যানজটে অচল হয়ে আর বায়ু ও শব্দদূষণে বিষাক্ত হয়ে ঢাকা প্রায় পরিত্যক্ত মহানগরে পরিণত হয়েছে। দুই বছর টানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সরকার ও প্রশাসন ঢাকার যানজট বিষয়ে আত্মতুষ্টিতে ভুগছিল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর ঢাকা যেন অচল হয়ে পড়েছে। অন্ধ হলেই প্রলয় বন্ধ থাকে না!
বিগত আড়াই দশকে বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক ও আওয়ামী লীগের ছয়টি সরকার মিলে ঢাকায় সাতটি উড়াল সড়ক করেছে, কিন্তু যানজট কমেনি। বর্তমানে একটি মেট্রো রেললাইনের কাজ চলছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে একটি বিআরটিসহ আরও চার রুটে মেট্রোরেল তৈরির পরিকল্পনা আছে। ১৩ বছর পর সব রুটে যখন মেট্রোরেল চালু হবে, তখনো পরিবহনব্যবস্থার মাত্র ১৭ ভাগ চাপ সামাল দেওয়া যাবে। তার মানে, যানজট পরিস্থিতি পুরোপুরি সমাধান হচ্ছে না এত উন্নয়নের পরও।
রাজধানীর যানজট নিরসনে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ সালে ঢাকা ও এর পার্শ্ববর্তী এলাকায় দৈনিক গড়ে তিন কোটি ট্রিপ বা লোক চলাচল ছিল (একজন লোক যতবার চলাচল করে, ততটা ট্রিপ তৈরি হয়)। ২০২৫ সালে ৪ কোটি এবং ২০৩৫ সালে ৫ কোটির বেশি ট্রিপ তৈরি হবে। এর বাইরেও আছে পণ্য পরিবহন। বিষয়টি বুঝতে পেরে সরকার এখন ঢাকার মাটির নিচের ২৫ থেকে ৭০ ফুট গভীরে গিয়ে ৪০ লাখ যাত্রীর পারাপার সক্ষমতার ১১টি সাবওয়ে নির্মাণের কথা ভাবছে। সমস্যা হচ্ছে, ২০১২ সালে একনেকে পাসকৃত মেট্রোরেলের একটি লাইনও ১০ বছরে এসে উদ্বোধনের মুখ দেখেনি। ঘনবসতিপূর্ণ ইটপাথরের বস্তিতে ২০৩৫ বা ২০৪০ আগে তারা আদৌ কোনো সাবওয়ে উদ্বোধন করতে পারবে কি? তত দিনে ঢাকা কি শতভাগ পরিত্যক্ত হয়ে পড়বে না? তাহলে উপায় কী? এখানে সাত ধাপের ‘বিগ-সেভেন’ নামে একটা মডেল প্রস্তাব করছি।
তদবিরভিত্তিক প্রশাসন পুরোপুরি রূপান্তর করে মেধা, যোগ্যতা ও বিধিবদ্ধ আইনি প্রক্রিয়াভিত্তিক উন্মুক্ত ডিজিটাল প্রশাসন করতে হবে। ঢাকার বাইরের কর্মচারী-কর্মকর্তা কিংবা যেকোনো সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানপ্রধান-উপপ্রধানসহ লাখ লাখ মানুষকে দাপ্তরিক কাজ, বরাদ্দ, ক্রয়, অনুমতিপত্র, অনুমোদন, পদায়ন, বদলি কিংবা সমস্যা নিষ্পত্তির জন্য ঢাকার সচিবালয়ে ডেকে আনা বন্ধ করতে হবে। সব কাজ ডিজিটাল সফটওয়্যার, আউটলুক মেইল ও জুম মিটিং ও গুগল মিটের মতো ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে করতে হবে। এতে রাস্তায় লোক ও গাড়ি চলাচল কমবে, সরকারের পরিবহন ও জ্বালানি খরচ, সর্বোপরি চুরি-দুর্নীতিও কমে আসবে।
