বাংলাদেশের বাজেট মানেই কিছু অবাস্তব সংখ্যার চাকচিক্যময় উপস্থাপনা। মূল বাজেট, সম্পূরক বাজেট, কাটছাঁট করে বছর শেষের সংশোধিত বাজেট কোনোটার সঙ্গেই সরকারের প্রকৃত আয় ও ব্যয়ের হিসাব মেলে না। বাজেট যেন অর্থনীতি, গণিত ও হিসাববিজ্ঞান নয়; বরং ইচ্ছামাফিক প্রাক্কলিত কিছু সংখ্যা উপস্থাপনের বিশ্রী রকমের বাড়াবাড়ি! বাজেটে আয়ের সংস্থান সীমিত হলেও তরতরিয়ে বেড়ে চলছে সরকারের পরিচালনা ব্যয়, ঘাটতি বাজেট, সঞ্চয়পত্র ঋণ, বাণিজ্যিক ব্যাংক ঋণ, এমনকি বৈদেশিক ঋণ। ঘাটতি ও ব্যয়ের প্রাক্কলিত সংখ্যার উল্লম্ফন একেবারেই অনুমিত এবং গতানুগতিকও বটে!
২০২২-২৩ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় হবে ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যার বিপরীতে আয় দেখানো হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। সংখ্যার হিসাবে বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, অর্থাৎ ৩৬ শতাংশের কিছু বেশি ঘাটতি। বলা হচ্ছে, অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ থেকে আসবে ঘাটতির ৪৩ দশমিক ৪০ শতাংশ, ৩৯ শতাংশ আসবে বৈদেশিক ঋণ থেকে এবং ১৬ শতাংশ আসবে সঞ্চয়পত্র ঋণ থেকে।
বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে এনবিআরের রাজস্ব আদায় ছিল মাত্র ২ লাখ ২৮ হাজার কোটি টাকা। বছরের শেষ দুই মাসে রাজস্ব আয় ৬০ হাজার কোটি ধরলেও সর্বোচ্চ রাজস্ব যাবে ২ লাখ ৮৮ হাজার কোটি টাকায়। কিন্তু নতুন বাজেটে লক্ষ্যমাত্রা ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা, যা পুরোপুরি অবাস্তব। এভাবে সরকারি সংখ্যাকে প্রশ্নযুক্ত করার তাৎপর্য কী!
এনবিআর এবং এনবিআরবহির্ভূত মোট রাজস্ব কোনোভাবেই সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে না, কর-জিডিপির অতি নিম্নহার হিসাবে এটা মোটামুটি নিশ্চিত। ফলে বাজেটের ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা ভুল এবং অবাস্তব। প্রবৃদ্ধিসহ প্রকৃত রাজস্ব আমলে নিলে, বাজেট ঘাটতি প্রায় ৪৮ শতাংশে ঠেকতে পারে!
রাজস্ব বিভাগকে চাপে রাখতে সর্বোচ্চ ১০-১৫ শতাংশ বর্ধিত সংখ্যা প্রাক্কলন করা যায়, কিন্তু তাই বলে এক-চতুর্থাংশ রাজস্বের বর্ধিত প্রাক্কলন কেন হবে? যেহেতু ঋণের সুদ, ভর্তুকি, সরকার পরিচালনা ব্যয় এবং উন্নয়ন প্রকল্পের খরচের খাত নির্ধারিত হয়ে গেছে, তাই এ রকম অবাস্তব সংখ্যা প্রাক্কলনের মানে দিন শেষে লাগামহীন অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ দিয়ে ঘাটতি জোগান নয় কি?
বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে সরকার আয়ের চেয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা বেশি ঋণ করেছে, এনবিআরবহির্ভূত আয় বাদে প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। বৈদেশিক ঋণ বাদেই বাণিজ্যিক ব্যাংক, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সঞ্চয়পত্র থেকে অভ্যন্তরীণ ঋণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা। প্রশ্ন ওঠে, একটি সক্ষম সরকার আয়ের চেয়ে বেশি শুধু অভ্যন্তরীণ ঋণ কীভাবে করে? সরকার কী অর্থ তৈরির ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান যে বসে বসে ‘নন-পারফর্মিং’ ঋণের সুদ দেবে! বাংলাদেশের বাজেটে ঋণের সুদের বিপজ্জনক প্রবৃদ্ধি নিয়ে ভাবার সময় হয়নি কি?
