শিল্পী মুর্তজা বশীরের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী (১৫ আগস্ট) এবং ৮৯তম জন্মবার্ষিকী (১৭ আগস্ট) সময়ের পার্থক্য মাত্র ৪৮ ঘণ্টা। জীবন-মৃত্যুর এমন ঘনিষ্ঠতা ইচ্ছাকৃত না হলেও শিল্পী বাঁচতে চেয়েছিলেন পাবলো পিকাসোর চেয়ে অন্তত এক দিন বেশি। এই অসম্পূর্ণতার স্পর্শ জীবিতকালে তাঁকে সব সময় জাগিয়ে রাখত, ব্যস্ত রাখত। সব সময় নতুন কিছু করার স্বপ্ন দেখতেন, যা আগে কেউ করেনি।
পাশাপাশি অসমাপ্ত কোনো কাজ ফেলেও রাখতেন না। খুঁতখুঁতে স্বভাবের পারফেকশনিস্ট ছিলেন। তারপরও থেকে যেত কিছু অসম্পূর্ণতা। সেটা ঘিরেই পরবর্তী ধ্যানে নতুন কিছু সৃষ্টি করতেন। শিল্পী মুর্তজা বশীরের তেমন এক অসম্পূর্ণ শিল্পকর্ম নিয়ে কিছু বলার আগে সামান্য ভূমিকা উল্লেখ করা সমীচীন মনে করি।
কবি জন গ্রীনলিফ হুইটিয়ার ১৮৫৬ সালে এক ট্র্যাজিক কবিতা লেখেন। নাম ‘মড মুলার’। মড একজন অত্যন্ত সুন্দরী নারী। প্রথম দেখায় সে ভালোবেসে ফেলল শহরের এক বিচারককে। সেই বিচারকও মডের সৌন্দর্যে বিমোহিত। তবে তাঁরা কোনোভাবেই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারছিলেন না। দুজন অন্য কাউকে বিয়ে করে পৃথক জীবন যাপন করতে থাকেন। কিন্তু মোটেও ভুলতে পারছিলেন না তাঁদের অসম্পূর্ণ প্রেমের সেই প্রথম মুহূর্তকে।
হুইটিয়ার এই ব্যর্থ প্রেমিক যুগলের মনের ভাব এককথায় কবিতায় লিখে গেছেন—
ফর অফ অল স্যাড ওয়ার্ডস অফ টাং অর পেন
দ্য স্যাডেস্ট আর দিজ:
‘ইট মাইট হ্যাভ বিন!’
কবিতাটি ‘অসম্পূর্ণতা’ বা ‘অপূর্ণতা’র প্রতিশব্দ হিসেবে বিখ্যাত হয়ে আছে। শিল্প-সাহিত্যে এই রকম দ্যোতনা’র উদাহরণ প্রচুর। তবে বিশেষ করে চিত্রকলায় কোনো কোনো শিল্পীর অসম্পূর্ণ কাজগুলোর আবহ দেখলে একই রকম হাহাকার ও অতৃপ্তি বোধের জন্ম হয়।
কালের বিচারে দেখা যায় এ রকম অনেক কাজ পরিপূর্ণভাবে টিকে গেছে। অনেক গুণী শিল্পীর অসম্পূর্ণ ক্যানভাস বা স্কেচের খাতা শিল্পমানে আজও আলোচিত হয়ে আসছে পরম আগ্রহে।
রেনেসাঁ আমলের এশিয়ান, দা ভিঞ্চি, মাইকেলাঞ্জেলো থেকে শুরু করে ইম্প্রেশনিস্ট যুগের দেগা, সেজান, ক্লদ মনে প্রমুখের অনেক অর্ধ-সমাপ্ত, অসমাপ্ত কাজের নমুনা আমরা দেখতে পাই। অনেক ক্ষেত্রে শিল্পীদের স্বাক্ষর থাকত অনুপস্থিত সেই সব ক্যানভাসে। তাঁদের কাজের ধরন বিচার করে নির্ধারণ করতে হয়েছে কোনটা কার আঁকা অসমাপ্ত কাজ।
