ছোটবেলায় আমাকে নিয়ম করে মাদ্রাসায় যেতে হতো। যাঁরা সে মাদ্রাসায় আমাদের পড়াতেন, তাঁদের আমরা সম্মান করে বলতাম হুজুর। অনুমান করি, এখনো দেশে সবাই তাঁদের হুজুরই বলেন। গত সপ্তাহে ঢাকার এক টিভি টক শোতে দেখলাম, এক সঞ্চালক হেফাজতে ইসলামের একজন মুখপাত্রকে হুজুর বলেই সম্বোধন করলেন।
তো সেই হেফাজত নেতা আমাদের জানালেন, রবীন্দ্রনাথ একজন হিন্দু কবি, তাঁর ‘আগুনের পরশমণি’ গান গেয়ে রমনার বটমূলে ছায়ানট যে নববর্ষের উৎসব করে, তা আসলে হিন্দুয়ানি একটা ব্যাপার। আগুনের পরশমণি মানে তো অগ্নি-উপাসনা! মহানবী (সা.)–এর একজন ক্ষুদ্র সেবক হিসেবে যেকোনো মূল্যে এই হিন্দুয়ানি ঠেকানো, নিদেনপক্ষে প্রতিবাদ করা তাঁর ধর্মীয় দায়িত্ব।
আমি টক শো খুব একটা দেখি না, মধ্যরাতের বাচালতা বলে একসময় তাদের নিন্দা করেছি। স্বীকার করছি, কথাটা ভুল ছিল। কখনো কখনো টক শোতেও অল্পবিস্তর জ্ঞানলাভ হয়। যেমন এই টক শোতে হলো। দেশে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা সনদের স্বীকৃতি দেওয়া নিয়ে মহা তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, কিন্তু হেফাজতে ইসলাম আসলে কী চায়, এই টক শো না দেখলে আমার কাছে ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হতো না।
এই ব্যক্তি হেফাজতের একজন মুখপাত্র, অতএব তাঁর বক্তব্য হেফাজতেরই, এমন সিদ্ধান্ত অযৌক্তিক নয়। তাঁর কথা থেকে আমি তিনটি স্পষ্ট দাবির আভাস পেয়েছি। এক. হাইকোর্টের সামনে থেকে গ্রিক দেবীর মূর্তি সরাতে হবে। দুই. নববর্ষের আনন্দমেলা বন্ধ করতে হবে। তিন. ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা বন্ধ করতে হবে। এর বাইরে আরও কিছু দাবি ছিল, হিন্দুয়ানি রয়েছে, এমন কোনো কিছু এই দেশে চলবে না। সকালে ভোরের সূর্যের আলোর মুখ দেখে নববর্ষ পালন, এ তো হিন্দুদের কাজ। সেটা বন্ধ করতে হবে। নববর্ষের দিন মঙ্গল শোভাযাত্রার নামে ছেলেমেয়েরা অবাধে মেলামেশা করে, একে অপরের মুখে ছবি এঁকে দেয়। এসবও বন্ধ করতে হবে। মুখে বললেন না বটে, তবে বুঝলাম, তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথকেও নিষিদ্ধের তালিকায় রাখা উচিত; কারণ, তিনি তো হিন্দু। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু নন, ব্রাহ্ম, সে কথা বলার পরও তিনি বারবার ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে তাঁর অবিচল বিরোধিতার কথা বলে গেলেন। এটি তাঁর ধর্মীয় দায়িত্ব। সঞ্চালক এবং অনুষ্ঠানের অপর দুই বক্তা তাঁকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, ধর্ম রক্ষার এই পবিত্র দায়িত্ব তাঁকে কে দিয়েছে? কোনটা ঠিক কোনটা বেঠিক, সে বিচারের ভারই বা তাঁকে কে তুলে দিল?