সরকারি অফিসের প্রতিটি তদবির, ‘লাঞ্চের পরে আসেন, বিকেলে আসেন, স্যার বাইরে, কাল আসেন, স্যার ব্যস্ত, আজকে হবে না’ ইত্যাদি ঘটনা একবারের জায়গায় পাঁচ-দশবার যাতায়াত বা ট্রিপ তৈরি করে (পড়ুন রাস্তার যানজট)। তাই এসব স্যারদের শতভাগ যোগাযোগ ই-মেইলভিত্তিক, রেকর্ডেড ফোন কল এবং অন্তত নব্বই শতাংশ মিটিং অনলাইনে করতে হবে। আবশ্যকীয় দৈহিক সাক্ষাৎগুলোর কিছু আঞ্চলিক অফিসে যাবে। সচিবালয়ের কেন্দ্রীয় কাজ বিকেন্দ্রীকরণ করে উপজেলার অফিসে যাবে। কাগজের ফাইলের পরিবর্তে ডিজিটাল ডোসিয়ার হবে। সব ধরনের ফাইল প্রসেসিং সময় নিয়ন্ত্রিত করতে হবে। যেকোনো ফাইল কাগজভিত্তিক না হয়ে সফটওয়্যার ও ডেটাবেইসভিত্তিক হবে। সচিব-কর্তা-স্যারদের নিরীক্ষা, পর্যালোচনা অনুমতির অনুমোদন স্বাক্ষরের জন্য সুনির্দিষ্ট সময় বরাদ্দ থাকবে, ওই সময়ের মধ্যে কাজ না করলে কাজ উচ্চ স্তরে চলে যাবে। জরিমানা হিসেবে স্যাররা পদায়ন ও প্রমোশনে শাস্তির পয়েন্ট পাবেন।
রাজধানীর দুই কোটি মানুষসহ সারা দেশের আরও কয়েক কোটি মানুষ আগারগাঁওয়ের অফিসগুলোতে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট ইত্যাদি অফিসে যান। দেশের প্রায় ২০ লাখ গাড়ির ফিটনেসের কাজে, ড্রাইভিং লাইসেন্সের কাজে, মামলা নিষ্পত্তির কাজে একবারের জায়গায় তিন থেকে দশবার মিরপুরে যেতে হয়। এতে যানজট তৈরি হয়। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স গোপনীয় ডাকযোগে ব্যক্তির ঠিকানায় ডেলিভারি দিতে হবে, আর যাবতীয় আবেদন নিরীক্ষা ও সাক্ষাৎকার হবে অনলাইনে এবং ওয়ার্ডের ওয়ান-স্টপ ডিজিটাল সেবাকেন্দ্রে। ফিঙ্গার শনাক্তকরণ আইরিশ যন্ত্রপাতি নিয়ে যেতে হবে থানায় থানায় বিশেষ সময়ে। কোটি মানুষ কেন্দ্রীয় সেবাকেন্দ্রে যাবে না, বরং সেবাকেন্দ্র বিকেন্দ্রীভূত হয়ে মানুষের দোরগোড়ায় আসবে।
ড্রাইভিং লাইসেন্স ও মোটর গাড়ির ফিটনেস যাচাই প্রতিটি কাজ থানাভিত্তিক লাইসেন্স দিয়ে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে, বিআরটিএ শুধু কাজের মান নিয়ন্ত্রণ ও অডিট করবে। মোটরগাড়ি সড়ক আইন ভাঙলে, দুর্ঘটনা করলে ডিজিটাল ক্যামেরায় শনাক্ত করে স্বয়ংক্রিয়ভাবে মালিকের ব্যাংক থেকে জরিমানা কেটে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। পুলিশ রাস্তায় কোনো গাড়ি থামাতে পারবে না।
প্রাথমিক পর্যন্ত প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে নিজ ওয়ার্ডের সীমানায় এবং প্রত্যেক মাধ্যমিক শিক্ষার্থীকে নিজ থানায় অবস্থিত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদানে বাধ্য করতে হবে। এতে ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে এবং যানজট কমবে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় উন্মুক্ত থাকবে, তবে ঢাকার বাইরের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সব আধুনিক, কর্মোপযোগী এবং চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চাহিদামাফিক কারিগরি বিভাগ খুলতে হবে। ঢাকার বাইরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও সভাপতিকে বাধ্যতামূলক আবাসিক হতে হবে। এভাবে জেলা, উপজেলা ও মফস্বল চিকিৎসকদের কর্মস্থলে বসবাসের বাধ্যবাধকতা থাকবে। নগরে বসবাস করে মফস্বল নিয়ন্ত্রণের বর্তমান যানজট সহায়ক মডেল বন্ধ করতে হবে।
কার্যকর স্থানীয় শাসন এবং ডিজিটাল প্রশাসনের মাধ্যমে ক্ষমতা ও শাসনব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ নিশ্চিত করে ঢাকার বাইরে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-সেবা-চাকরি-নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে যাতে হবে। নগরায়ণের, কর্মের, শিক্ষার, স্বাস্থ্যের, নিরাপত্তার; অর্থাৎ জীবনের সব ঘটনা ও প্রয়োজনের একমুখী ঢাকাকেন্দ্রিক স্রোত থামাতে হবে।
সুস্পষ্টভাবে বলতে গেলে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সচিবালয় এবং জাতীয় সংসদ থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকৃত হয়ে সিটি করপোরেশন, পৌর করপোরেশন এবং স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন স্তরে না নিলে এবং যাবতীয় সরকারি ও বেসরকারি সেবা শহরের ওয়ার্ড, গ্রাম ও মফস্বলের উপজেলা ও ইউনিয়নে না গেলে ঢাকার ও অপরাপর মহানগরের যানজটের স্থায়ী কোনো সমাধান হবে না; অর্থাৎ স্থানীয় সরকারকে টেকসই মডেলে ক্ষমতায়ন করে সত্যিকারের ডিজিটাল প্রশাসন প্রবর্তনই মূল কাজ। মানুষ যেখানে বসবাস করে সেখানেই তাকে জন্মসনদ থেকে শুরু করে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পাসপোর্ট, পুলিশি সেবা এবং সর্বোপরি কর্মের জোগান দিতে হবে। পাশাপাশি প্রতিটি জেলা ও বিভাগীয় শহরে উন্নত স্কুল-মাদ্রাসা, হাসপাতাল, ব্যাংকিং সেবা, বিনোদনকেন্দ্র এবং শিল্প, উদ্যোক্তালয়সহ নিবিড় নিরাপত্তাবলয় তৈরি করে মানুষকে ঢাকা থেকে সরাতে হবে।
ডিজিটাল প্রশাসন নিশ্চিত করতে পারলে কেন্দ্র বা সচিবালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের সুবিধার কথা বলে ঢাকায় প্রধান কার্যালয় রাখার বাধ্যবাধকতা উঠে যাবে। সরকারি-বেসরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয়, সেনা-নৌ-বিমান-আনসার-পুলিশের সদর দপ্তর, সচিবালয় ও মন্ত্রণালয়ের প্রধান অফিসগুলোকে জেলা ও বিভাগে নিতে হবে; অর্থাৎ আঞ্চলিক কর্ম তৈরির পরিকল্পনায় যেতে হবে। ডিজিটাল প্রশাসনের যুগে একটি শহরে সব সরকারি-বেসরকারি অফিস করার যুক্তি নেই। করপোরেট কর ও শুল্কে পর্যাপ্ত ছাড় ও প্রণোদনা দিয়ে বেসরকারি ব্যাংক বিমা ও করপোরেট কোম্পানির প্রধান কার্যালয় বিভাগীয় শহরে পাঠানো খুবই সহজ।
জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মুখে বিশেষ সময়ে বৃষ্টিপাতের প্রকোপ বেড়েছে। ঢাকায় বৃষ্টির পানিতে মাটি ফিল্টার করার জন্য পুকুর লেক কিংবা উন্মুক্ত পার্ক নেই। বাসাবাড়ির চারপাশ বাঁধাই করা। বৃষ্টি ও ড্রেন-স্যুয়ারেজের পানি সব মিলিয়ে জলাবদ্ধতার মহাবিপর্যয়ে পড়ে ঢাকা। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানি তুলতে তুলতে পানির স্তর নেমে গেছে। এমতাবস্থায় খাল উদ্ধার, ড্রেনেজ মাস্টারপ্ল্যান বাস্তবায়ন ও আরবান রানঅফ না কমিয়ে পাতালরেল ঝুঁকিপূর্ণ স্বপ্ন।
ঢাকার দরকার কম খরচের আধুনিক সারফেইস ট্রাম, বৈদ্যুতিক ট্রাম বাস ও বিআরটি। এগুলো বর্তমান রাস্তায় চলবে, ট্রামের জন্য ফ্লাইওভার লাগে না। ড্রেনেজ ব্যবস্থা ঠিক করা হবে, তবে অত্যধিক জলাবদ্ধতায় ট্রামগুলোকে পার্কিংয়ের জন্য ঢাকার আশপাশের এলাকায় কয়েকটি উঁচু পার্কিং লট বানাতে হবে। ট্রাম, বৈদ্যুতিক ট্রাম বাস সব এলাকার সব মাঝারি ও বড় রাস্তায় বাস্তবায়ন করা হবে, অলিগলি ছাড়া। প্রয়োজনে পুরো রাস্তাই বা তার অর্ধেক ট্রামকে ছেড়ে দিতে হবে, সেখানে কোনো ব্যক্তিগত গাড়ি চলবে না। ঢাকায় কোনো ব্যক্তিমালিকানাধীন বাস থাকবে না। শুধু চৌরাস্তায় একটা রাস্তাকে ড্রেনেজ, পাম্পিং সুবিধাসহ আন্ডারপাসে নিয়ে যেতে হবে। এরপরে আসবে একমুখী রাস্তা, জোড়-বিজোড় গাড়ির ধারণা, রাজধানীর ব্যক্তিগত গাড়িতে ব্যবহৃত জ্বালানির দ্বিগুণ মূল্য, অতি উচ্চ কার্বন কর, ব্যক্তিগত গাড়ির উচ্চ রুট ফি, দ্বিতীয় গাড়িতে প্রথম গাড়ির ৬ থেকে ১০ গুণ শুল্কারোপ এসবের বাস্তবায়ন।
পাশাপাশি ঢাকার বাইরের ও প্রবেশপথগুলোকে আন্তসংযোগ করুন। জলপথ, সার্কুলার রেল, রিং-রডের মাধ্যমে। ঢাকার ভেতর দিয়ে বাইরের পরিবহন চলাচল বন্ধ করুন। আন্তজেলা বাসস্টেশন ঢাকার প্রবেশপথের বাইরে চলে যাবে। ট্রাম, বিআরটি ও মেট্রোরেলের সঙ্গে প্রবেশপথগুলো সংযুক্ত হবে।
আশি ও নব্বই দশকে প্রকৌশলী-স্থপতিরা কাঞ্চন ব্রিজের ওপারে রূপগঞ্জে সচিবালয় সরাতে পরামর্শ দিয়েছিলেন অনেকটা মালয়েশিয়ার পুত্রজায়ার আদলে। কোনো সরকারই সে কথা শোনেনি। শীতলক্ষ্যা, বালুসহ কয়েকটি নদ-নদীর ক্যাচমেন্ট এলাকা বালু ভরাট করে একের পর এক অভিজাত আবাসিক প্রকল্প করা হয়েছে, সেগুলো আর বাড়ানোর সুযোগ নেই।
মেট্রোরেল কিংবা পাতালরেল অসহনীয় যানজট ও বিশৃঙ্খল গণপরিবহনব্যবস্থা থেকে স্থায়ী মুক্তি দেবে না, মুক্তি আসবে সেবাদানের পদ্ধতিগত পরিবর্তনে, রাজনৈতিক-প্রশাসনিক ক্ষমতার কার্যকর চূড়ান্ত বিকেন্দ্রীকরণে এবং ব্যবসা-সেবা-শিক্ষা-চাকরিকে ঢাকার বাইরে বিকেন্দ্রীভূত করে। ঢাকাকে বাঁচানোর উপায়-কৌশল আছে, সিদ্ধান্ত নেতৃত্বের!
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার-চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবনীয় কথামালা। faiz.taiyeb@gmail.com