মুদ্রা বিনিময় হারের অর্থনীতি

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় বর্তমানের এক মূল আলোচ্য বিষয় মুদ্রা বিনিময় হার। এটি কি ঠিক আছে, নাকি অতিমূল্যায়িত? বাংলাদেশ ব্যাংক কি সঠিক ব্যবস্থাপনা করছে? মুদ্রা বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত, নাকি অবমূল্যায়িত, বোঝার উপায় কী?

সবচেয়ে সহজ আন্তব্যাংক বাজারের রেটের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বাজারের রেটের ব্যবধান। এটা যত বেশি হবে, তাতে আন্তব্যাংক বাজারের রেট অতিমূল্যায়িত বলে ইঙ্গিত পাওয়া যায়। গত অর্থবছরে এই দুই রেটের ব্যবধান ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৬৯ পয়সা প্রতি মার্কিন ডলার। বর্তমানে বেড়ে এখন ২ দশমিক ৭ টাকা প্রতি ডলার। আসলে আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে এই ব্যবধানটি বেড়েই চলছে। আন্তব্যাংক বাজারের রেটটি যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করে, ওখানকার প্রচলিত রেটে বিদেশি মুদ্রার সব চাহিদা মেটে না। তাই ক্রেতারা অনানুষ্ঠানিক বাজার থেকে কিনতে আগ্রহী হন। যেকোনো বাজারে যদি প্রচলিত মূল্যে চাহিদা জোগানের বেশি হয়, তাহলে ধরে নিতে পারেন যে ওই বাজারে লেনদেন অবমূল্যায়িত হারে হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে টাকার বিপরীতে ডলার অবমূল্যায়িত। অর্থাৎ টাকা অতিমূল্যায়িত। 

দ্বিতীয় উপায় হলো টাকার রিয়েল ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেট যাচাই করা। এটি বুঝতে হলে একটু ভাবুন আন্তর্জাতিক বাজারে লেনদেন করতে মূল্য কীভাবে মূল্যায়ন করতে হয়। ধরুন, আপনি আমেরিকা থেকে একটি পণ্য কিনতে চান, যার মূল্য ১০০ ডলার। এই ১০০ ডলার আপনি কিনবেন টাকা দিয়ে। এখন প্রতি ডলারের দাম যদি ৮৫ টাকা হয়, তাহলে আপনার লাগবে ৮ হাজার ৫০০ টাকা। আর যদি হয় ৮০ টাকা হয়, তাহলে লাগবে ৮ হাজার টাকা। কাজেই আপনি পণ্যটি কিনতে গেলে কত খরচ হবে, তা দুটি মূল্যের ওপর নির্ভর করছে—আমেরিকার বাজারে পণ্যটির দাম (১০০ ডলার) এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার। বিদেশি ক্রেতারা আমাদের পণ্য কিনতে চাইলে তাদেরও দুটি মূল্য বিবেচনায় আনতে হবে—আমদের বাজারে পণ্যটির দাম এবং ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় হার। এই দুই মূল্যের তথ্য মিলিয়ে যে সূচক তৈরি করা হয়, তার নাম রিয়েল ইফেকটিভ এক্সচেঞ্জ রেট ইনডেক্স। 

ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়লে বা আমাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি বাড়লে এটি বেড়ে যায়। তার মানে টাকা অতিমূল্যায়িত হচ্ছে। আইএমএফের হিসাবে ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে টাকা ৯ দশমিক ৫ শতাংশ প্রকৃত অতিমূল্যায়িত হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবও বলে যে টাকার প্রকৃত মূল্য ২০১৫-১৬ ভিত্তি বছর অনুযায়ী রাখতে হলে বর্তমানে মুদ্রা বিনিময় হার প্রতি ডলারে ৯৩ টাকা হওয়ার কথা, যা কিনা বর্তমানে ৮৪ দশমিক ৯ টাকা আন্তব্যাংক বাজারে। অর্থাৎ ২০১৫-১৬ ভিত্তি বছরের প্রকৃত মূল্যের তুলনায় প্রতি ডলারে মুদ্রা বিনিময় হার প্রায় ৮ টাকা অতিমূল্যায়িত। 

অতিমূল্যায়িত হওয়া মানে আমাদের পণ্য প্রতিযোগীদের তুলনায় বেশি দামে কিনতে হয় আর বিদেশি পণ্য দেশে উৎপাদিত একই পণ্যের তুলনায় দাম কম। ফলে মূল্যের ভিত্তিতে রপ্তানির প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে আর আমদানির সক্ষমতা বাড়ে। টাকার বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত হলে রপ্তানির বাজার সংকুচিত আর আমদানি উৎসাহিত হয়। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি বেড়ে যায়। 

