দিল্লির চিঠি

মৈত্রী আলোচনা ও মোদির সফর

নরেন্দ্র মোদি
নরেন্দ্র মোদি

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ভারতের সংসদে সীমান্ত বিল পাস করানোর সময় বলেছিলেন, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক ১৯৭১ সালে যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সেই উচ্চতায় আবার পৌঁছে যাবে। কথাটা বলার সময় তাঁর স্বরে আবেগের ছোঁয়া ছিল। সেই আবেগ ছুঁয়ে যায় সভায় উপস্থিত সবাইকে। মনে পড়ছে, রাজ্যসভায় প্রথম দিন বিল পাস হওয়ার সময় এক অবাঙালি সদস্য মুক্তিযুদ্ধের সময় বিখ্যাত হওয়া ‘শোনো একটি মুজিবরের কণ্ঠে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি’ গানটি গাইতে গাইতে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন। আবেগ, আবেগ আর আবেগে ভেসেছিল লোকসভাও, পরের দিন। সৃষ্টি হয় ইতিহাস। সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে আর কখনো কোনো সংবিধান সংশোধন বিল এত ভালোবাসা, এত আবেগ ও এত স্মৃতিমেদুরতায় আচ্ছন্ন হয়ে সর্বসম্মতভাবে পাস হয়নি। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক কেন অবিচ্ছেদ্য, তা বুঝতে দেরি হয় না।
সীমান্ত বিল পাস করিয়ে জুন মাসেই যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রথম বাংলাদেশ সফরে যাওয়ার জন্য জেদ ধরেছিলেন, সেই হাঁড়ি হাটে ভেঙে দেন আবার মোদিরই অতি কাছের রাম মাধব। মোদির মতোই রাম মাধব রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘে দীক্ষিত। টিম-মোদির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সদস্য তিনি। তার ওপর বিজেপির সর্বভারতীয় সম্পাদক এবং ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশনের পরিচালক। দিল্লিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ ষষ্ঠ মৈত্রী আলোচনার তিন উদ্যোক্তার একজন ছিল রাম মাধবের ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন। আলোচনার শেষ দিন মোদির ইচ্ছা ও জেদের কথাটা বলে দিয়ে রাম মাধব বলেছিলেন, ‘সীমান্ত বিল নিয়ে এক বছর আগেও অন্য অনেকের মতো আমিও সংশয়ী ছিলাম। আপত্তি ছিল। কিন্তু এই বিল পাসের প্রয়োজনীয়তা কতটা, মোদি তা বুঝেছিলেন এবং আমাদের বোঝাতে পেরেছিলেন।’ এটাই মোদির নেতৃত্বের মূল কথা। তিনি একজন শক্তিশালী নেতা। তিনি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন। এটা তিনি স্পষ্ট বুঝেছেন, দেশের পশ্চিম প্রান্তের মতো অশান্ত যদি পূর্ব প্রান্তও থাকে, ভারতের বিকাশ তাহলে কিছুতেই সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের বিস্তীর্ণ উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বেশ কয়েক বছর ধরে স্বস্তিতে রেখেছেন। তাঁর দেশে তাঁর নেতৃত্বও শক্তিশালী ও প্রশ্নাতীত। দুই শক্তিশালী নেতা-নেত্রী হাতে হাত মিলিয়ে দুই দেশের ভাগ্যই যে শুধু গড়তে পারবেন তা নয়, সন্ত্রাস ও মৌলবাদীদের মোকাবিলাও করা যাবে কঠোর হাতে।