এই মুহূর্তে যাঁরা কওমি মাদ্রাসার ডিগ্রি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করছেন, সরকার উল্টো কথা বললেও তাঁরা ঠিকই বিপদের গুরুত্ব সম্যক ধরতে পেরেছেন। এই ডিগ্রি নিয়ে তাঁরাসরকারি চাকরি করবেন না, তেমন ভালো চাকরি পাবেনও না বলে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। কিন্তু এমএ ডিগ্রি পেয়ে চাকরি না পেলে কওমির গ্র্যাজুয়েটরা আজ হোক বা কাল সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে বা সেনাবাহিনীতে তাঁদের জন্য ‘কোটা’র দাবি তুলবেন না, সে কথা হিসাবে না রাখা খুব সুবুদ্ধির পরিচায়ক হবে না। কওমি গ্র্যাজুয়েটরা চাকরি পান বা না পান, সে সমস্যা সময়মতো সামলানো যাবে। আপাতত হেফাজতের নজরটা ভিন্ন। তারা চাইছে ধর্মকে—তাদের, অর্থাৎ শুধু মুসলমানদের ধর্মকে—বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক চরিত্রের ভিত্তি করতে। ঠিক সেই লক্ষ্যে তারা বেশ কয়েক কদম এগিয়েও গেছে। খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তারা সে কাজে এগিয়েছে। ছোট ছোট দাবি, বড় রকম লড়াই ছাড়াই যা অর্জন সম্ভব, যার জন্য বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হবে না, শুরুতে সে পথেই তারা এগোচ্ছে।
হেফাজতের প্রথম বড় সাফল্য ছিল স্কুলের পাঠ্যবই সংস্কারে। সব পাঠ্যবই থেকে অন্য ধর্মের, বিশেষত হিন্দুধর্মের নাম-গন্ধ ঝেঁটিয়ে দূর করতে হবে, কোনো বড় রকমের বাধা ছাড়াই সে কাজ তারা সম্পন্ন করেছে। এরপর তারা লক্ষ্য দিল গ্রিক দেবী থেমিসের মূর্তি সরানোর নামে হাইকোর্টের সামনে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে নির্মিত ভাস্কর্যটি সরাতে। তাতেও সাফল্য এসেছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে বলা হয়েছে, এই ভাস্কর্য যদি এই মুহূর্তে সরানো না-ও হয়, নিদেনপক্ষে দুই ঈদের সময় তার ওপর কাপড় দিয়ে ঢেকে দেওয়া যেতে পারে।
এরপর আরও বড় একটা দাবি তারা তুলল, কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাকে দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষার স্বীকৃতি দিতে হবে। কার্যত বিনা যুদ্ধেই এমএ ক্লাস পর্যন্ত সে স্বীকৃতি আদায় করে বসল তারা। অন্য সবকিছু বাদ দিয়ে সবাই এই বিষয়টা নিয়েই কথা বলছেন; কারণ, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, যার সঙ্গে আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থা জড়িত। অথচ তা গ্রহণের আগে ভালো-মন্দ বিচার করে কোনো ব্যাপক পর্যালোচনা হয়েছে, দেশের শিক্ষাবিদদের মতামত নেওয়া হয়েছে, সে কথা শুনিনি। আর কিছু না হোক, এর মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের রাজনৈতিক গুরুত্ব প্রমাণিত হয়েছে, আর ভয়টা সে কারণেই।
যারা ধর্মকে আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে চায়, এভাবে তারা একের পর এক জিতে চলেছে। এরপর তারা কোথায় হাত দেবে, তা বোঝার জন্য আমাদের খুব বেশি আক্কেলমন্দ হতে হবে না। একটা ভাস্কর্য ঢাকা গেছে, দেশজুড়ে আরও তো অসংখ্য ভাস্কর্য রয়েছে। মূর্তি নাম দিয়ে তাদেরই বা কেন ভাঙা হবে না বা নিদেনপক্ষে বোরকা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে না? একুশের মিনারটিই বা বাদ যাবে কেন, সেখানে যে সূর্যের প্রতীকটি রয়েছে, তা তো অগ্নি-উপাসনার কথা মনে করিয়ে দেয়, সেখানে আলপনা আঁকা হয়, আমাদের কোমলমতি শিশুদের মনের ওপর তা হিন্দুয়ানির প্রভাব ফেলতে পারে। আর হ্যাঁ, অবশ্যই রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিতে হবে, সঙ্গে সঙ্গে নজরুলকেও; কারণ, এই কবির অনেক কবিতায় হিন্দু দেব-দেবীর স্তব রয়েছে।
