বিশ্বায়নের কাল

মেঘের ছায়ায় মুক্ত সাংবাদিকতা

আজ সাংবাদিকতার স্বাধীনতা তথা মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। ইংরেজিতে ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ডে। সাংবাদিকতার স্বাধীনতা উদ্‌যাপনের দিন। 

সুতরাং আসুন, আমরা দিবসটি উদ্‌যাপন করি। উদ্‌যাপন করি দেশের ইতিহাসে সর্বাধিকসংখ্যক টেলিভিশন চ্যানেল সচল থাকাকে, সহস্রাধিক সংবাদপত্রের প্রকাশনাকে, হাজারখানেক অনলাইন পোর্টালের আত্মপ্রকাশকে। উপচে পড়া তথ্যপ্রবাহে পাঠক-দর্শকদের নাকাল করতে পারার কৃতিত্ব উদ্‌যাপন করি। ধারণা করি, আজ বাংলাদেশের অনেক জায়গাতেই সরকারিভাবে দিবসটি উদ্‌যাপন করা হবে।

সাংবাদিকতার স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সরকারের উদ্যোগকেও তাহলে সাধুবাদ জানাতে হয়। কিন্তু ধন্দটা সেখানেই। অধিকার নিয়ে কাজ করে যেসব সংগঠন—অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ), কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে)—সবাই বলছে, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের অধিকার আরও সংকুচিত হয়েছে। অ্যামনেস্টি বলছে, সরকার মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রমাণ হিসেবে গণমাধ্যমের (সংখ্যাগত) আধিক্যের দৃষ্টান্ত দিয়ে থাকে। তবে অধিকাংশ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানই রাজনৈতিক সমর্থকদের মালিকানাধীন অথবা নিয়ন্ত্রণে। গণমাধ্যমে বহুত্ব (প্লুরালিটি) আছে, কিন্তু সেগুলোর সুর একটাই। ভিন্নমতের কোনো স্থান নেই। ‘বাংলাদেশ: কট বিটুইন ফিয়ার অ্যান্ড রিপ্রেশন’ শিরোনামের এক প্রকাশনায় তারা বলেছে, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে একদিকে আছে উগ্রপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর সৃষ্ট আতঙ্ক, অন্যদিকে আছে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন।

আরএসএফ প্রতিবছর সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে বৈশ্বিক সূচক করে, সেই প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে এ বছর আমাদের অবনতি ঘটেছে। ১৮০টি দেশের মধ্যে আমাদের অবস্থান গত বছর ছিল ১৪৪, এবার ১৪৬। আরএসএফ বলছে, বাংলাদেশ সরকার দেশের সংবিধান বা রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের সমালোচনাকে সহজভাবে নেয় না। যেসব সাংবাদিক ও ব্লগার এ বিষয়গুলোতে সেন্সরশিপ বা সেলফ-সেন্সরশিপের বিরোধিতা করেন, তাঁরা হয় ইসলামপন্থী জঙ্গিদের দ্বারা হত্যার ঝুঁকিতে পড়ে যান, নয়তো যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। ২০১৬ সালে সরকার তার সমালোচকদের প্রতি, বিশেষ করে মিডিয়ার প্রতি কঠোরতর অবস্থান নিয়েছে। সরকারের
তরফ থেকে মিডিয়ার প্রতি বৈরী বক্তব্য প্রদান, কয়েক ডজন ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেওয়া এবং অনেক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলার মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট হয়েছে।

সিপিজে তার সর্বসাম্প্রতিক প্রকাশনা অ্যাটাকস অন দ্য প্রেস-এর ‘জোন অব সাইলেন্স’ নিবন্ধে বলেছে, বাংলাদেশে ব্লগারদের ওপর ধারাবাহিক হামলায় যে নজিরবিহীন নৃশংসতা দেখা গেছে, সেগুলোর লক্ষ্য ছিল অনাহূত কণ্ঠ রোধ করা এবং হামলাগুলো তা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। হুমকির মুখে থাকা ব্লগাররা দেশান্তরি হয়েছেন অথবা তাঁদের সমালোচনা কমিয়েছেন। এই কৌশল যে শুধু ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীরাই অনুসরণ করছে তা নয়, বিভিন্ন অপরাধী চক্রও ওই পথ অনুসরণ করছে। অধিকাংশ হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি। আবার সরকারের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, এ ধরনের লেখালেখির বিষয়ে সাবধান করে দিয়েছেন।