এপ্রিল ২০২২ পর্যন্ত ২০২১-২২ অর্থবছরের ১০ মাসে শুধু ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকেই সরকারের অভ্যন্তরীণ ঋণ ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ ২ লাখ ২ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা, শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ ৩১ হাজার ৭৮৯ কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংক ও সঞ্চয়পত্র ঋণ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার কারণে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিধিবহির্ভূত নতুন ধারার এই ঋণ করছে, এটা তাৎক্ষণিক মূল্যস্ফীতি সহায়ক।
শুধু এপ্রিল মাসেই সরকারের ব্যাংক ঋণ ২৪ হাজার ১১৯ কোটি টাকা, যেখানে একই মাসে সরকারের রাজস্ব আদায় ছিল মাত্র ২৩ হাজার ৭৩০ কোটি টাকা! সঞ্চয়পত্র ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় নতুন বাজেটে ব্যাংক ঋণের লক্ষ্যমাত্রা লাখ কোটিতে পৌঁছেছে। এভাবে বছরভেদে সঞ্চয়পত্র ঋণ ও ব্যাংক ঋণ বাড়ানো-কমানোর ইঁদুর-বিড়াল খেলাই ঘাটতি বাজেটের অর্থ জোগানের মূল সূত্র, সঙ্গে যোগ হয়েছে মাত্রাতিরিক্ত হারের বৈদেশিক ঋণও।
অতিমারির পর আয় সংকোচন ও বেকারত্বে পড়া মানুষ দফায় দফায় অতি মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত। জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্য বাজারে দাম বেড়েছে পণ্যভেদে অন্তত ২০ থেকে প্রায় ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। দাম বাড়ার প্রভাবের স্থানীয় এবং বৈশ্বিক দুটি আলাদা অনুষঙ্গ আছে। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপের কথা অর্থমন্ত্রী স্বীকার করলেও স্বস্তি দেওয়ার কোনো পথ দেখাননি
জনপ্রশাসনের বেতন-ভাতা খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছর সরকারের ব্যয় ছিল ৪৭ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য সংশোধিত বাজেটে বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ৫৪০ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছর বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় আরও বেড়ে ৭৬ হাজার ৪১০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। অর্থাৎ মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে প্রশাসনের বেতন-ভাতায় ব্যয়বৃদ্ধি ১৫০ শতাংশ।
অন্যদিকে সুদ পরিশোধ খাতে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সরকারের ব্যয় ছিল ৩৭ হাজার ৯২০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় ৩৫ হাজার ৪০৪ কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় ২ হাজার ৫১৬ কোটি টাকা। ২০২০-২১ অর্থবছর সুদ বাবদ ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৬৩ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ ছিল ৫৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ করা হয় ৫ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা। এদিকে চলতি অর্থবছরের জন্য সংশোধিত বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৭১ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ রয়েছে ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ রয়েছে ৬ হাজার ২৪৪ কোটি টাকা। শুধু সুদ পরিশোধে খরচ বেড়েছে ১৮৮ শতাংশ, অথচ বাজেটে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে ব্যয় জিডিপির আনুপাতিক হারে শুধু কমছেই!
অর্থাৎ বাজেটের সবচেয়ে বড় দুই খাত ঋণের সুদ পরিশোধ ও সরকারের বেতন-ভাতা। সরকার পরিচালন ব্যয়ের ১৯ দশমিক ২১ শতাংশ যাবে সুদ পরিশোধে। ঋণের সুদ পাঁচ বছর আগেও এক অঙ্কের ঘরে ছিল, যা মাত্র কয়েক বছরেই ১৯ শতাংশ ছাড়িয়েছে। আর করের টাকার ১৭ দশমিক ৭৫ শতাংশ যাচ্ছে বেতন-ভাতায়, বিপরীতে সরকারি সেবার মান কি উন্নত হয়েছে?
