২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের তিন মাননীয় বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্তে একটা গুরুত্বপূর্ণ আইনি লড়াই শেষ হয়েছে। রায় হয়েছে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় দায়েরকৃত মামলায় গ্রেপ্তার ও কারারুদ্ধ আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের পক্ষে।
উচ্চতম আদালতের রায় বা সেই আদালতে আইনি লড়াই মোটেই হাসি-তামাশার ব্যাপার নয়। উচ্চ আদালতে কঠিন ও জটিল আইনি বিষয়ে ব্যাখ্যা ও সুরাহা হয়। তবে সব সময় এই আইনি লড়াইগুলোকে খুব সিরিয়াসলি নিলে আইন রসকষবিহীন শুষ্ক ব্যাপারে পরিণত হতে পারে। আইনের ছাত্রছাত্রী ও তরুণ আইনজীবীরা ভয়ে আইন পেশা থেকে দূরে সরে যেতে পারেন। তবে বলা বাহুল্য, আইন নাচ-গানে ভরপুর ঢালিউডের সিনেমার মতো উপভোগ্য কোনো ব্যাপার নিশ্চয়ই নয়। তাই আইন নিয়ে মাঝেমধ্যে কিছু হাসি-তামাশার দরকার আছে। সেই উপলব্ধি থেকেই আজকের এই রম্য বয়ান।
আলোকচিত্রী কারাবন্দী শহিদুল আলম কারাগারের মেঝেতে ঘুমাবেন, না খাটে ঘুমাবেন—এ নিয়ে বিরাট আইনি লড়াই। আগেই বলেছি, সদ্য
শেষ হয়েছে।
খুলে বলি, পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সূত্র ধরে। ২০১৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম আলোর ৫ম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম ‘শহিদুলের প্রথম শ্রেণির বন্দিসুবিধার আদেশ স্থগিত হয়নি’। শহিদুল আলম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এ বছরের ৫ আগস্ট। কারা কর্তৃপক্ষ তাঁকে প্রথম শ্রেণির বন্দিসুবিধা দেয়নি, কারাগারে রেখেছিল হাজারো সাধারণ কয়েদির মতো। কারা কর্তৃপক্ষের কাছে প্রথম শ্রেণি চেয়ে আবেদন–নিবেদন করা হয়েছিল। কাজ হয়নি। পত্রিকা থেকে জানলাম, এক মাস পর ৫ সেপ্টেম্বর কারাগারে শহিদুল আলমের জন্য প্রথম শ্রেণির কয়েদি সুযোগ–সুবিধা চেয়ে রিট মামলা করা হয়। হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সেই রিট মামলায় শহিদুল আলমকে প্রথম শ্রেণি বা ডিভিশন দেওয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষকে আদেশ দেন।
কারা কর্তৃপক্ষ কারাগার কীভাবে পরিচালনা করবে, বন্দীরা সকালে কখন ঘুম থেকে উঠবেন, হাত–মুখ ধোয়ার জন্য কতটুকু সময় বরাদ্দ, তারপর কখন কী করবেন এবং শেষতক রাতে কখন সব বাতি নিভিয়ে দেওয়া হবে ইত্যাদি খুঁটিনাটিসহ বিশদ বিবরণ আছে যে আইনে, তার নাম জেল কোড। কারা কর্তৃপক্ষের কী কী দায়িত্ব ও ক্ষমতা, কারাবন্দীদের বিরুদ্ধে নিয়ম ভঙ্গের জন্য কী ব্যবস্থা নিতে পারবে ইত্যাদিসহ মোট ১৩৮৮টি ধারা আছে প্রায় ৪০০ পৃষ্ঠার আইনের এই জেল কোডে। কোনো কারাবন্দী জেল কোড অনুযায়ী প্রাপ্য সুযোগ–সুবিধা পাচ্ছেন কি না, তা নিয়ে মামলা–মোকদ্দমা হয় না বললেই চলে। অতএব আমরা আইনজীবীরা এই আইন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি না, জানি না বললেই চলে। কারাগারের অভ্যন্তরে কী হয়, এ নিয়ে ইদানীং কোনো লেখালেখিও চোখে পড়েনি। ২০০০ সালে কারাজীবন, কারাব্যবস্থা, কারা বিদ্রোহ: অনুসন্ধান ও পর্যালোচনা নামে আলতাফ পারভেজের লেখা একটা বই প্রকাশিত হয়েছিল। এত কথা ইনিয়ে–বিনিয়ে বলার উদ্দেশ্য হলো কারাগারে সাধারণ আর প্রথম শ্রেণির বন্দীদের সুযোগ–সুবিধা সম্পর্কে বিশদ জানা নাই। তাই দু–একজনের সঙ্গে কথা বলে পাওয়া ধারণা থেকে বলছি, সাধারণ বন্দীদের কারাগারের মেঝেতে ঘুমাতে হয় গাদাগাদি করে, নড়াচড়া না করে এবং আনুষঙ্গিক নানা কষ্ট ও অসুবিধার মধ্যে। প্রথম শ্রেণি (ডিভিশন) পেলে ঘুমানোর জন্য মেঝের পরিবর্তে খাট পাওয়া যায়, আরও দু–চারটা বাড়তি সুবিধা যেমন পড়ার জন্য বই, সম্ভবত লেখালেখির জন্য কাগজ–কলম। ডিভিশন পাওয়ার পর শহিদুল আলম এই সুবিধাগুলো সম্ভবত পাচ্ছেন।
হাইকোর্টের দেওয়া ডিভিশন আদেশ বাতিল চেয়ে মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল চেম্বার জজের আদালতে তড়িঘড়ি করে প্রাথমিক আবেদন করেন ১৭ সেপ্টেম্বর। মাননীয় আদালত প্রাথমিক আবেদনের পরিবর্তে পূর্ণাঙ্গ আবেদন করতে বলেন। মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল সেই আবেদন নিয়ে আবার চেম্বার জজের কাছে হাজির হয়েছিলেন ২৫ সেপ্টেম্বর। এবং চেম্বার জজ বলেন, ডিভিশন বাতিল চেয়ে এই আবেদনের শুনানি হবে ছুটি শেষে আদালত খোলার প্রথম দিনেই, অর্থাৎ পয়লা অক্টোবর।
