‘আমাদের মেসে ইমদাদ হক ফুটবল খেলোয়াড়,
হাতে পায়ে মুখে শত আঘাতের ক্ষতে খ্যাতি লেখা তার।’
জসীমউদ্দীনের এই কবিতা মেস জীবনের কথা বলে। মেস উন্মূল নগরজীবনের সৃষ্টি। ছাত্র আর কর্মজীবীদের ঠিকানা। যাঁরা পরিবার নিয়ে থাকতে অসমর্থ, তাঁরাই মেসের বাসিন্দা।
একসময় আমাদের ছাত্ররা, এমনকি কর্মজীবীরাও লজিং থাকতেন। লজিং যাঁরা থাকতেন তাঁদের জায়গির বলা হতো। রংপুরের সিও বাজারের কাছে জায়গির বলে একটা জায়গাও আছে। লজিং হচ্ছে গৃহকর্তার ছেলেমেয়েদের একটু পড়িয়ে নিশ্চিন্তে থাকা-খাওয়া। হয়তো একটু বাজার করা। এই লজিং বাড়ি নিয়ে অম্লমধুর গল্প কাগজে ও বাতাসে লেখা আছে। পূর্ববঙ্গের শিক্ষার্থীরা তো জগৎ জয় করেছে লজিং থেকেই। এমনকি মেধাবী গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষক বা এলাকাবাসী লজিং রাখার ব্যবস্থা করতেন। এটা ছিল সামাজিক দায়। যে বরকত বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে শহীদ হলেন, তিনিও পুরান ঢাকায় লজিং থাকতেন। এভাবেই ছাত্র আর স্থানীয়দের মধ্যে দায়িত্ব ভাগাভাগি হয়ে গেছে। জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশও।
নব্বইয়ের পরবর্তী বাংলাদেশের সব শহরই অন্য রকম হয়ে গেছে। একটু ভালো কলেজ মানে আর তার আশপাশে লজিং বাড়ি নয়, মেস ব্যবসা তরতর করে বেড়ে উঠেছে।
উপজাত হিসেবে খাতা-কলমের দোকান থেকে ফাস্ট ফুডের শপ পর্যন্ত রমরমা। এই মেসের বাসিন্দাদের ওপরই স্থানীয় গুন্ডা-বদমাশদের ট্রেনিংটা হয়। চড়-থাপ্পড়, ছিনতাই আর টিজিংয়ের প্রথম পাঠশালা এই মেস ও মেসের বাসিন্দারা। কিন্তু শহরের সুখ-দুঃখে এগিয়ে আসে মেসের ছেলেমেয়েরাই। বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস বলা যায় মেসের শিক্ষার্থীদেরও ইতিহাস। শুধু শিক্ষার্থী বলা ভুল হবে, নিম্ন আয়ের অনেক তরুণ ও পেশাজীবী মানুষ শহরগুলির মেসে থাকেন। এক ঘরে ২/৩/৪/৬ বা জন করে থাকেন। এসব ঘরের ভাড়া ঠিক হয় কতগুলি বিছানা সেই হিসেবে। সেই হিসাবে মেসের ভাড়া ফ্ল্যাটবাড়ির ভাড়ার চেয়ে অনেক বেশি।
২.
‘মেসের ছেলেরা মেসে থাকবে না, কিন্তু ভাড়া দেবে—এ কেমন আইন?’