মনোভাবের এই পরিবর্তনের পেছনে যাদের কৃতিত্ব, মৈত্রী আলোচনার উদ্যোক্তারা তাদের অন্যতম। ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ, যারা এই মৈত্রী আলোচনার প্রধান উদ্যোক্তা, তারা কয়েক বছর ধরেই দুই দেশের সহযোগিতা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রটাকে বিস্তৃত করতে সচেষ্ট। কূটনীতির পরিভাষায় এটাই ‘ট্র্যাক টু ডিপ্লোমেসি’। কলকাতা, ঢাকা, আগরতলা ও দিল্লিতে বছরে অন্তত দুবার করে আলোচনা ও মতবিনিময়ের মাধ্যমে এই সংস্থা দুই দেশের সরকারকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রভাবিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘থিংক ট্যাংক’ বলে যাঁরা পরিচিত, দুই দেশের সেই প্রভাবশালীদের সঙ্গে পারস্পরিক মতবিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধানের জন্য সরকারের কাছে পেশ করার সেই চেষ্টা যে অনেকটাই সফল, এবারের মৈত্রী আলোচনা তার প্রমাণ। সম্ভাবনা কতখানি, বিপদও কতটা ভয়ংকর এবারের দুই দিনের আলোচনায় সেই বিষয়গুলো প্রকটভাবে উঠে এসেছে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর এই আলোচনায় অংশ নিয়ে সম্ভাবনা ও আশঙ্কার ব্যাখ্যা করে তাই বলেছেন, ‘আমাদের দুই দেশের সামনেই দুটি পথ খোলা। একদিকে পারস্পরিক সহযোগিতার অপার সম্ভাবনা, যা দুই দেশকেই এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতাজনিত অশান্তি, সন্দেহ ও সংশয়ের আবহ, যা কাউকেই জিততে দেবে না। কোন রাস্তায় আমরা হাঁটব, তা আমাদেরই ঠিক করতে হবে।’ জয়শঙ্করের এই কথারই জবাব দেন ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী তাঁর ভাষণে। বলেন, ‘রাস্তা আমরা বেছেই নিয়েছি। সেই রাস্তা বন্ধুতার, বিশ্বাসের, উন্নয়নের, প্রগতির ও সহযোগিতার।’
কোনো দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কই এক দিনে গড়ে ওঠে না। সম্পর্কেরও একটা ইতিহাস থাকে। ধারাবাহিকতা থাকে। সম্পর্ক লালন করতে হয়। রক্ষা করতে হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের ওঠানামাও হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু তা হলেও ভারতের পূর্বাঞ্চলের ভাষাগত ও চরিত্রগত মিলের জন্য হৃদয়ের সঙ্গে হৃদয়ের মিলমিশে কখনো ঘাটতি দেখা যায়নি। বাংলাদেশকে তিন দিক দিয়ে ঘিরে থাকা ভারতীয় রাজ্যগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্কে তাই ভাটাও পড়েনি কখনো। ইউপিএর সময় থেকে যে বিশ্বাস ও সহযোগিতার বাতাবরণের সৃষ্টি, ভারতে পালাবদলের পর তাতে ছেদ পড়বে বলে যে আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল, তা ক্ষণিকের মধ্যেই উবে গেছে নরেন্দ্র মোদির বিচক্ষণতায়। জুন মাসে তাঁর সফর সম্পর্কের এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে আশা করি।
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে বেশ কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রগুলোয় সহযোগিতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। সীমান্ত বিল পাস হয়ে যাওয়ায় সীমান্ত ব্যবস্থাপনা, সীমান্ত বরাবর শান্তি বজায় রাখা একটা বড় ব্যাপার। ইতিকর্তব্যগুলোর অন্যতম এটি। সীমান্তে গুলি ও হত্যা বাংলাদেশের কাছে এক অতীব স্পর্শকাতর বিষয়। প্রতিবারের আলোচনায় এই বিষয়টি বড় হয়ে ওঠে। দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর মধ্যে বোঝাপড়া গত কয়েক বছরে চমৎকার বেড়েছে। দুই দেশই সীমান্তে ‘জিরো কিলিং’-এর পক্ষে। তবু সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামছে না কেন? এই প্রশ্নের উত্তর এবারের আলোচনায় খোলাখুলি দিয়েছেন কলকাতার মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর শ্রীরাধা দত্ত। তিনি বলেন, সীমান্তের এপার-ওপারের দশ-পনেরো কিলোমিটার অঞ্চল অপরাধমুক্ত করা না গেলে এই হত্যাও থামবে না। প্রতিটি হত্যার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ যে থাকে, তা অস্বীকার করা মূর্খামি। সেই কারণ, যা চোরাকারবারিদের সক্রিয় রেখেছে, তার মীমাংসা হওয়া বেশ জরুরি।