শহিদুল আলম কারাগারে মেঝের পরিবর্তে কেন খাটে ঘুমাবেন, এটা আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্য একটা গুরুতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। মাননীয় অ্যাটর্নি জেনারেল শহিদুল আলমের খাটের পরিবর্তে মেঝেতে রাত্রি যাপনের ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করার জন্য ইতিমধ্যে দুই–দুইবার চেম্বার বিচারপতির আদালতে গেছেন। আর অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতের সামনে দাঁড়ালে তাঁর সঙ্গে অবধারিতভাবে দু–চারজন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল থাকেন। তার আগে দরখাস্ত লেখালেখি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খাটাখাটুনি তো আছেই। এরপর তাঁকে যেতে হয়েছিল ফুল কোর্টে। মাননীয় প্রধান বিচারপতি ও আপিল বিভাগের অন্য সব বিচারপতি শহিদুল আলম জেলখানায় ডিভিশন পাবেন, না সাধারণ বন্দীর মতো থাকবেন, সেই প্রশ্নে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে তিনি ডিভিশনই পাবেন। নিশ্চয়ই সবাই মিলে জটিল আইনি প্রশ্নগুলো বিচার-বিবেচনা করে সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন।
এই অধম তো আর সব বোঝে না। ঠাহর করা যাচ্ছে না, কী কারণে মেঝে আর খাটের ব্যাপারটা এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। অ্যাটর্নি জেনারেল এই ব্যাপারটা অর্থাৎ শহিদুল আলমকে মেঝেতে রাত কাটাতে বাধ্য করার জন্য বারবার দেশের সর্বোচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছেন। সম্ভবত রাষ্ট্রের অখণ্ডতা, সার্বভৌমত্ব, দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, অস্থিতিশীলতা, সরকারের ভাবমূর্তি অথবা আইনের পদ্ধতিগত কোনো ব্যাপার—এই গোছের অনেক বাঘা বাঘা ও জটিলতম ব্যাপার হয়তো জড়িত ছিল। শহিদুল আলমকে মেঝেতে শোয়াতে পারলে রাষ্ট্র নিশ্চয়ই এই সবকিছু থেকে পরিত্রাণ পাবে বলে ভাবা হয়েছিল। হয়তো আরও ব্যাপার জড়িত ছিল, যা আমাদের জানা ও বোঝার ক্ষমতা নাই।
শুনেছি, ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে কথা বলা বা আন্দোলন করার জন্য যেসব রাজবন্দীকে ধরা হতো, তাঁরাও অকাতরে ডিভিশন পেতেন। তাঁদের ডিভিশন বাতিলের জন্য তখনকার ব্রিটিশ-ভারতের সর্বোচ্চ আদালত অর্থাৎ হাউস অব লর্ডস পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার মামলা–মোকদ্দমা করেছে বলে শুনিনি। অবশ্য সেটা ছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল আর এখন স্বাধীন বাংলাদেশ। শহিদুল আলমের মতো ষাটোর্ধ্ব এই অধম কখন কী বলতে গিয়ে কী হয় কে জানে। টেলিভিশনে কথা বলি, মাঝেমধ্যে লেখালেখিও করি। কোথায় কী বলে বা লিখে কোন আইনের খপ্পরে পড়ি, সে নিয়ে শঙ্কা সব সময় থাকে। কখন যে অধমের জন্য কারাগারের মেঝে বিছানা নিয়ে ভীষণ আইনি টানাটানি লাগে, সেই আশঙ্কা এখন আরও বেড়ে গেছে। রাষ্ট্রের সব প্রতিষ্ঠান চলে আমাদের মতো গোবেচারা নাগরিকের করের টাকায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের বিনে পয়সায় শিক্ষা লাভের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য আমরা যেমন কর দিই, তেমনি আমাদের করের টাকায় চলে সরকার, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস, ছোট থেকে বড় সব আদালত। আমাদের টাকা কী কারণে কীভাবে খরচ হচ্ছে, সেটা জানা এবং কারণ ব্যাখ্যা চাওয়ার অধিকার আমাদের আছে। তবে আমরা নাগরিকেরা অনেক উদার চিত্তের মানুষ। হিসাব–নিকাশ এখনো দাবি করি নাই।
শহিদুল আলম কারাগারে আছেন। তিনি সেখানে ডিভিশনজনিত ছোটখাটো সুযোগ–সুবিধা পেলে রাষ্ট্রের নিশ্চয়ই ভীষণ আপত্তি ছিল, তাই এই প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল দ্বারস্থ হয়েছিলেন মাননীয় আপিল বিভাগের।
গায়েবি বা ভুতুড়ে মামলার বর্তমান সময়ে কোন আইনি প্রশ্নটা কীভাবে যে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং সেই সঙ্গে কোন ইস্যুতে খোদ অ্যাটর্নি জেনারেল আপিল বিভাগ পর্যন্ত যান, তা নাগরিকদের পক্ষে বোঝা দায়। তবে এই সব হতে থাকলে রাষ্ট্রটা যে ভালো চলছে না, তা স্পষ্টই বোঝা যায়।
ড. শাহদীন মালিক সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এবং ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের আইনের শিক্ষক