বুয়েটের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যা মামলার রায়ের দিনের একটি দৃশ্য। মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ২৫ আসামিকে পুলিশ যখন আদালতের এজলাস থেকে কারাগারে নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তাঁদের সবার চেহারা ছিল বিষণ্ন ও বেদনাকাতর। এরপর পুলিশ ভ্যানে বসে তাঁদের কাউকে উচ্চস্বরে কাঁদতে দেখলাম। আবার এক–দুজন লোহার জালির বাইরে হাত বাড়িয়ে প্রতিবাদ করছিলেন, তাঁরা অপরাধী নন।
রায়ে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান বলেছেন, ‘আসামিরা পরস্পরের যোগসাজশে একে অপরের সহায়তায় শিবির সন্দেহে মিথ্যা, বানোয়াট ও ভিত্তিহীন অভিযোগ এনে আবরার ফাহাদকে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে হত্যা করে। এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের সকল মানুষকে ব্যথিত করেছে। এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে আর কখনো না ঘটে, তা রোধকল্পে অত্র ট্রাইব্যুনাল সকল আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো।’
নিহত আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন, যখন রায় কার্যকর হবে, তখনই পুরো সন্তুষ্ট হতে পারবেন এবং আবরারের আত্মা শান্তি পাবে। কিন্তু আবরারকে আর কখনোই তাঁর মা–বাবা ফিরে পাবেন না। তাঁরা যে আশা নিয়ে সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন, তা–ও পূরণ হবে না।
এই বেদনা কি শুধু আবরারের মা–বাবার? নিশ্চয়ই নয়। আবরার হত্যার দায়ে বুয়েটের যে ২০ শিক্ষার্থী মৃত্যুদণ্ড এবং ৫ শিক্ষার্থী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পেয়েছেন, তাঁদের মা-বাবাও সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়েছিলেন এই আশায়, তাঁরা ভবিষ্যতে নামকরা প্রকৌশলী হবেন, সংসারের অভাব ঘোচাবেন, দেশ ও সমাজ বিনির্মাণে অবদান রাখবেন। তাঁদের আশাও চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেল। এই শিক্ষার্থীরা বুয়েটে ভর্তি হওয়ার আগে কেউ দাঙ্গাবাজ, সন্ত্রাসী কিংবা খুনি ছিলেন না। তাঁরা সবাই মেধাবী শিক্ষার্থী ছিলেন। অন্যথায় হাজার হাজার ভর্তি–ইচ্ছুকের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বুয়েটের মতো দেশের শীর্ষ উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পেতেন না। কিন্তু আজ তাঁদের পরিচয় হলো খুনি বা খুনের সহযোগী। কোন নষ্ট-ভ্রষ্ট ও দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতি দেশের ২৫ জন সেরা শিক্ষার্থীর এই করুণ পরিণতি ডেকে আনল?
ছাত্রলীগের নেতৃত্ব আবরার হত্যার সুপিয়িরিয়র রেসপন্সিবিলিটি এড়াবে কীভাবে? কেবল আবরার হত্যাই বা বলি কেন? মাত্র কয়েক দিন আগে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক সেলিম হোসেন মারা গেলেন ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর হাতে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাঁর অপরাধ, তিনি ছাত্রলীগের অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে হল ক্যানটিনের ম্যানেজার পরিবর্তন করেননি।
আবরার হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা সবাই বুয়েট ছাত্রলীগ শাখার নেতা-কর্মী। হত্যাকাণ্ডের পর ছাত্রলীগ থেকে ১১ জনকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল। কিন্তু বহিষ্কার করলেই দায় এড়ানো যায়? যখনই কোনো অঘটনের সঙ্গে কোনো ছাত্রসংগঠনের বা রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ থাকে, তখনই সেই সংগঠন ও দল থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। কিন্তু কীভাবে তাঁরা সংগঠনের নাম ব্যবহার করে নানা রকম অপকর্মে লিপ্ত হন, কারা তাঁদের আশ্রয়–প্রশ্রয় দেন এবং প্রতিপক্ষ ছাত্রসংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করেন, সেই সব প্রশ্নের জবাব নেই।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের সময়ে আদালত অঙ্গনে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি কথাটি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যথার্থভাবেই। তবে অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি কেবল যুদ্ধাপরাধের বিচারেই ব্যবহৃত হয়েছে, তা নয়। আমাদের অনেকেরই ১৯৭৪ সালে মুহসীন হলের (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়) সাত খুনের কথা মনে আছে। ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের দ্বন্দ্বের জের ধরে সাতজন ছাত্রলীগ কর্মীকে খুন করা হয়। সে সময়ে ছাত্রলীগের ডাকসাইটে সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শফিউল আলম প্রধান। যাঁরা খুন হয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন তাঁর বিরোধী গ্রুপের নেতা-কর্মী। কেউ বলেননি, তিনি নিজ হাতে তাঁদের ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছেন। তারপরও সুপিরিয়র রেসপন্সিবিলিটি বা হুকুমদাতা হিসেবে তাঁর ১০ বছর জেল হয়েছিল। কিন্তু আমাদের দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির এমনই মাজেজা যে পঁচাত্তরের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর খুনের মামলার সেই দণ্ডিত আসামিকে জেলখানা থেকে মুক্ত করে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতিতে নামানো হয়।