দ্বিতীয় বিষয় নদী-সম্পদের ব্যবস্থাপনা ও জলের নিরাপত্তা। তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হতে হয়তো আরও কিছুদিন লাগবে। কিন্তু শুধু তিস্তাই নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে দুই দেশের অভিন্ন নদীগুলোর ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিতে হবে। সম্পর্কের খিলান মজবুত করার লক্ষ্যে এটা অন্যতম। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও দুই দেশ সহযোগিতার একটা বড় উদাহরণ রাখতে পারে। বাংলাদেশ আজ যে পরিমাণ বিদ্যুৎ ভারত থেকে কিনছে, তা আগামী দিনে অনেক বেড়ে যাবে। শুধু তা-ই নয়, ভারত-নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ একযোগে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বণ্টনের ক্ষেত্রে অংশীদারত্ব নেওয়ার মতো জায়গায় এসে পৌঁছেছে। এটা তৃতীয় বিষয়। চতুর্থ বিষয় যোগাযোগ। বিভিন্ন ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা, যা একদা অভিন্ন এই দেশে ছিল, পারস্পরিক সহযোগিতায় তা নতুনভাবে চালু হয়ে দুই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার ঘটাতে পারে। স্থলপথ, নদীপথ ও সমুদ্রপথের মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটলে ভারত-নেপাল-ভুটান-বাংলাদেশ সার্কের মধ্যে এক নতুন অক্ষ হিসেবে পরিচিত হবে। পঞ্চম বিষয় এটারই বিস্তারের দিক। আন্তদেশীয় হাইওয়ে, রেলব্যবস্থা, সমুদ্রবন্দর, উপকূলবর্তী জাহাজ চলাচল আঞ্চলিক উন্নয়নে এক অন্য মাত্রা এনে দেবে। ষষ্ঠ বিষয় উৎপাদন ও পরিষেবা ক্ষেত্রে লগ্নি। ভারতকে এ জন্য একটি পৃথক বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাংলাদেশ দেবে। এই সফরেই তা ঘোষণা হতে পারে। সপ্তম বিষয়ে রয়েছে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সহযোগিতা যা অশিক্ষা, কুশিক্ষা, অসুখ ও অজ্ঞান দূর করবে। অষ্টম ও নবম ক্ষেত্রে রয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে স্থায়ী অর্থনৈতিক সহযোগিতা এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তনের জন্য প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে তোলা।
মৈত্রী আলোচনার মতো দুই দেশের মধ্যে ধারাবাহিক মতবিনিময় সীমান্ত বিল পাস করাতে যেমন সাহায্য করেছে, তেমনই নদী-সম্পদের সুসম বণ্টনও অদূর ভবিষ্যতে করে ফেলবে। এই ধারাবাহিক মতবিনিময়ের ফলে দুই দেশের সরকার ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে সন্দেহ ও সংশয় সরিয়ে ভরসা ও বিশ্বাসের একটা জায়গা সৃষ্টি হয়েছে। মোদির সফর সেই বন্ধন আরও দৃঢ় করবে। কারণ, তাঁর পররাষ্ট্রনীতির মূল কথাই হলো প্রতিবেশীদের সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে চলা। তাঁর কথায়, ‘প্রতিবেশী অশান্তিতে থাকলে আমিও শান্তিতে থাকতে পারব না।’
হাতে হাত মিলিয়ে সামনের দিকে এগোনো যদি মোদি-হাসিনার চ্যালেঞ্জ হয়ে থাকে, তাহলে তাঁদের চ্যালেঞ্জাররাও কিন্তু বসে নেই। দিন দিন আরও সক্রিয় হবে তারাও। হচ্ছেও। উপমহাদেশকে নিরাপদ রাখতে সব ধরনের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও নিশ্ছিদ্র করা জরুরি। গণতন্ত্রী, প্রগতিশীল ও উন্নয়নকামী নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা তা বিলক্ষণ বোঝেন। নিরন্তর মৈত্রী আলোচনা সেই বোধোদয়ের কাঠবিড়ালি।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।