ইতালিয়ান ভাষায় এই ঘরানার কাজকে বলা হয় ‘নন ফিনিতো’। বিশেষ করে লেওনার্দো দা ভিঞ্চির ১৪৮০ সালে আঁকা অসম্পূর্ণ ক্যানভাস ‘সেন্ট জেরোমে ইন দ্য ওয়াইল্ডারনেস’-এর কথা শিল্প রসিকেরা জেনে থাকবেন। ভিঞ্চির এমন আরও কিছু অসমাপ্ত কাজ খুঁজে পাওয়া গেছে, যা শিল্পের বিচারে অনন্য। তেমন আরেকটা উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ১৪৮১ সালে আঁকা ‘অ্যাডোরেশন অব দ্য মেজাই’। অনেকের ধারণা ভিঞ্চি এই সব অসমাপ্ত কাজগুলোর মধ্যে ভিন্ন ধরনের রহস্য লুকিয়ে আছে। এমনকি বিখ্যাত মোনালিসা চিত্রকর্মও অসমাপ্ত ধারণা করা হয়।
একইভাবে অসম্পূর্ণ কাজ পাওয়া গেছে মাইকেলাঞ্জেলোর ১৪৯০ সালে আঁকা ‘ম্যানচেস্টার ম্যাডোনা’ নামের এক অনুপম শিল্পকর্ম, যা লন্ডনের ন্যাশনাল গ্যালারিতে আছে। আরও পাওয়া গেছে ১৫৭০ সালে তিশিয়ানের আঁকা ‘ফ্লাইং অব মারসায়া’ নামের এক পৌরাণিক আবহের ছবি। নন-ফিনিতো স্টাইলে তিশিয়ানের আরেক উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে ‘দ্য ডেথ অব অ্যাক্টিয়ন’।
ইম্প্রেশনিস্ট ঘরানার শিল্পী পল সেজানের অনেক কাজ দেখে শিল্প রসিকদের মনে প্রশ্ন জাগে আসলে কাজটা কি পুরোপুরি শেষ করা হয়েছে? নাকি কিছুটা বাকি আছে। চোখে অতৃপ্তির ধাক্কা লাগে। সেজান অনেক ক্যানভাসের কিছু অংশ খালি রাখতেন। কারণ, শিল্পী আশঙ্কা করতেন যদি সামান্য অতিরিক্ত তুলির আঁচড়ে পুরো কাজটির আবহ নষ্ট হয়ে যায়? তাই সেজানের ‘টার্নিং রোড’ শিরোনামের ক্যানভাসটি প্রায় পুরোটাই অসম্পূর্ণ দেখতে পাই। একইভাবে পোর্ট্রেট শিল্পী গিলবার্ট স্টুয়ার্ট বিখ্যাত হয়ে আছেন ১৭৯৬ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের অসমাপ্ত প্রতিকৃতি এঁকে। শিল্পের ইতিহাসে এমন প্রচুর নমুনা আমরা খুঁজে পাব।
‘অসম্পূর্ণ’ ড্রয়িংআদতে শিল্পীদের অসমাপ্ত কাজগুলো খালি চোখে অসম্পূর্ণ মনে হলেও সেই সব কাজগুলো এক সীমাহীন সম্ভাবনার কথা বলে। দর্শকদের কল্পনার চোখকে আরও বহুগুণ প্রসারিত করে দেয় যেন। একই সঙ্গে সেই অসম্পূর্ণ কাজের মাধ্যমে শিল্পীর দূরাগত সংযোগের এক কাল্পনিক চিত্র মনে মনে আঁকা হয়ে যায়, যা আঁকা হয়নি বা খালি অংশটুকু মনের সৃষ্টিশীল পর্দায় দেখে ফেলেন দর্শক। কারণ, আমাদের চোখ অবচেতনভাবে অসম্পূর্ণতা মেনে নিতে পারে না। তবে সে ক্ষেত্রে সেই অসম্পূর্ণতাকে পূর্ণতা দেওয়ার দায়ভার নির্ভর করবে শিল্পীর মুনশিয়ানার ওপর। সব শিল্পীর অসমাপ্ত কাজ কালের ব্যাপ্তিতে টেকেনি। যেগুলো আলোচিত হয়েছে শিল্পের বিচারে তা ছিল প্রয়োজনীয়।
