আবরারের প্রস্থানে আমরা সবাই ব্যথিত। এ কষ্ট ভোলার নয়। হাজার গেলাস পানি পান করলেও বুকে আটকে থাকা এই কষ্টের দলাটা নামার নয়। আবরার অমিত সম্ভাবনার এক মেধাবী তরুণ ছিল বলে কি কষ্টটা বেশি হচ্ছে? নাকি তাকে শেষ করে দেওয়ার প্রক্রিয়াটির জন্য আমাদের যন্ত্রণাটা বেশি? নিষ্ঠুরতা হয়তো আমাদের কাঁদাচ্ছে বেশি। আমরা বিচার চাচ্ছি হত্যা ঘটনার। যাদের সিসি ক্যামেরায় দেখা গেছে, মোবাইল মেসেজের স্ক্রিন শটে যাদের চিহ্ন আছে, তাদের বিচারের জন্য গর্জে উঠছে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ। এতে তাৎক্ষণিক অপরাধের একটা হিল্লে হবে হয়তো; কিন্তু চলমান নিপীড়ন-নির্যাতন আর শেষ করে দেওয়ার যে কার্যকর, টেকসই আর মেধাবী ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে, তা অটুট থেকে যাবে। আরেকটা আবরার সেই ব্যবস্থার শিকার না হওয়া পর্যন্ত আমরা সেটার অস্তিত্বই মালুম করতে পারব না।
আবরার ঘটনায় আহত মানুষের অনেকের প্রশ্ন, বিস্ময়। এমন মেধাবী ছেলেগুলো এমন কাজ করল কীভাবে? বাড়িতে, স্কুল-কলেজে সে তো এমন ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে কেন সে এমন হয়ে গেল! এ প্রশ্ন প্রহারকারী আর প্রহার শেষে লাশ ফেলার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেধাবীদের মা-বাবা, অভিভাবক, পড়াপ্রতিবেশীর। আমরা কি একবারও ভেবে দেখেছি আমাদের কোনো গাফিলতি আছে কি না, ছিল কি না? পরিবারের সবচেয়ে মেধাবীকে কীভাবে আমরা লালন করি? মেধা লালনের নামে তাকে আশকারার কোন মগডালে চড়িয়ে রাখি? সে যা খুশি তা-ই করতে পারে, তার খুশিতেই সবাইকে খুশি থাকতে হয়। চার ভাইবোনের মধ্যে যার মেধার ধার মা-বাবা, পাড়াপ্রতিবেশী টের পান; সবকিছুতেই তার ভাগ থাকে সবার আগে। মাছের মুড়ো থেকে শুরু করে পড়ার টেবিল, বাতি, বই, ক্যালকুলেটার, ডেস্কটপ, ল্যাপটপ সবকিছুতেই তার একক অধিকার।
মেধাকে পরিবার দেখে পুঁজি হিসেবে। পুঁজির পরিবর্ধনে সার পানি পুষ্টি সব দেওয়া হয় হাত খুলে ট্যাঁক খালি করে। উৎসাহ দেওয়া হয় এগিয়ে যাওয়ায়। যেকোনো মূল্যে করিমকে ফেলে রহিমের এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত করাটায় করিমের মা-বাবার প্রধান কাজ। রহিমের মা-বাবাও তা-ই মনে করেন। তাঁরা পথ ছাড়বেন কেন? ছেলেমেয়ের রেজাল্ট কার্ড হাতে পেয়ে সেটাতে চোখ বোলানোর আগে জানতে চান, অমুকের মেয়ে বা ছেলে কত পেল? নম্বর কম পেল বলেই ফেলেন, ‘এত কাঁড়ি কাঁড়ি খরচ করলাম, তার এই ফল?’ পুঁজির পেছনে লগ্নি করছে পুঁজির বিকাশ দেখার জন্য। কম নম্বর মানে বিকাশ নেই। লক লক করে বাড়ছে না পুঁজি। কাঁড়ি আর কড়ির চক্রে ফেলে দেওয়া মেধাবীদের কি আর অন্যের কথা ভাবার, অন্যের যন্ত্রণা বোঝার পাঠ নেওয়া হয়? এ কারণেই আবরার যখন মারের চোটে বেহুঁশ, বমি করছে বারবার, তখন সেরা মেধাবীদের মনে হয়েছে আবরার নাটক করছে।
অথচ মানুষের প্রধান প্রাণশক্তি হচ্ছে ‘বিবেক’। বিবেক হাতছাড়া হলে মানুষ আর অন্য প্রাণীর মধ্যে কোনো তফাৎ থাকে না। বিবেকের পরিচর্যার শিক্ষা মেধার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে জরুরি। বিবেকের চর্চাহীন মানুষ অন্য প্রাণিকুলের থেকেও হিংস্র হয়ে উঠতে পারে। অন্য প্রাণী যখন শুধু নিজের খাবার সংগ্রহের জন্য হিংস্রতা দেখায়, বিবেকহীন মানুষ তখন শুধু পেট ভরে খাবারের জন্য নয়, মাথার ভেতরে পুঁতে দেওয়া হিংসা-বিদ্বেষ, প্রভাব-প্রতিপত্তি বা হিংসাত্মক মনোভাব চরিতার্থ করার জন্য যাবতীয় হিংস্রতা আর প্রাণঘাতী সব কাজ অকপটে করতে পারে।
বিবেকহীন প্রতিযোগিতার পরিবেশে বিবেক রক্ষা করা সহজ নয়, কিন্তু এটা প্রাণরক্ষার মতো একটা জরুরি কাজ। প্রতিটি মানুষ যদি তার নিজস্ব প্রতিষ্ঠান (ইনস্টিটিউট) তথা পরিবার ও সমাজ থেকে দায়িত্বানুভূতির শিক্ষা পায়, তবে সমাজ আগামীর আবরারদের জন্য বাসযোগ্য হতে পারে। সে সমাজে মানুষ স্বাচ্ছন্দ্যে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারবে, মতপ্রকাশের সুযোগ থাকবে। ১০১১ নম্বর দরজার (আবরারের কক্ষ) কাছে গিয়ে পৃথিবী থেমে যাবে না। সমাজের দুষ্কৃতকারীরা একঘরে হয়ে যাবে, এমনকি তারাও একদিন ভালো হয়ে যাবে। আমরা বিবেকবানদের সমাজে বসবাস করতে পারব। হারানো সেই সমাজে ফেরার স্বপ্ন দেখি আমরা সবাই।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক ও গবেষক।