মৃণাল সেনের চোখ ও মধ্যবিত্ত সমাজ

মৃণাল সেন
মৃণাল সেন

গতকাল ৩০ ডিসেম্বর ৯৫ বছর বয়সে কলকাতায় চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেনের জীবনাবসান হয়েছে। এই উপমহাদেশের সিনেমাজগতে মৃণাল সেনের চেয়েও বড় ও মেধাবী পরিচালকের জন্ম হয়তো হবে, কিন্তু তাঁর স্থান পূরণ হবে না। ভারতের সিনেমাজগতে মূলধারার বাণিজ্যিক ছবির বিপরীতে অন্য ধরনের ছবির একটি সমান্তরাল ধারা নির্মাণের জন্য মৃণাল সেনের নাম সত্যজিৎ রায় ও ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে একত্রে উচ্চারিত হয়। কিন্তু শিল্পদৃষ্টি ও চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন একে অন্যের চেয়ে আলাদা। কিছু বৈশিষ্ট্যের জন্য মৃণাল সেন ছিলেন অনন্য।

শৈশবের রাজনৈতিক পরিবেশ, যৌবনে কমিউনিস্ট পার্টি এবং ভারতীয় গণনাট্য সংঘের সঙ্গে ওঠাবসা এবং ব্যাপক পড়াশোনা মৃণাল সেনকে গোড়া থেকেই একজন রাজনীতিসচেতন মানুষ ও অঙ্গীকারবদ্ধ শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলে।

প্রথম ছবি ‘রাতভোর’ (১৯৫৬) থেকে ‘আমার ভুবন’ (২০০২) পর্যন্ত তিনি ৩০টি ছবি তৈরি করেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে, সময়ের সঙ্গে বদলেছে তাঁর ছবির বিষয়বস্তু, পাল্টেছে আঙ্গিক, পরিবর্তিত হয়েছে পটভূমি। পঞ্চাশের দশকে যে জায়গা থেকে শুরু করেছিলেন, সেখানে থেমে থাকেননি তিনি। নিরন্তর সামনে এগিয়েছেন, কোনো বৃত্তে আবর্তিত হননি।

একজন আদর্শবাদী আমলার ‘আদর্শবাদ নিয়ে মজা করার জন্য’ ও তাঁর দুর্নীতিগ্রস্ততার ছবি আঁকার’ উদ্দেশ্য নিয়ে ১৯৬৯ সালে মৃণাল সেন হিন্দিতে তৈরি করেন ‘ভুবন সোম’। এই ছবি ছিল তাঁর পূর্ববর্তী ছবিগুলো থেকে, এমনকি তৎকালীন ভারতীয় ছবি থেকে আলাদা ধরনের। আঙ্গিকে-আখ্যানে, সংলাপে-ইঙ্গিতে ‘ভুবন সোম’ মৃণাল সেনের একটি উৎকৃষ্ট সৃষ্টি। ছবিটি দর্শকনন্দিত হয়েছিল এবং পরিচালক হিসেবে মৃণাল সেনকে বিখ্যাত করেছিল। কিন্তু এ সময়ই তিনি সরে এলেন অন্য ধরনের ছবির জগতে—সেটি রাজনৈতিক ছবির জগৎ।

ষাটের দশকের শেষার্ধ থেকে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যে তোলপাড় শুরু হয়, তার ঢেউ লাগে সমাজে, শিল্পে, সাহিত্যে। এটি ছিল এমন এক সময়, যখন রাজনীতিকে অস্বীকার করে কিছু বলা যায় না, করা যায় না, কোনো মহৎ শিল্প সৃষ্টি করা যায় না। সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালকও তখন রাজনৈতিক বিষয়বস্তু নিয়ে ছবি করেছেন—‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। মৃণাল সেনও এ সময়েই পরিচালক হিসেবে রাজনৈতিক পর্বে প্রবেশ করেন। ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ তৈরি করার পর সত্যজিৎ আবার ফিরে যান তাঁর অরাজনৈতিক বলয়ে। কিন্তু মৃণাল সেন আর পেছন ফেরেননি।

দুই.
সত্তরের দশকের গোড়াতে এই বাঁক পরিবর্তনের পর থেকে মৃণাল সেনের ছবি নতুন পথ কেটে এগোতে থাকে। এ সময় কলকাতার মধ্যবিত্তের জীবন ও রাজনীতি নিয়ে নির্মিত তিনটি ছবি ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ ও ‘পদাতিক’ নিয়ে মৃণাল সেলের ‘ক্যালকাটা ট্রিলজি’।

দেখা যায়, এখন থেকে ছবিতে গল্প বলা বাদ দিচ্ছেন তিনি। ঘটনার চেয়ে ঘটনার প্রতিক্রিয়া ও তাৎপর্যের ওপর আলো ফেলছেন বেশি। ঘটনার ধারাবাহিক বর্ণনা না দিয়ে টুকরো টুকরো ছবি তৈরি করছেন এবং সেগুলো জোড়া দিয়ে কোলাজ বা মন্তাজ পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন।

একসময় তাঁর ওপর বের্টোল্ট ব্রেশটের প্রভাবও দৃষ্টি এড়ায় না। ব্রেশটের ‘লেয়ার স্টুক’ বা ‘শিখন-নাটক’-এর মতো তাঁর ছবিগুলোও হয়ে ওঠে শিক্ষণীয়। আঙ্গিকের জন্য তিনি ব্রেশটের কাছে যান। ‘ইন্টারভিউ’ ছবিতে ব্রেশটের থিয়েটারীয় কৌশল তিনি পর্দায় প্রয়োগ করেছেন। ছবির নায়ক অভিনেতার খোলস ছেড়ে বেড়িয়ে এসে দর্শকদের সঙ্গে কথা বলে, জানিয়ে দেয় যা দেখছেন তা অভিনয়মাত্র। ব্রেশটের মতো তাঁরও লক্ষ্য দর্শককে সচেতন করা, অভিভূত করা নয়। তাই তিনিও অভিনয়ের মাঝে তাল কেটে দর্শককে বাস্তবে নিয়ে আসেন।

মৃণাল সেনের ছবিতে কলকাতা আর কলকাতার মধ্যবিত্ত বারবার উঠে আসে। কারণ, তিনি মধ্যবিত্ত সমাজকে উত্তমরূপে চিনেছিলেন। জানতেন তাদের ভেতরটা কত ফাঁপা, বুঝতেন তাদের দৌড় কতটুকু। তাই তিনি মধ্যবিত্তের মুখোশ খুলে ফেলেন হ্যাঁচকা টানে। দেখিয়ে দেন তাদের পদে পদে পরাজিত হওয়ার, আত্মসমর্পণ করার দৃশ্য।

কিন্তু যখন তিনি অনাবৃত করতে চেয়েছেন শ্রেণিশোষণের নির্মমতা, আঁকতে চেয়েছেন ক্রুদ্ধ মানুষের ছবি, শোনাতে চেয়েছেন শোষণ নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জান্তব চিত্কার, তখন মেরুদণ্ডহীন পলায়নপর মানুষের ফ্যাকাশে জীবনের বাইরে এসেছেন তিনি—তখন শ্রমজীবী মানুষের জীবন হয়েছে তাঁর ছবির উপজীব্য।

ছবিকে চিত্রগ্রাহী করার চেয়ে দর্শকের চেতনার মর্মমূলে নাড়া দেওয়া ছিল তাঁর কাছে বেশি জরুরি। তাই ‘খারিজ’ দেখে বালক ভৃত্য পালিনের করুন মৃত্যুতে দর্শক যত ব্যথিত হন, আপন গৃহভৃত্যের প্রতি নিজের আচরণের কথা ভেবে বিব্রত হন তার চেয়ে বেশি। মুন্সী প্রেমচান্দের গল্প থেকে তৈরি তেলেগু ছবি ‘ওকা ওরি কথা’র ভেঙ্কায়া, কিষ্টা, নীলম্মার দারিদ্র্যের ভয়াবহ কাহিনি দর্শকের মন করুণায় দ্রবীভূত করে না, শোষণনির্ভর নির্মম সমাজব্যবস্থার প্রতি দর্শকদের মনে সচেতন ক্ষোভ তৈরি করে। ‘অকালের সন্ধানে’র উদ্দেশ্য একজন দুর্গার প্রতি দর্শকদের সহানুভূতি জাগানো নয়, চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া কীভাবে, কী প্রক্রিয়ায় ভেঙে যাচ্ছে হাজার হাজার দুর্গার জীবনের আশা, আকাঙ্ক্ষা, নিরাপত্তা।

ছবির কাহিনি বা বিষয়বস্তু নির্বাচনের সময় মৃণাল সেন সব সময় তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ কাহিনিই বেছে নিয়েছেন। এটি খেয়াল করার বিষয় যে সত্যজিৎ রায়ের মতো তিনি রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোনো লেখকের কালোত্তীর্ণ গল্প-উপন্যাস চিত্রায়িত করেননি। কারণ, তিনি রবীন্দ্রনাথ বা বিভূতিভূষণের চোখ দিয়ে সমাজ বা জীবনকে দেখেননি। তাঁর কাছে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি, নিজের অঙ্গীকারটিই ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তাই তিনি তাঁর অঙ্গীকারের কষ্টিপাথরে যাচাই করেই কাহিনি নির্বাচন করেন—যে কাহিনি তাঁর নিজের দৃষ্টিভঙ্গির উপযুক্ত বাহন হবে, প্রয়োজনে যে কাহিনির খোল নলচে পাল্টানো যায়।

মৃণাল সেন ব্যবসাসফল পরিচালক ছিলেন না। তাঁর অনেক ছবিই দর্শকনন্দিত হয়নি। ছবি নিয়ে তিনি যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তারও সবটুকু উতরায়নি। কিন্তু তবু তিনি আপস করেননি পুঁজির সঙ্গে, বন্ধ করেননি নতুন পথ কেটে চলা। কারণ, মৃণাল সেনের ছবি তৈরির প্রেরণা এসেছে তাঁর অঙ্গীকার থেকে, কাঁচা পয়সার লোভ থেকে নয়।

চৌধুরী মুফাদ আহমদ। প্রাবন্ধিক
cmahmed@gmail.com