বাজেটে সরকারি ব্যয় ২৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ বৃদ্ধি করা উৎপাদনহীনতা তৈরির একটা নতুন কিন্তু বড় সমস্যার সূচনা। প্রকৃত বাজেট ঘাটতি ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়াটা একটা সার্বিক সংকট। বাস্তবতা হচ্ছে, সরকার পরিচালনা ব্যয় এবং অনুন্নয়ন বাজেটের এমন উল্লম্ফন মূল্যস্ফীতি সহায়কও।
ক্রান্তিকালে দরকার ছিল সরকার পরিচালনার ব্যয়ের লাগাম টানা, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অপখরচের লাগাম টানা, অপ্রয়োজনীয় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করা। সরকার ২০১৪-১৫ অর্ধবছরের পর এ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরেই দিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা, নবায়ন করা পাঁচটি অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রায় সারা বছরই অলস ছিল।
বিশ্ব ও বাংলাদেশ করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধবিষয়ক দুটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। করোনার আগেই ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে একধরনের স্থবিরতা চলছিল। তখন থেকেই বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতিও ছিল বর্ধিত, সানেম দেখিয়েছে মূল্যস্ফীতি তখনই সরকারি সংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ ছিল
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ৫১তম বাজেটে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা আশা করা হয়েছিল। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট বক্তৃতায় মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা, অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাড়ানো, বিদেশি সহায়তা বাড়িয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করা, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো যথাসময়ে বাস্তবায়ন করা, মূল্য সংযোজন করের পরিমাণ ও ব্যক্তি করদাতার সংখ্যা বাড়ানো, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো এবং ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল রাখার মতো ছয়টি চ্যালেঞ্জের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু অভ্যন্তরীণ ঋণ (মূলত সঞ্চয়পত্র ঋণ, ব্যাংক ঋণ) এবং বৈদেশিক ঋণনির্ভর উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন উভয় ধরনের বাজেটের ব্যয় বাড়ানো, করপোরেট কর কমানো, তৈরি পোশাকের বাইরে অপরাপর সব রপ্তানি খাতে কর ছাড়া বাজেটে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার টেকসই কোনো কৌশল দেখা যাচ্ছে না; বরং পাচার ও বৈষম্য তৈরির নতুন অনুষঙ্গ আছে নতুন বাজেটে। একদিকে টিসিবির ১০ টাকার চাল ১৫ টাকা করা হয়েছে, অন্যদিকে পাচার টাকা বৈধ করার প্রণোদনা এসেছে!
ক্রান্তিকালে দরকার ছিল সরকার পরিচালনার ব্যয়ের লাগাম টানা, বিদ্যুৎ খাতের ক্যাপাসিটি চার্জের মতো অপখরচের লাগাম টানা, অপ্রয়োজনীয় রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি বাতিল করা। সরকার ২০১৪-১৫ অর্ধবছরের পর এ পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে সাড়ে ৫৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে, শুধু ২০২১-২২ অর্থবছরেই দিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকা, নবায়ন করা পাঁচটি অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রায় সারা বছরই অলস ছিল। প্রাথমিকভাবে ৩ বছরের জন্য দেওয়া লাইসেন্সে ১৭ বছর ধরে চলার অনুমতিও পেয়েছে কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র। এসব অর্থ সাশ্রয় করে জনকল্যাণে ব্যয়ের কৌশলী উদ্যোগ দরকার ছিল। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন ও করোনাকালে সরবরাহ ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়ে দরকার ছিল অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমিয়ে তা দিয়ে খাদ্য উৎপাদন এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ব্যাপক মাত্রায় শুল্ক ও কর ছাড়ের পথে হাঁটা!