বাংলাদেশের এই চিত্রটিতে যদি আপনার মধ্যে হতাশার জন্ম হয়, তাহলে আপনার জন্য আরও দুঃসংবাদ আছে। কেননা, বিশ্বজুড়েই সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের ওপর চাপ বাড়ছে। আরএসএফ তার সাংবাদিকতার স্বাধীনতার সূচককে ভিত্তি করে যে বিশ্বমানচিত্র তৈরি করে, তা গেল বছর আরও কালো হয়েছে। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ফ্রিডম হাউস বলছে যে ১৩ বছরের মধ্যে ২০১৬-তে বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা এখন সবচেয়ে কম। বিশ্বে এখন মাত্র ১৩ শতাংশ মানুষ মুক্ত সাংবাদিকতার সুফল ভোগ করছেন। ফ্রিডম হাউসের ভাষায় যেখানে রাজনৈতিক সংবাদ বলিষ্ঠ, সাংবাদিকদের নিরাপত্তার গ্যারান্টি আছে, গণমাধ্যমের কাজে রাষ্ট্র নাক গলায় না এবং গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান আর্থিক বা আইনগত চাপের মুখে থাকে না, সে রকম পরিবেশই হলো মুক্ত গণমাধ্যমের পরিবেশ। ফ্রিডম হাউস গেল সপ্তাহে তার প্রকাশনা ফ্রিডম অব দ্য প্রেস ২০১৭: প্রেস ফ্রিডমস ডার্ক হরাইজন-এ (সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার মেঘাচ্ছন্ন দিগন্ত) বলেছে, বিশ্বের ৪৫ শতাংশ মানুষ এমন পরিবেশে বাস করছে, যেখানে সংবাদমাধ্যম স্বাধীন নয়। ফ্রিডম হাউসের মূল্যায়নে বাংলাদেশ মুক্ত নয়। গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থান এক পয়েন্ট কমেছে। বিশ্বে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার এই করুণ দশার জন্য ফ্রিডম হাউসের প্রতিবেদনে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের ওপর হামলা, কর্তৃত্বপরায়ণ পরিবেশে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের ওপর চাপ বৃদ্ধি এবং সীমান্তের বাইরে রুশ ও চীনা কর্তৃপক্ষের প্রভাবকেও দায়ী করা হয়েছে। বৃহৎ গণতন্ত্রে নির্বাচিত নেতাদের গণমাধ্যমের ওপর আক্রমণের দৃষ্টান্ত হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প, তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, দক্ষিণ আফ্রিকার জ্যাকব জুমার কথা এতে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদেশি এসব প্রতিষ্ঠানের পর্যবেক্ষণ বা মূল্যায়নের জবাবে সরকার যা বলেছে, সেই কথার উল্লেখ অ্যামনেস্টির প্রকাশনাতেই আছে। সংবাদপত্র, সাময়িকী, টিভি চ্যানেল, রেডিও এবং অনলাইন পোর্টালের সংখ্যাকেই তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রমাণ হিসেবে তুলে ধরে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, গণমাধ্যমের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে হুমকি। রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর হামলায় নিহত হচ্ছেন সিরাজগঞ্জের আবদুল হাকিম শিমুলের মতো মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকেরা। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার মতো বিধির অপপ্রয়োগ (মাত্র দুদিন আগে এই ধারায় আটক হয়েছেন সাংবাদিক রাজু আহমেদ) ঘটছে। হরহামেশাই আদালত অবমাননা, মানহানির আইনের অপপ্রয়োগ ও হয়রানি চলছে। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের ব্যবহারও বাদ যায়নি। আর্থিক চাপ সৃষ্টির জন্য সরকারি বিজ্ঞাপনের বাইরে বেসরকারি বিজ্ঞাপনেও বাধা সৃষ্টির নজির তৈরি হয়েছে।

বিশ্বব্যাপী ৩ মে এই দিবস পালনের চল শুরু হয়েছে ১৯৯৩ সালে। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা, ইউনেসকো দিবসটি পালনের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে। ইউনেসকোর বর্ণনায় সাংবাদিকেরা শুধু যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কাঙ্ক্ষিত উপকারভোগী তা-ই নয়, বরং তাঁরা এর প্রতীক। একটি সমাজ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার কতটা প্রসার চায় অথবা তা কতটা সহ্য করে, তার মাত্রা প্রতিফলিত হয় সাংবাদিকদের মাধ্যমে। এই দিবসটি নাগরিকদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখনো প্রকাশনা সেন্সর করা হয়, জরিমানা করা হয় এবং কখনো কখনো তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। সাংবাদিক, সম্পাদক ও প্রকাশকদের ওপর হামলা হয়, তাঁদের হয়রানি করা হয়, আটক করা হয়, এমনকি হত্যাও করা হয়। এটি সরকারগুলোকেও স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দিন যে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দেওয়া তাদের দায়িত্ব। এ বছরের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘সংকটকালে সমালোচকের মন: শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা (ক্রিটিক্যাল মাইন্ডস ফর ক্রিটিক্যাল টাইমস: মিডিয়াস রোল ইন অ্যাডভান্সিং পিসফুল, জাস্ট অ্যান্ড ইনক্লুসিভ সোসাইটিজ)।

কাতারভিত্তিক বৈশ্বিক টিভি চ্যানেল আল–জাজিরা মিসরে সেনাশাসনের সময় তাদের কয়েকজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তার ও বিচারের প্রতিবাদে যে স্লোগানটি তৈরি করেছিল, সেটি আমাদের সবার বারবার আওড়ানো প্রয়োজন। ‘সাংবাদিকতা কোনো অপরাধ নয়’ (জার্নালিজম ইজ নট এ ক্রাইম), এই বক্তব্যটি যতক্ষণ পর্যন্ত সরকার, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কিংবা যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক-সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী মেনে না নিচ্ছেন, ততক্ষণ অবধি এই স্লোগান জারি রাখা প্রয়োজন।

সবাইকে মুক্ত সাংবাদিকতার সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ এবং যাঁরা এই লড়াইয়ে সঙ্গী হয়ে আছেন, তাঁদের অভিনন্দন।

কামাল আহমেদ: সাংবাদিক