সে ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব আবরার হত্যার সুপিয়িরিয়র রেসপন্সিবিলিটি এড়াবে কীভাবে? কেবল আবরার হত্যাই বা বলি কেন? মাত্র কয়েক দিন আগে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক সেলিম হোসেন মারা গেলেন ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মীর হাতে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাঁর অপরাধ, তিনি ছাত্রলীগের অন্যায় আবদার মেনে নিয়ে হল ক্যানটিনের ম্যানেজার পরিবর্তন করেননি। হল ক্যানটিনের ম্যানেজার কে হবেন, সেটি পুরো প্রশাসনিক বিষয়। কিন্তু ছাত্রলীগ সেখানে নাক গলিয়েছে। হলের আসন বণ্টন, ডাইনিং সবই ছিল তাঁদের নিয়ন্ত্রণে।
শিক্ষক মারা যাওয়ার পরও কুয়েট ছাত্রলীগের নেতা নাহিয়ান আস্ফালন দেখিয়েছেন, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ না করার জন্য সদলবলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। এই দুঃসাহস তিনি কোথা থেকে পান? অথবা আমরা যদি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের কথা বলি। সেখানে কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে বিরোধের বিষয় ছিল না। তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী। আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতো চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজেও ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপ। এক গ্রুপ সাবেক মেয়রের অনুসারী, আরেক গ্রুপ শিক্ষা উপমন্ত্রীর। নিজেদের নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব বজায় রাখতে প্রায়ই এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের ওপর চড়াও হয়। এর জের ধরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের এক শিক্ষার্থী মাথায় গুরুতর জখম হন। চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের পর মাথার ওপর এক টুকরা কাগজে লিখে রেখেছিলেন, ‘খুলি নেই, কেউ হাত দেবেন না।’ চিকিৎসকদের আপ্রাণ চেষ্টায় ওই শিক্ষার্থীকে বাঁচানো গেছে। আশা করি, সুস্থ হয়ে তিনি ফের ক্লাসে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু বুয়েটের আবরারকে বাঁচানো যায়নি। বাঁচানো যায়নি কুয়েটের শিক্ষককেও।
আমরা যখন বুয়েটের আবরার হত্যার কথা লিখছি, তখন মনে পড়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনির কথা। তিনিও ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন। সে সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ক্ষমতার রাজনীতি এত হিংস্র ও কুৎসিত কেন?
কুয়েট কর্তৃপক্ষ ছাত্রলীগের ১২ জন শিক্ষার্থীকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। শিক্ষকেরা বলেছেন, স্থায়ী বহিষ্কার না করলে তাঁরা শ্রেণিকক্ষে ফিরে যাবেন না। যদি স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা হয়, এই ১২ শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবনও শেষ হয়ে যাবে। যেমনটি শেষ হয়ে গেছে বুয়েটের ২৫ শিক্ষার্থীর। আর তাঁদের আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু ছিলেন একজন শিক্ষক ও একজন শিক্ষার্থী। তাঁরা কেউ এভাবে জীবন দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থী হতে আসেননি। তাঁরা সবাই দুর্বৃত্তায়িত ও নষ্ট রাজনীতির শিকার। এ জন্য কেবল শিক্ষার্থীরা দায়ী হতে পারেন না। দায় নিতে হবে সেই নষ্ট ও দুর্বৃত্তায়িত ছাত্ররাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদেরও।
আমরা যখন বুয়েটের আবরার হত্যার কথা লিখছি, তখন মনে পড়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সাবেকুন নাহার সনির কথা। তিনিও ছাত্রদলের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে নিহত হন। সে সময়ে বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। ক্ষমতার রাজনীতি এত হিংস্র ও কুৎসিত কেন?
আবরার হত্যা মামলার বিচারক বলেছেন, এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য ২৫ আসামিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হলো। কিন্তু খুনের বিচার করেই কি ক্যাম্পাসে খুন-মারামারি–অপমৃত্যু বন্ধ করা যাবে? যে অপরাজনীতি তঁাদের তৈরি করে, সেটি বন্ধ করবে কারা? ক্যাম্পাসে খুন–মারামারি বন্ধ করতে এই অপরাজনীতির অবসান ঘটাতে হবে। আমরা পাকিস্তান আমলে অপশাসনের কথা বলি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এনএসএফের সন্ত্রাসী কাণ্ডের কথা বলি, কিন্তু কেউ কি হিসাব নিয়েছেন স্বাধীনতার পর ক্যাম্পাসে কত শিক্ষার্থী খুন হয়েছেন। কত শিক্ষার্থীর পড়াশোনা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে? কত মা-বাবার কোল খালি হয়েছে?
এই হিসাবটা নেওয়া প্রয়োজন ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষার জন্য।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি