মৃত বিশ্বায়ন, ভবিষ্যৎ আঞ্চলিক জোট?

বিশ্বায়ন বদলে দিয়েছে পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপ। কিন্তু বিশ্বায়নের সুদিন নাকি শেষ হতে চলেছে! এরই মধ্যে অনেকে বিশ্বায়নকে ‘মৃত’ ঘোষণাও করে দিয়েছেন। ছবি: রয়টার্স
বিশ্বায়ন বদলে দিয়েছে পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপ। কিন্তু বিশ্বায়নের সুদিন নাকি শেষ হতে চলেছে! এরই মধ্যে অনেকে বিশ্বায়নকে ‘মৃত’ ঘোষণাও করে দিয়েছেন। ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের শত শত দেশের কোটি কোটি মানুষ আজ প্রযুক্তির কল্যাণে একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। কিন্তু প্রযুক্তি দুনিয়া কেন যোগাযোগের এসব কৌশল উদ্ভাবনে আগ্রহী হলো? কারণ, বিশ্বায়ন। পুরো বিশ্বকে একটি অভিন্ন পৃথিবীতে রূপ দেওয়ার লক্ষ্যেই মানুষের মধ্যে যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতির চেষ্টা হয়েছে। সেই প্রচেষ্টা সফলও হয়েছে। শুধু প্রযুক্তি নয়, বিশ্বায়ন বদলে দিয়েছে পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপও। কিন্তু বিশ্বায়নের সুদিন নাকি শেষ হতে চলেছে! এরই মধ্যে অনেকে বিশ্বায়নকে ‘মৃত’ ঘোষণাও করে দিয়েছেন।

যেসব তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের তাবৎ অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত ভাবনা পরিবর্তিত হয়ে গেছে, সেগুলোর তালিকায় বিশ্বায়ন বেশ ওপরের দিকেই থাকবে। বিশ্বায়নের মূল বিষয় হচ্ছে মুক্ত ও অবাধ বাণিজ্য। এই মুক্ত ও অবাধ বাণিজ্যের ধারণাতেই মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির উত্থান হয়েছে। বিশ্বায়নের ভাবনায় ছিল, কোনো বড় কোম্পানি শুধু একটি দেশের সীমানায় আটকে থাকবে না। অর্থাৎ, আমেরিকার একটি কোম্পানি সামর্থ্য থাকলে বাংলাদেশেও বাণিজ্য করতে পারবে। বাণিজ্যের পাশাপাশি দেশগুলোর মধ্যে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানও চলবে। এভাবেই বিভিন্ন দেশ একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত হবে। একটি নির্দিষ্ট দেশের অর্থনৈতিক সূচকের ওঠানামা তখন অনেকটাই নির্ভর করবে বৈশ্বিক অর্থনীতির ওপর। অর্থাৎ, বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং সব মিলিয়ে একটি বিশাল জাল সৃষ্টি করেছে। ফলে এক জায়গায় সমস্যা দেখা দিলে তা পুরো বৈশ্বিক ব্যবস্থাতেই প্রভাব ফেলে।

বিশ্বায়নের ধারণা অনুযায়ী, এত দিন পুরো বিশ্বক্রমেই ‘একটি গ্রাম’ হওয়ার চেষ্টা করে গেছে। অবাধ বাণিজ্যের প্রভূত সুফলও পাওয়া গেছে। বিশ্বায়নের তত্ত্ব অনুসরণ করেই প্রযুক্তি দুনিয়া চেষ্টা করেছে মানুষে মানুষে দূরত্ব কমানোর। ফেসবুক-টুইটারের রমরমার যুগে বলাই যায়, সেই চেষ্টা পুরোপুরি সফল। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে, বিশ্বায়নের দুর্দিন এসে গেছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, অবাধ বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা। এর ফলে বৈশ্বিক অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে গেছে এবং ঋণের বোঝা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাণিজ্যে পরাশক্তিগুলো ধীরে ধীরে অবাধ বাণিজ্যে বাধা তৈরি করছে নিজেদের স্বার্থে। ফলে বিশ্বায়নের মূলনীতিই আর কার্যকর থাকছে না। সেই সঙ্গে অনেক বড় দেশই বিশ্বায়নের সুধা পান করলেও নিজের দেশে বিশ্বায়নকে ঢুকতে দিচ্ছে না।

সাবেক ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার ও প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ মাইকেল ও’সালিভানের লেখা একটি বই সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম ‘দ্য লেভেলিং: হোয়্যাটস নেক্সট আফটার গ্লোবালাইজেশন’। এ নিয়ে ব্রিটিশ সাময়িকী ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এ একটি নিবন্ধও প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে লেখক মাইকেল ও’সালিভান সরাসরি বিশ্বায়নের মৃত্যু ঘোষণা করে দিয়েছেন। তাঁর মতে, বিশ্বায়নের দিন শেষ। এখন ভবিষ্যৎ নিয়ে আগাম চিন্তা করার পালা। ও’সালিভান মনে করেন, বিশ্বায়নের ‘এক বিশ্ব’ স্লোগান বদলে সেই জায়গা নেবে ‘বহু বিশ্ব’। অর্থাৎ পুরো পৃথিবীতে অঞ্চলভেদে স্থানীয় একতার ধারণা জোরালো হবে এবং সেই অনুযায়ী কয়েকটি মেরুতে বিভক্ত হবে পৃথিবী।

বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর সব দেশের অর্থনীতি পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত এবং সব মিলে একটি বিশাল জাল সৃষ্টি করেছে। ফলে এক জায়গায় সমস্যা দেখা দিলে, তা পুরো বৈশ্বিক ব্যবস্থাতেই প্রভাব ফেলে। ছবি: রয়টার্স

এর কিছু রূপ এখনই দেখা যাচ্ছে। চীন অনেক দিন ধরেই আঞ্চলিক রাজনীতি জোরদার করার চেষ্টা করে আসছে। চীন এমন একটি দেশ, যা বিশ্বায়িত পৃথিবীর অবাধ বাণিজ্যের সম্পূর্ণ আর্থিক সুবিধা ভোগ করলেও নিজ দেশের ভেতরে তা ঢুকতে দিচ্ছে না। বিশ্বায়নের ধারণা অনুযায়ী, বাকি বিশ্বের সঙ্গে চীনা জনগণ ও সমাজের একটি সংযোগ থাকার কথা। কিন্তু তা একেবারে নেই বললেই চলে। কিন্তু বিশ্বায়নের ধারণায় সৃষ্ট বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সুবিধা কাজে লাগিয়েই চীন বিরাট অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এখন চীন এশিয়াকেন্দ্রিক একটি মেরু তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ তারই অংশ। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, ২০১১ সালের তুলনায় ২০১৮ সালে চীনের সঙ্গে কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, লাওস ও মালয়েশিয়ার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ব্যাপক হারে বেড়েছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এসব দেশের বাণিজ্য পাল্লা দিয়ে কমে গেছে। এসব দেশের তালিকায় যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ, পাকিস্তানও। চীন এসব দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগভিত্তিক একটি সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

মাইকেল ও’সালিভান বলছেন, ভবিষ্যতের নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় অঞ্চলভিত্তিক কমপক্ষে তিনটি মেরু সৃষ্টি হবে। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও চীনকেন্দ্রিক এশিয়া। তবে ভারতের উত্থানে চতুর্থ মেরু সৃষ্টির সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না তিনি। তবে রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও জাপান এ ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়বে বলে মনে করেন ও’সালিভান।

গত শতাব্দীর ষাট বা সত্তরের দশক থেকে ধীরে ধীরে বিশ্বায়নের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক গুরুত্ব বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্নায়ুযুদ্ধের সময়টায় যুক্তরাষ্ট্র ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে ওঠে। এসব সংগঠনের মধ্যে রয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (ডব্লিউটিও), ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম, বিশ্বব্যাংক ইত্যাদি। এসব প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব ও কার্যকারিতা ধীরে ধীরে কমছে। আগে এসব প্রতিষ্ঠানের আনুকূল্য ছাড়া ছোট অর্থনীতির দেশগুলোর পক্ষে বিশ্বমঞ্চে উঠে দাঁড়ানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু এখন আঞ্চলিক নানা জোট, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও অভিন্ন মুদ্রাবিষয়ক ভাবনা এই নির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে বিশ্বায়নের মূল অস্ত্রগুলোর ধার আর আগের মতো থাকছে না।

প্রতীকী ছবি

অবাধ বাণিজ্য ছাড়াও বিশ্বায়ন মুক্ত ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির বুলিও ছড়িয়েছিল। সেই জায়গাতেও বাধা আসছে। চীন ও রাশিয়ার দেখাদেখি বিভিন্ন দেশে সীমিত গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের মূলনীতি প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এই নতুন ধারায় উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে দেওয়া হচ্ছে বৈধতার স্বীকৃতি। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে এই নীতি এখন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। ঠিক এই একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অধীনেই বিশ্বায়নের আরেকটি বাহনের ডানা ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। সেটি হলো ইন্টারনেট। চীন ও রাশিয়া অখণ্ড ইন্টারনেট ব্যবস্থায় আর থাকতে চাইছে না, বৈশ্বিক ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ইন্টারনেটের দেশীয় সংস্করণ তৈরি করতে চাইছে। সেই সংস্করণে থাকবে শাসকদের পছন্দসই সব ব্যবস্থা। একই ধরনের রাজনৈতিক মডেলে বিশ্বাসী যেসব দেশ চীন-রাশিয়ার মতো ইন্টারনেটের নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করতে পারছে না, তারা ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরোপ করছে নিয়ন্ত্রণ। অর্থাৎ বিশ্বায়নের ‘অবাধ’, ‘মুক্ত’—এসব বৈশিষ্ট্য দিন দিন ফিকে হচ্ছে।

মাইকেল ও’সালিভান বলছেন, আগামী দিনে চীন-রাশিয়ার মতো দেশগুলোতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গে উদার ও গণতান্ত্রিক দেশগুলোর পক্ষে এই পথে টিকে থাকা কঠিন হবে। দুই ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতাই মূল কারণ।

বিশ্বায়নের ভবিষ্যৎ যদি বিবর্ণই হয়, তবে হয়তো পুরো বিশ্ব আর অভিন্ন সুরে গলা মেলাতে পারবে না। হয়তো এশিয়ার কিছু দেশ যে পথে এগোতে চাইবে, ইউরোপের দেশগুলো তাকে ভুল মনে করবে। অঞ্চলভেদে বদলে যাবে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা। কোনো একক নীতিতে আর বিশ্ববাসী তাল মেলাবে না। তা ভালো হবে, নাকি মন্দ—সময়েই সেই জবাব মিলবে।

অর্ণব সান্যাল: সাংবাদিক
arnab.sanyal@prothomalo.com