‘ আমাদের মেসমালিক টাকা চাইছে। টাকা সঠিক সময়ে না দিলে জরিমানার হুমকিও দিয়েছিল এই মাসের প্রথম দিকে।’ জানিয়েছেন মামুন ছাত্রাবাস, কুড়িগ্রামের এক শিক্ষার্থী।
‘বাজারে যাচ্ছি বিক্রি করতে, চেয়ারম্যান থেকে পাওয়া ত্রাণের চাল আর ডাল। মেসমালিকদের নির্দেশে মেসভাড়া দিতে হবে আগামীকাল।’
‘মেসের শিক্ষার্থীবৃন্দ’ নামের একটা ফেসবুক গ্রুপের কয়েক শ পোস্টের তিনটা নমুনা ওপরের কথাগুলো।
শিক্ষার্থীরা তাঁদের পোস্টগুলোতে জানাচ্ছেন, মেসমালিকেরা বলছেন, ‘হয় ভাড়া চালিয়ে যাও, নইলে তিন মাসের আগাম দিয়ে চলে যাও।’ অথচ মেসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই করোনার দিনে নিজেদের জমিতে ধান কাটছেন বা অন্যদের জমিতে।
শিক্ষার্থীদের যুক্তিও শক্ত। মেস বন্ধ। কারেন্ট বিল নেই, সব কিস্তি বন্ধ। সেখানে শিক্ষার্থীদের মেসে থাকতে দিতে না চাইলে বাড়ি যেতে দেওয়া হোক। আর তাঁরা তো ইচ্ছে করেও দুর্যোগ ডেকে আনেননি। করোনার দায় তাঁদের কাঁধে কেন বর্তাবে? আর তাঁদের প্রতিও মেসমালিকদের দায় আছে নিশ্চয়ই।
দিল্লুর রহমান নামের সম্মান চতুর্থ বর্ষের একজন শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, কুড়িগ্রামে এমন কোনো মেসমালিক কেউ দেখাতে পারবে না, যাঁদের মেসের টাকা ছাড়া সংসার চলে না। অথচ একজন মেসমালিক তাঁকে হুমকি দিয়েছেন, প্রতিবাদ করার কারণে তাঁকেই নাকি সবার ভাড়া দিতে হবে।
খানা আয়-ব্যয় জরিপে জেলাগুলোর দারিদ্র্যের পরিমাপ করা হয়েছে উচ্চতর দারিদ্র্যসীমার বিবেচনায়। পরিবারের দৈনিক খাবারের ব্যয় ন্যূনতম খাদ্য দারিদ্র্যসীমা (ফুড পভার্টি লাইন) সমান হলে তাকে উচ্চতম দারিদ্র্যসীমা বলা হয়। এটা করা হয় মাথাপিছু দৈনিক ২ হাজার ১২২ কিলো ক্যালরিকে মানদণ্ড ধরে এবং ১১টি খাদ্যদ্রব্যের ভিত্তিতে। সেগুলোর মূল্য নিরূপণ করে খাদ্য-দারিদ্র্যসীমা বিবেচনা করা হয়। কুড়িগ্রামবাসীর সীমা এখানে ৭১-৭৭ শতাংশ। মানে মেসে যে শিক্ষার্থীরা থাকেন, তাঁরাও এই হারের প্রতিনিধিত্ব করেন না?
খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুসারে, অন্যান্য পেশাজীবীর তুলনায় কৃষিজীবীদের মধ্যে দারিদ্র্যের হার বেশি। তারপর কর্মহীনেরা। মেসের শিক্ষার্থীদের চরে ও গ্রামে থাকা পিতা-অভিভাবকেরাই কি এই কৃষিজীবী ও কর্মহীনেরা নন? অপুষ্টির জন্য সবচেয়ে কম ওজনের ও বেঁটে হওয়া সন্তানেরা কি এই শিক্ষার্থীরাই নন?
করোনার পরিস্থিতি সব উল্টে দিচ্ছে। পুলিশ হয়ে গেছে সবচেয়ে মানবিক প্রতিষ্ঠান। চিকিৎসকেরা খোদার রহমত। কিন্তু আমাদের পোশাকমালিকদের কারখানা খোলাই লাগবে। আর মেসমালিকেরা কি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার! চলতি মাসের ভাড়াসহ আগামী তিন মাসের ভাড়া দিতে হবে! কিন্তু চুক্তি বা যুক্তি আছে কি? না, নেই।
লেখক: রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।
nahidknowledge@gmail.com