এখানেই শেষ নয়। হেফাজত ইতিমধ্যেই পরিষ্কার করেছে যে, ছেলেমেয়েদের একসঙ্গে ওঠবস তারা অনুমোদন করে না, পাঠ্যপুস্তকেও এমন কিছু থাকা যাবে না, যাতে মনে হয় ছেলে ও মেয়ের মধ্যে তফাত নেই। ছেলেরা যা পারে, মেয়েরা তা পারে না, হেফাজতেরই একজন নেতা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন। পাঠ্যসূচি থেকে চিত্রাঙ্কন বাদ দেওয়ার দাবিটিও তারা তুলেছে; কারণ, ধর্মে ছবি আঁকা মানা। অনুমান করি, ধর্মের দোহাই দিয়ে তারা কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ দাবি করবে, রাষ্ট্রক্ষমতার শীর্ষে নারীর অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয়, এমন দাবি ওঠাও অসম্ভব নয়।
কেউ কেউ বলবেন, আমি অকারণে একটি ভীতিকর চিত্র কল্পনা করছি, এমন কিছুই হবে না। হেফাজতের লোকজন দাবি করেন বলে তো মঙ্গল শোভাযাত্রা বন্ধ হয়নি, বরং আরও বিস্তৃত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের উপস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বদলে তাঁরা এখন সর্বত্র। আর ক্ষমতার শীর্ষে এখন যে নারী আছেন, সবাই মানেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ক্ষমতাধর নেতা আর কখনো আসেননি। অতএব, ভয়ের কিছু নেই। সরকারি নেতারা নানাভাবে আমাদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছেন।
তবু ভয় যায় না, বিশেষত এখন যখন হেফাজতের পাশে রাজনৈতিক শক্তি-সমর্থনের ছত্র মেলে ধরেছে। ‘মার্জিনে’ অবস্থিত ভেবে আমরা একসময় যাদের হিসাবে আনিনি, এখন তারা দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বৈধতা পেয়ে গেছে। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক প্রয়োজনে হেফাজতের দাবি অনায়াসে পাস হয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই রাজনৈতিক প্রয়োজন থেকেই গত তিন দশকে আমরা দেখেছি দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একের পর এক ছাড় দিয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন ও অংশগ্রহণেই আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র ও মূল্যবোধ বদলাতে শুরু করেছে।
এমন নয় যে ধর্মের দোহাই দিয়ে এই সব দাবি এই প্রথম উঠল। জামায়াতে ইসলামী অনেক দিন আগে থেকেই ইসলামি শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি করে এসেছে। এবারও সেই একই দাবি উঠেছে, কিন্তু তোলা হচ্ছে আপাত অরাজনৈতিক মোড়কে। দাবিগুলো তো পুরোপুরি রাজনৈতিক, এর পেছনে যে লক্ষ্য, তা-ও পুরোপুরি রাজনৈতিক। ফলে হেফাজত নিজেদের যত অরাজনৈতিক ও ক্ষমতার জন্য লালায়িত নয় বলে ঘোষণা করুক না কেন, এই সব দাবির বাস্তবায়ন শেষ পর্যন্ত তাদের হাতকেই শক্তিশালী করবে, যারা পর্দার অন্তরালে অপেক্ষায় আছে ক্ষমতার চাবিটি কবজা করতে।
জামায়াত বলি বা হেফাজত, আমাদের আসল লড়াই শুধু এই সব পোশাকি নামের সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়—এরা যে আদর্শ বা ‘আইডিওলজি’র প্রতিষ্ঠা চায়, তার বিরুদ্ধে। দেশের প্রধান রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিসমূহ সে মতবাদ নিজেদের প্রয়োজনে যত স্বীকৃতি দেবে, এই সব মতবাদের গ্রহণযোগ্যতা—তাদের ‘লেজিটিমেসি’—ততই বাড়বে। পাকিস্তানেও ঠিক এভাবেই নাগরিক জীবনের সর্বস্তরে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। আমার ভয় হয়, আমরাও সে পথেই হাঁটা শুরু করেছি।
হাসান ফেরদৌস: যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।