পাশাপাশি প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষতা এনে কীভাবে দুর্নীতি ও অপখরচের লাগাম টানা হবে, বাজেটে সেসব কৌশল নেই। ভাতা-ভর্তুকি, প্রণোদনা এবং নিয়মতান্ত্রিক ঋণ বরাদ্দের জন্য সঠিক দারিদ্র্য জনসংখ্যা, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, এসএমই উদ্যোক্তা এবং বেকারত্বের তথ্যশালা তৈরি করা জরুরি। অতি জরুরি হচ্ছে, নতুন আয়-ব্যয় ও খানা জরিপ। স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাজেটে খরচের খাত কৃচ্ছ্রসাধন করে, জনকল্যাণ মূলক শুল্কছাড় ও দরকারি ভর্তুকিতে খরচের রূপান্তর করার চেষ্টা না থাকাটা দৃষ্টিকটু। তবে প্রতিশ্রুতি মতে, কর্মসংস্থানের তথ্যভান্ডার করা হলে, সেটা একটি প্রশংসনীয় বিষয় হবে।
সরকার যদি নতুন খানা জরিপ না করে, দারিদ্র্যের সঠিক তথ্যশালা ও বেইজলাইন ঠিক হবে কীভাবে? করোনার পর আমাদের হাতে কি নতুন-পুরোনো দারিদ্র্যের হালনাগাদ তথ্যশালা আছে? ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের হালনাগাদ তালিকা আছে? না থাকলে ব্যাংক ঋণ এবং সামাজিক নিরাপত্তা বরাদ্দ কীভাবে নিয়মতান্ত্রিক হবে? সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিতরণ দুর্নীতি না থামিয়ে, শুধু বাজেট বরাদ্দ ও ভাতা গ্রহীতার সংখ্যা বাড়ানোর কৌশলে সত্যিকারের সফলতা আসছে কি?
অতিমারির পর আয় সংকোচন ও বেকারত্বে পড়া মানুষ দফায় দফায় অতি মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত। জ্বালানি তেল, গ্যাসসহ প্রায় সব ধরনের পণ্য বাজারে দাম বেড়েছে পণ্যভেদে অন্তত ২০ থেকে প্রায় ১০০ শতাংশ পর্যন্ত। দাম বাড়ার প্রভাবের স্থানীয় এবং বৈশ্বিক দুটি আলাদা অনুষঙ্গ আছে। নতুন বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপের কথা অর্থমন্ত্রী স্বীকার করলেও স্বস্তি দেওয়ার কোনো পথ দেখাননি; বরং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জোর দিয়ে যে মেগা বাজেট এসেছে, সেখানে মূল্যস্ফীতির সংখ্যাটাই চতুরতাপূর্ণ। দুই অঙ্কের চলমান মূল্যস্ফীতিকে দেখানো হচ্ছে মাত্র ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, লক্ষ্যমাত্রা ৬ দশমিক ৩, এটা একটা বড় সমস্যা। সরকারকে সঠিক মূল্যস্ফীতি নির্ণয় করে বাজেটীয় সংখ্যা নির্ধারণ করা উচিত।
তদুপরি ৫ দশমিক ৬ শতাংশ, কিন্তু ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে তা কীভাবে ৫ দশমিক ৬ শতাংশে যাবে, তার পথরেখা নেই। বেদরকারি খাতে কর ছাড়, প্রকল্পের অপখরচ, অনুন্নয়ন ব্যয়বৃদ্ধি, টানা রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রণোদনা কতটা মূল্যস্ফীতি সহায়ক, তার সুস্পষ্ট গবেষণা নেই! সরকারের মূল্যস্ফীতি পরিমাপের ভিত্তিবছর এবং জিডিপি নির্ধারণের ভিত্তি বছরে ভিন্নতা থাকা দৃষ্টিকটু পরিসংখ্যান বিচ্যুতি। বিবিএসের মূল্যস্ফীতি নির্ণয়ের সিপিয়াই পদ্ধতিও ত্রুটিপূর্ণ। তদুপরি মূল্যস্ফীতিতে বিপর্যস্ত সময়ের ক্রান্তিকালে দরকার ছিল সাধারণ মানুষের জীবনধারণের জন্য অতি প্রয়োজনীয় পণ্যের নতুন বাস্কেট তৈরি করে তাতে উৎপাদন মূসক, আমদানি শুল্ক কমিয়ে মূল্যস্ফীতির চাপ মোকাবিলার কৌশল নেওয়া! মূল্যস্ফীতির সংখ্যাটাই যদি জালিয়াতি পূর্ণ থাকে, তাহলে ভুল সংখ্যার ওপর দাঁড়িয়ে বাজেট তৈরি করলে তা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ করবে কি?
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ : অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা, উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা। faiz.taiyeb@gmail.com