মেধাবীরা শিক্ষকতা থেকে দূরে কেন?

শিক্ষকেরাই মানুষকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবশক্তিতে রূপান্তর করে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শিক্ষকতা কেবল চাকরি নয়, মহান পেশা ও ব্রত। যুগে যুগে, কালে কালে তাই শিক্ষক জ্ঞানের দীপশিখা জ্বেলেছেন, উজাড় করে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জ্ঞানের ভান্ডার, অথচ কখনো প্রশ্ন করে দেখেননি, প্রতিদানে তিনি কী পেয়েছেন! তাই তো শিক্ষক হলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ মানুষ।

কোভিড-১৯ উল্লেখযোগ্যভাবে শিক্ষাব্যবস্থা এবং শিক্ষকতার চ্যালেঞ্জকে অতিমাত্রায় সম্প্রসারিত করেছে। শিক্ষাব্যবস্থা এমন এক বিপর্যস্ত অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে যে এ চরম ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে স্বাভাবিক পঠন–পাঠন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে না পেরে কম্পিউটার–নিয়ন্ত্রিত দূরশিক্ষণের মাধ্যমে খণ্ডিত বা আংশিক পঠন–পাঠন কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। করোনার কারণে এমন প্রতিবন্ধকতাকে কীভাবে মোকাবিলা করা যায়, তা নিয়ে সারা বিশ্বের মতো আমাদের দেশের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষা ব্যবস্থাপকেরা অনুকূল অবস্থা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

আমাদের শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়নের প্রশ্নে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে ভৌত অবকাঠামোর উন্নয়ন ও শিক্ষার উপকরণ প্রদান করা হয় সত্য, কিন্তু শিক্ষকের মানোন্নয়ন ছাড়া শিক্ষার মানোন্নয়ন সম্ভব নয়। সে জন্য প্রয়োজন প্রগতিশীল, মেধাবী ও সৃজনশীল ব্যক্তিদের শিক্ষকতায় আকৃষ্ট করা।

শিক্ষককে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকজীবনের প্রথম থেকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ও গবেষণাকর্মের প্রয়োজনীয় সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষকের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে বলতে হয়, বিষয়টি চরমভাবে উপেক্ষিত। উল্লেখ্য, আমাদের গোটা শিক্ষাব্যবস্থার প্রায় ৯৫ শতাংশই পরিচালনা করেন বেসরকারি শিক্ষক, আর একটি স্বাধীন দেশের জন্য বেসরকারি শিক্ষকতার অবস্থা অত্যন্ত লজ্জাজনক।

একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর চলমান ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে সরকারি ও বেসরকারি—দুটি ধারায় বৈষম্যমূলক শিক্ষাব্যবস্থা চলে এবং তা সম্প্রসারিত হতে থাকে। যদিও একটি স্বাধীন দেশে কোনোক্রমেই এ ধরনের বৈষম্য থাকা উচিত নয়। তাই স্বাধীনতা লাভের পর শিক্ষকসমাজের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বৈষম্যের অবসানকল্পে শিক্ষাব্যবস্থার সব স্তরকে জাতীয়করণের মাধ্যমে এক ও অভিন্ন ধারায় রূপান্তরিত করতে সরকার নীতিগতভাবে অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি।

শিক্ষকতা পেশা সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার দাবি রাখলেও অবহেলা ও অবজ্ঞার ফলে শিক্ষকতা পেশা ক্রমেই মেধাবীদের আকর্ষণ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে। সে কারণে ‘শিক্ষা সার্ভিস কমিশন’ গঠন করে অভিন্ন নিয়োগ নীতিমালায় মেধাসম্পন্ন দক্ষ ও যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন। তেমনি সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য দূর করে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বেসরকারি শিক্ষকদের সরকারি শিক্ষকদের অনুরূপ নিয়মিত বেতন-ভাতা প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে, যাতে আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে প্রাইভেট টিউশনি, কোচিং বা অন্য কোনো বাড়তি কাজের দ্বারা অর্থ উপার্জন করতে গিয়ে নিজ দায়িত্ব পালনে বাধার সম্মুখীন হতে না হয়।

এখনো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় বেসরকারি শিক্ষকদের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা থাকলেও পদোন্নতির সুযোগ নেই। সৌভাগ্যবান কেউ কোনোমতে এক ধাপ এগোলেও পরবর্তী ধাপে পদোন্নতির কোনো নিয়ম নেই। সামগ্রিক অবস্থার আলোকে এসব কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে যোগ্য ও আদর্শ শিক্ষকেরা চরম এক হতাশার মধ্যে দিন যাপন করছেন। ফলে সৃজনশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটার অবকাশ নেই, বরং তাঁদের সাধারণ দায়িত্ব পালন করার স্পৃহাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে।

বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটিতে রাজনীতিকদের অন্তর্ভুক্ত করার ফলে এবং পরিচালনা কমিটি গঠনে অসংগতিপূর্ণ নীতিমালা থাকার কারণে বেসরকারি শিক্ষকদের চাকরিরও নিরাপত্তা নেই। অনেক ক্ষেত্রে পরিচালনা কমিটি রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে তথাকথিত অনুদান বা ডোনেশনের নামে মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অপেক্ষাকৃত কম যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে শিক্ষার মান ও পরিবেশকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেহেতু সরকার বর্তমানে বেসরকারি শিক্ষকদের শতভাগ বেতন দিচ্ছে, তাই শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ গড়ে তোলার জন্য অবিলম্বে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনায় পরিচালনা কমিটি প্রথা বিলুপ্ত করে সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুরূপ নিয়মে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে পারে।

শিক্ষকদের অধিকার ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই শিক্ষকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের বিষয়টি সামনে চলে আসে। শিক্ষককে হতে হবে গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। এখন প্রশ্ন, এ মহান পেশার প্রতি আমরা শিক্ষকেরা কতটুকু যত্নবান? কতটুকু নিষ্ঠাবান? কতটুকু আন্তরিক—এসব বিষয়ে শিক্ষকদের আত্মবিশ্লেষণের এখনই উপযুক্ত সময়। সুষ্ঠু সমাজ, সুন্দর দেশ, তথা সুন্দর পৃথিবীর জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষার বিকল্প নেই। সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে শিক্ষার গুণগত মানোন্নয়ন করা সম্ভব হবে—এটাই প্রত্যাশা করি।

মোহাম্মদ অলিদ সিদ্দিকী তালুকদার

সাংবাদিক ও সদস্য, ডিইউজে।