শিল্পী মুর্তজা বশীর ২০১৫ সালের ১ জুন আমার পোর্ট্রেট আঁকতে গিয়ে তেমন একটি ‘অসম্পূর্ণ’ ড্রয়িং রেখে গিয়েছিলেন। হয়তো বেখেয়ালে সিটিং দেওয়ার সময় আমি নিজেই নড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু চিবুক আঁকতে গিয়ে ‘সিঙ্গেল-হ্যান্ড’ ড্রয়িং মাস্টার একটু কেঁপে গিয়েছিলেন। মুর্তজার বয়স তখন ৮৩ বছর।
মুহূর্তেই ‘উফ! হলো না’ বলে কাজটি বাতিল করে দিয়েছিলেন শিল্পী। পরে আবার স্থিত হয়ে অকম্পিত আঁচড়ে পোর্ট্রেটটি শেষ করেন। অসমাপ্ত ড্রয়িংটি ‘বাতিল’ হিসেবে পাশে সরিয়ে রাখেন। পরে স্বাক্ষর না করে আমাকে দিয়ে দেন। বলেছিলেন, তোমার চেহারা ঠিকমতো আসেনি বলে সিগনেচার করলাম না। আমি সানন্দে পূর্ণাঙ্গ কাজটির সঙ্গে এই অসম্পূর্ণ কাজটি সংগ্রহে রেখে দিয়েছিলাম। কারণ, ড্রয়িংটিতে অবয়ব স্পষ্ট না হলেও মুর্তজার অঙ্কন রীতির যাবতীয় অনুষঙ্গ ছিল স্পষ্ট! শিল্পী শতাধিক প্রতিকৃতি এঁকে গেছেন।
শিল্পীর আঁকা ইট্রুসকান ঘরানার ড্রয়িং আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাবলো পিকাসোকে। প্রথম জীবনে পিকাসো তাঁকে অনুপ্রাণিত করলেও মুর্তজার বলিষ্ঠ রেখা তাঁর একান্ত নিজস্ব। আত্মপ্রতিকৃতি আঁকা ছাড়াও চেনা পরিচিত ও বিখ্যাত বহু ব্যক্তির প্রতিকৃতি মুর্তজা বশীরের মতো বাংলাদেশে খুব কম শিল্পী এঁকে গেছেন। বিশেষ করে আত্মপ্রতিকৃতি অঙ্কনে তিনি ছিলেন ডাচ শিল্পী রেমব্রান্টের ভক্ত।
তবে কালি–কলমে আঁকা ‘নন-ফিনিতো’ পোর্ট্রেটটি সময়ের বিচারে কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে তা ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। জীবনে অজস্র ব্যাপ্তির মাঝেও তিনি ছিলেন অতৃপ্ত। পূর্ণতা এবং অপূর্ণতার দোলাচলে জারিত ছিল জীবন ও দর্শন। তাঁর দীর্ঘ শিল্পী জীবনের হাতে গোনা কিছু অসমাপ্ত কাজগুলোর নিদর্শন হিসেবে এই পোর্ট্রেটটি সারাংশ মাত্র। অসমাপ্ত কাজটির মাঝে রেখার নিজস্বতায় শিল্পী নিজেকে মূর্ত করেছেন। স্বাক্ষরবিহীন এবং অসম্পূর্ণ হলেও মুর্তজা বশীরকে ঠিক চেনা যায়।
মিরাজুল ইসলাম শিল্পী মুর্তজা বশীরকে নিয়ে লেখা জীবনালেখ্য ‘নার্সিসাসে প্রজাপতি’র লেখক।