মেধাবীরা দেশ ছেড়ে যান না, যেতে বাধ্য করা হয়

গতকাল শুক্রবার সকালে টেলিফোনে কথা হয় রংপুরের পীরগঞ্জের রেদোয়ান রনির সঙ্গে। ৪ জানুয়ারি তিনি রংপুর প্রেসক্লাবের সামনে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও নিয়োগে বৈষম্য বন্ধ করার দাবিতে হাতে প্ল্যাকার্ড নিয়ে একক প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। তিনি পাঁচ বছর আগে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পাস করে শতাধিক সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির আবেদন করে অনেক জায়গায় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও চাকরি পাননি।

পীরগঞ্জ উপজেলার মাদারগঞ্জ গ্রামের আবদুল লতিফ মণ্ডলের একমাত্র ছেলে রেদোয়ান রনি। তাঁর বাবা স্থানীয় মাদ্রাসায় চাকরি করতেন। ২০১২ সালে তিনি অবসরে যান। রেদোয়ানের তিন বোনের বিয়ে হয়ে গেছে; বৃদ্ধ মা-বাবাকে নিয়ে কষ্টে আছেন। রেদোয়ানের কাছে জানতে চাই, প্রেসক্লাবের সামনে কর্মসূচি পালনের পর প্রশাসন, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি কিংবা বেসরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে কেউ তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন কি না। তিনি বললেন, যোগাযোগ করেননি। কীভাবে চলছে তাঁদের পরিবার? তিনি জানালেন, মা তাঁর বাবার বাড়িতে যে সম্পত্তি পেয়েছেন, তা বিক্রি করে এত দিন চলেছেন। এখন সেই টাকাও শেষ।

রেদোয়ান রংপুর সরকারি কলেজ থেকে ২০১৬ সালে অর্থনীতিতে অনার্স পাস করেন। অনার্সে তিনি প্রথম শ্রেণি পেয়েছেন। এরপর ২০১৭ সালে রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে একই বিভাগ থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে মাস্টার্স পাস করেন। রেদোয়ানের আক্ষেপ, ‘মাস্টার্সের পর অন্তত ২০টি সরকারি দপ্তরে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছি। এরপরও কেন আমার চাকরি হবে না? সম্প্রতি জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর মৌখিক পরীক্ষায় ডাকা হয়। সেখানে ভাইভা বোর্ডে সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। তারপরও চাকরি হয়নি। কয়েক দিন আগে সমাজসেবা বিভাগে চাকরির লিখিত পরীক্ষার জন্য ঢাকায় ডাকা হলো। ধারদেনা করে গেলাম, কিন্তু আগের দিন ঘোষণা দেওয়া হলো পরীক্ষা স্থগিত।’ এই হলো শিক্ষা ও মানবসম্পদের সূচকে এগিয়ে থাকা বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র।

রেদোয়ানকে জিজ্ঞাসা করি, যখন চাকরি পাচ্ছেন না, তখন নিজে কিছু করার উদ্যোগ নিলেন না কেন? তঁার জবাব, ‘আমি যখন অর্থনীতিতে পড়াশোনা করছিলাম, তখনই ভেবেছি দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করব।’ প্রশাসনিক কাজে তাঁর আগ্রহ বেশি এ কথাও জানালেন। রেদোয়ান ৪৩তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষাও দিয়েছেন, ফল প্রকাশের অপেক্ষায় আছেন। তাঁর ধারণা, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে অনেক যোগ্য প্রার্থী চাকরি পান না। আবার অনেক অযোগ্য প্রার্থী উৎকোচ দিয়ে চাকরি বাগিয়ে দেন। এরপরও হাল ছাড়েননি তিনি। বিভিন্ন স্থানে চাকরির চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সমস্যাটি কেবল পীরগঞ্জের রেদোয়ানের নয়। মাস্টার্স পাস করে হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বছরের পর বছর বেকার জীবন যাপন করছেন। কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী থেকে মো. রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোয় চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যায় ২০১৭ সালে স্নাতকোত্তর পাস করেন। তিনি এ পর্যন্ত ৫৩টি চাকরিতে আবেদন করেছেন; কোথাও চাকরি পাননি। গত বছর ১২ অক্টোবর তাঁর আবেদনের বয়স শেষ হয়েছে। তিনি চান, চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়িয়ে দেওয়া হোক।

সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী একজন শিক্ষার্থীর পেছনে কেবল পরিবারই অর্থ খরচ করে না। রাষ্ট্রেরও অনেক অর্থ ব্যয় হয়। যদি চাকরির বাজারে পড়াশোনার উপযোগিতাই না থাকে, তাহলে শত শত কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স খোলা হলো কেন? প্রতিবছর উচ্চশিক্ষা নিয়ে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, সেই খবর কি আমাদের রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকেরা জানেন? লিবিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বন্দিশিবিরে যে বহুসংখ্যক বাংলাদেশি তরুণ আটক রয়েছেন, অনেকে সমুদ্র পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরছেন, তাঁরা অনেকেই উচ্চশিক্ষিত। দেশে চাকরি না পেয়ে আদম ব্যাপারীদের খপ্পরে পড়ে সহায়–সম্বল বিক্রি করে অনিশ্চিত জগতে পা বাড়াচ্ছেন তাঁরা। যে উন্নয়ন উচ্চশিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের কাজ দিতে পারে না, সেই উন্নয়ন নিয়ে আমরা কী করব?

রেদোয়ান ও রফিকেরা যখন চাকরি না পাওয়ার যন্ত্রণা ভোগ করছেন, তখন আরেকটি খবরের প্রতি দৃষ্টি পড়ল। তিন বিসিএসে পিএসসির সুপারিশ করা ৮৪ জনকে নিয়োগ দিতে নির্দেশে দিয়েছেন হাইকোর্ট। পৃথক চারটি রিটের বিষয়ে রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে বুধবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ রায় দেন, তাঁদের নিয়োগ করতে হবে। ৩৬, ৩৭ ও ৩৯তম বিসিএস পরীক্ষায় চূড়ান্তভাবে উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগবঞ্চিত ৮৪ জন ২০২০ সালে পৃথক রিট করেন। এর আগে হাইকোর্ট থেকে নিয়োগের জন্য প্রকাশিত গেজেটে রিট আবেদনকারীদের নাম বাদ দেওয়া কেন বেআইনি হবে না, তাঁদের নিয়োগ দিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়। রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় দেওয়া হলো।

আদালতে রিটকারীদের আইনজীবী বলেন, তিনটি বিসিএসে লিখিত-মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ৮৪ জনকে চিকিৎসক, প্রশাসন, শিক্ষা, পুলিশসহ বিভিন্ন ক্যাডারে নিয়োগের সুপারিশ করে পিএসসি। তবে কোনো কারণ ছাড়াই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রকাশিত নিয়োগের গেজেটে তাঁদের নাম বাদ পড়ে। এর বৈধতা নিয়ে নিয়োগবঞ্চিতরা এ চারটি রিট করেন। হাইকোর্ট ওই তিনটি বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত ৮৪ জনকে নিয়োগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।

পাবলিক সার্ভিস কমিশন সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ৮৪ প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করেছে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তথা সরকার কেন তাঁদের নিয়োগ আটকে দিল? তাঁরা কি রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কাজে লিপ্ত ছিলেন? তঁারা কি ছাত্রজীবনে সহপাঠীকে হত্যা করেছেন কিংবা মানসিক নির্যাতন চালিয়ে শিক্ষককে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছেন?

এই শিক্ষার্থীরা মেধাবী বলেই কয়েক লাখ প্রতিযোগীর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁরা যেসব বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছেন, তাঁর সব কটা হয়েছে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। আগের আমলে হলে না হয় সরকার বলতে পারত পরীক্ষার ফলাফলে নয়ছয় হয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের পিএসসির সুপারিশ উল্টে দিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়! তাহলে পিএসসির প্রয়োজনটা কী? জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় যাঁকে যোগ্য মনে করবে, তাঁকে নিয়োগ দেবে, যাঁকে মনে করবে না, তাঁকে বাদ দেবে।

হাইকোর্টের রায়ের পরও এই ৮৪ জন নিয়োগ পাবেন, তার নিশ্চয়তা নেই। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাশগুপ্ত বলে দিয়েছেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। আবার এ–ও জানিয়েছেন, প্রার্থীর ব্যক্তিগত রিপোর্ট নেতিবাচক হলে নিয়োগ পাবেন না। প্রশ্ন হলো, রিপোর্টটা দেবেন কে? পুলিশ তো জনপ্রশাসনের ইচ্ছার বাইরে যাবে না। যায়নি কখনো।

যে মেধাবী শিক্ষার্থীরা সব পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিয়োগ পাওয়ার যোগ্য হয়েছেন, রাজনৈতিক কারণে তাঁদের অযোগ্য করার অপপ্রয়াস অমার্জনীয় অপরাধ। যাঁরা বিসিএস পাস করার পরও এই মেধাবী শিক্ষার্থীদের চাকরি থেকে বঞ্চিত করছেন, তাঁদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতেই হবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা কেন দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যান, এ প্রশ্নের উত্তরও এখানে আছে।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

    sohrabhassan55@gmail.com