তিন বছর পার হয়ে চতুর্থ বছরে পা দিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জাতীয় সংকট রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমার থেকে ২০১৭ সালে উৎখাত হওয়া দেশটির প্রাচীন ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। পরিসংখ্যান বলে, প্রায় আট লাখ রোহিঙ্গা ভয়াবহ নির্যাতন, নিপীড়ন ও মানবতাবিরোধী হত্যাযজ্ঞের মুখে সে সময় বাংলাদেশে আসে এবং বর্তমানে সীমান্তবর্তী জেলা কক্সবাজারের কুতুপালং এলাকায় আশ্রয়শিবিরগুলোতে তারা অবস্থান করছে। এর আগে থেকেই বাংলাদেশে ছিল প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুর সংখ্যা দাঁড়ায় ১১ লাখ। ধারণা করা হয়, বর্তমানে এই সংখ্যা ১২ লাখের কাছাকাছি।
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সসম্মানে ফেরত পাঠাতে বাংলাদেশ সরকার একদিকে যেমন দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের পথ ধরেছিল, তেমনি বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় সমস্যা সমাধানের আশা যেমন ছাড়েনি, তেমনি আন্তর্জাতিকভাবে সাড়া আগের মতো না থাকলেও তা একেবারে শেষ হয়ে যায়নি। তবে বিশ্বের বিভিন্ন ঘটনা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা ইস্যুর গুরুত্ব কমিয়ে দিয়েছে এবং এই ইস্যুতে যা করা প্রয়োজন তার প্রাধান্য হারিয়েছে। এর কারণ, আফগানিস্তান, এর ভূকৌশলগত গুরুত্ব, বৃহৎ শক্তিগুলোর অতীতের মার খাওয়ার তিক্ত অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যতের ইঁদুরদৌড়। বিশ্বের নজর এখন সামরিক, ভৌগোলিক ও সম্ভাবনাময় অঞ্চল মধ্য এশিয়ায়। কাজেই সে তুলনায় বিশ্বের এক পশ্চাৎপদ অংশের কয়েক লাখ মানবগোষ্ঠীর প্রতি অন্যায়-অবিচারের খবর কেউ রাখতে চাইছে না। রোহিঙ্গারা অন্যান্য অঞ্চলের বাসিন্দাদের মতো অর্থনৈতিক, ভৌগোলিক, কৌশলগত কারণে তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। এমন পরিস্থিতিতে কার্যত বাংলাদেশকে একাই এই সমস্যার ভার বহন করতে হচ্ছে।
গত তিন বছরে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে যেমন রোহিঙ্গা সংকট ও তাদের মিয়ানমারে ফেরানোর বিষয়টি জটিল আকার ধারণ করেছে, তেমনি মিয়ানমারকে ঘিরে আঞ্চলিক রাজনীতিতেও বদল ঘটেছে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার শাসন করা অং সান সু চি ২০২১ সালের শুরুতে সামরিক বাহিনীর হাতে উৎখাত হয়েছেন। তিনি সেনা সরকারের হাতে বন্দী। ক্ষমতা থেকে উৎখাত হয়ে সু চির দল এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে অথচ তারা যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনই রাখাইন (আরাকান) অঞ্চলে কথিত রোহিঙ্গা জঙ্গি ‘আরসা’ দমনের নামে মানবতাবিরোধী অপরাধ চলে। নিয়তির কী পরিহাস! এ ঘটনার দুই বছরের মাথায় পুনর্নির্বাচিত ও বিতাড়িত সু চির এনএলডি সরকারের নেতৃত্বে ও সমর্থনে গঠিত কথিত ন্যাশনাল ইউনিটি সরকার (এনইউজি) রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সমর্থন পাওয়ার আশায় বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি বার্তা পাঠাচ্ছে।
মুহিবুল্লাহর হত্যার পেছনে আরও গূঢ় রহস্য থাকতে পারে। হয়তো সেসব বের হয়ে আসবে অথবা আসবে না। মুহিবুল্লাহ হত্যারহস্য তত সহজ না–ও হতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নিয়োজিত গোয়েন্দা অথবা আঞ্চলিক দেশগুলোর গোয়েন্দাদের সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
অসমর্থিত তথ্য অনুযায়ী, এনইউজি এখন রোহিঙ্গাদের পূর্বমর্যাদাসহকারে স্বীকৃতি দিয়ে ফেরত নেওয়ার অঙ্গীকার করেছে। রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রকাশ্যে কোনো অবস্থান পরিষ্কার করা হয়নি। তবে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একটি গ্রুপ এনইউজির সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করেছে, যার নেতৃত্বে ছিলেন আততায়ীর হাতে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ। নেতা হিসেবে মুহিবুল্লাহ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চলেছিলেন এবং তাঁর হত্যা রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে যেমন ঘোলাটে করেছে, তেমনি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাব্যবস্থাকেও প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সন্ত্রাসীদের হামলায় ছয় রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, রোহিঙ্গা শিবিরের পরিস্থিতি জটিলতর হচ্ছে।
একসময়ের শিক্ষক মুহিবুল্লাহ সামরিক বাহিনী-সমর্থিত রাজনৈতিক দল ইউএসডিপির (ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি) রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরের চেয়ারম্যান বা সভাপতি ছিলেন। সামরিক পৃষ্ঠপোষক দলের স্থানীয় নেতা হওয়ার সুবাদে একদিকে যেমন তাঁর কর্মী-সমর্থক ছিল, অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বিরোধিতাও ছিল। একই সঙ্গে রাখাইনের কথিত সরকারবিরোধী সশস্ত্র দল, যেমন ওই সময়কার আরাকান আর্মি (এএ) এবং কথিত ‘আরসা’ তাঁর শত্রু হয়ে উঠেছিল। কাজেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে হঠাৎ তাঁর নেতৃত্ব গড়ে ওঠা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তিনি নিজেই তাঁর সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস’(এআরএসপিএইচ) গঠন করেন এবং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ২০১৯ সালে কুতুপালং ক্যাম্পে প্রায় দুই লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর জমায়েত করে বাংলাদেশ সরকারকে একদিকে যেমন বিবৃত করে, অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিমত্তা দেখায়। এরপর মুহিবুল্লাহর উত্থান লক্ষণীয়। ওই বছর মুহিবুল্লাহ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বক্তব্য দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ওভাল অফিসে দেখা করে আন্তর্জাতিক আলোচনায় আসেন। অবশ্য মুহিবুল্লাহকে নিয়ে সরকারের মধ্যে অস্বস্তিও ছিল।
যদিও বর্তমানে কয়েকজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, তবে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে তেমন কোনো বিস্তারিত জানা যায়নি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের তরফ থেকে বলা হয়েছে, তিনি ‘আরসা’র আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বিষয়টি এত সহজ মনে হয় না। মিয়ানমার গোয়েন্দা সূত্র এবং কিছু কিছু আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, পুরোনো সংগঠন আরএসও (রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন) একসময় বাংলাদেশ সীমান্তে তৎপর ছিল এবং তারা নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও ওই গ্রুপের কর্মকাণ্ড রয়েছে, যাদের সঙ্গে মুহিবুল্লাহর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। একই সঙ্গে মহিবুল্লাহ এনইউজির সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছিলেন।
এসব তথ্যে আরও প্রকাশ যে আরসা এবং আরএসওর মধ্যে নেতৃত্ব ও ভাবগত বিষয়ে যথেষ্ট তফাত হওয়ার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা বিভাজিত। তবে মুহিবুল্লাহর হত্যার পেছনে আরও গূঢ় রহস্য থাকতে পারে। হয়তো সেসব বের হয়ে আসবে অথবা আসবে না। মুহিবুল্লাহ হত্যারহস্য তত সহজ না–ও হতে পারে। মিয়ানমারের সামরিক জান্তা নিয়োজিত গোয়েন্দা অথবা আঞ্চলিক দেশগুলোর গোয়েন্দাদের সংশ্লিষ্টতা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
মিয়ানমারের কথিত জাতীয় ঐক্যের সরকার এখনো তেমন আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়নি। তবে তাদের পক্ষে অভ্যন্তরীণ সমর্থন বাড়ছে বলে সূত্রে প্রকাশ। ‘আসিয়ান’ শীর্ষ বৈঠক থেকে মিয়ানমারের সামরিক সরকারপ্রধান মিন অং হ্লাইংকে বাদ দেওয়া হয়েছে এবং জাতিসংঘের আসিয়ান রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের ভার্চ্যুয়াল সভা শুধু মিয়ানমারের সামরিক সরকার নিয়োজিত দূতকে পাশ কাটানোর জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এসব খুব বড় ধরনের চাপ এবং এনইউজির জন্য বড় কিছু না হলে তাদের তৎপরতায় উৎসাহ জোগাবে। মিয়ানমারের অধিকাংশ সশস্ত্র গ্রুপের পুরো সমর্থন না পেলেও এনইউজি সশস্ত্র গ্রুপ পিপলস আর্মি কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন ও কাচিন ইনডিপেনডেন্ট আর্মির কাছ থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। বাকি গ্রুপগুলোর পুরো সমর্থন পেতে অনেক সময় লাগবে মনে হয়।
মিয়ানমার সামরিক সরকার হালের এসব ঘটনা, বিশেষ করে কূটনৈতিক পিছুটানকে বৈদেশিক হস্তক্ষেপ হিসেবে বিবেচনা করছে। বিশেষ করে ইইউ পার্লামেন্টে ৬৪৭ ভোটের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পাস হওয়া বিলে ইইউ দেশগুলোর সরকারকে মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্যের সরকার বা এনইউজিকে সমর্থন দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে। তবে এখনো কোনো ইউরোপীয় সরকার এ বিলের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন জানায়নি। একই সঙ্গে এটাও বাস্তব যে মিয়ানমারে এনইউজির পক্ষে একটি বেসামরিক অভ্যুত্থান খুবই সুদূরপ্রসারী বিষয়।
ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে উপসংহারে বলতে হয়, বাংলাদেশের সামনে ‘রোহিঙ্গা’ বিষয় একটি বড় ধরনের জটিল চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে, যা দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমাধান সম্ভব নয়। কূটনৈতিক আলোচনার পাশাপাশি রোহিঙ্গা নেতৃত্বের বিকাশ ঘটিয়ে বিকল্প পথের সরকারের সব আন্তরিক প্রচেষ্টা সহজে কার্যকর হচ্ছে না। রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশেরই নয়, সমগ্র বিশ্বের উদার গণতান্ত্রিক এবং মানবাধিকার রক্ষাকারী চ্যাম্পিয়নদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ।
● ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)
hhintlbd@yahoo.com