিহীন গাড়ির চলাচল বন্ধ না করে, দুর্ঘটনার জন্য মালিক ও চালককে শাস্তির আওতায় না এনে, সড়কে অবৈধ বাস–ট্রাকের স্ট্যান্ড উচ্ছেদ না করে, মালিক–চালক–শ্রমিক সমিতি ও পুলিশের চাঁদাবাজি বন্ধ না করে, ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি বন্ধ না করে, পদে পদে যাত্রী হয়রানি বন্ধ না করে শুধু মোটরসাইকেলের ওপর কড়াকড়ি কোনোভাবেই সমাধান হতে পারে না। এ যেন মাথাব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলারই নামান্তর।

  • রাফসান গালিব প্রথম আলোর সহসম্পাদক