তাই টাকার বিনিময় হার কোন অবস্থানে আছে, সেটা বোঝার তৃতীয় উপায় বহির্বাণিজ্য খাতের ভারসাম্য। পণ্য বাণিজ্যে আমাদের সব বছরে ঘাটতি থাকে, যেহেতু আমাদের পণ্য আমদানি–রপ্তানির তুলনায় সব সময় বেশি। তবে এই ঘাটতি অর্থবছর ২০১৬–তে ৬৪৬ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০১৯ অর্থবছরে ১ হাজার ৫৪৯ কোটি ডলারে উপনীত হয়। সেবা বাণিজ্যের ভারসাম্য যোগ করলে ঘাটতি আরও বেশি। অর্থবছর ২০১৬–তে ৪ হাজার ৬১৩ কোটি ডলার থেকে বেড়ে ২০১৯ অর্থবছরে ৬ হাজার ৫৯৪ ডলারে উপনীত হয়। 

রেমিট্যান্সের শক্তিশালী প্রবাহ এবং বৈদেশিক সহায়তা বজায় থাকার কারণে বাণিজ্য ঘাটতি অর্থায়নে আমাদের তেমন বেগ পেতে হয়নি। বিদেশি সহায়তা যেহেতু আমরা এখনো তুলনামূলকভাবে সহজ শর্তে পেয়ে থাকি, সে কারণে বৈদেশিক ঋণের বোঝাও সহনীয় পর্যায়ে আছে। তবে এটি পরিষ্কার যে মুদ্রা বিনিময় হার অতিমূল্যায়িত। সমস্যা কোথায়? সমস্যাটি প্রতিযোগিতায় এবং বাণিজ্য ঘাটতির ভবিষ্যৎ অর্থায়নে। বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতামূলক দেশীয় শিল্পের প্রসারের পথে অতিমূল্যায়িত টাকা একটা বড় বাধা। 

আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো তাদের মুদ্রাকে অবমূল্যায়িত করেছে। ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, কম্বোডিয়া এবং আরও অনেকে। এর ফলে আমাদের রপ্তানিকারকেরা চীন–যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধ থেকে কোনো সুফল আদায় করতে পারেননি। বরং মার খেয়েছেন, যা এই অর্থবছরের রপ্তানির ঋণাত্মক প্রবণতা থেকে পরিষ্কার। ভারত ছাড়া সব বাজারে বাংলাদেশের রপ্তানি গত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তুলনায় এই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ কমেছে। পোশাক রপ্তানি কমেছে ৬ দশমিক ২ শতাংশ আর পোশাকবহির্ভূত রপ্তানি কমেছে ৪ শতাংশ। রপ্তানি বহুমুখীকরণে আমাদের অগ্রগতি অতি নগণ্য। 

আমদানির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশি শিল্পগুলো অসুবিধায় পড়েছে হয়তো, তবে এ নিয়ে তেমন সুনির্দিষ্ট তথ্যের অভাব আছে। দেশে চাহিদার দুর্বলতা ও খাদ্য উৎপাদন ভালো হওয়ার কারণে আমদানি কমেছে। তা ছাড়া, আমদানির ওপর উচ্চ শুল্কের ফলে অভ্যন্তরীণ বাজারমুখী শিল্পগুলো বেশ সুরক্ষা পায়। তাই টাকার অতিমূল্যায়ন তাদের মুনাফাকে অতটা আঘাত করতে পারেনি বলে মনে হয়। 

রপ্তানিকারকেরাও, বিশেষ করে পোশাক খাত পিছিয়ে নেই। তারা নিজের সুরক্ষার জন্য বিভিন্ন সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, যেমন নগদ ভর্তুকি, কর অব্যাহতি, বন্ড, সস্তায় ঋণ ইত্যাদি। সমস্যা হলো, সুবিধাগুলো কেউ পায় আবার কেউ পায় না। পেতে গেলে অনেক দেনদরবার করতে প্রচুর সময় এবং অর্থের অপচয় হয়। দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির সুযোগ কাজে লাগানো ব্যবসায়িক কৌশলে পরিণত হয়ে গেছে। এসব কারণে নীতির প্রয়োগে জনকল্যাণভিত্তিক অর্থনৈতিক যুক্তি আমলে নেওয়া হচ্ছে না। 

দিনের শেষে প্রশ্নটা এই যে দেশীয় শিল্পকে সুরক্ষার উত্তম পন্থাটা কী। জনকল্যাণবিবর্জিত যুক্তির ভিত্তিতে উচ্চ আমদানি শুল্ক, নগদ ভর্তুকি, কর অব্যাহতি, বন্ড নাকি মুদ্রা বিনিময় হারের নমনীয় ব্যবস্থাপনা এবং খাত নিরপেক্ষ বাণিজ্যনীতি যেখানে তদবির বা নীতিসহায়তা বাণিজ্যের কোনো সুযোগ নেই। কোন খাতে কে সফল হবে, সেটা সরকার না, বাজার নির্ধারণ করে দেবে। 

মুদ্রা বিনিময় হার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এ ক্ষেত্রে নীতিগত অবস্থান হলো ভাসমান মুদ্রা বিনিময় হার। অর্থাৎ চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে বাজার যে হারটি নির্ধারণ করবে, বাংলাদেশ ব্যাংক সেটাই চলতে দেবে। সেটা কখনোই হতে দেওয়া হয় না। সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কমবেশি হস্তক্ষেপ করে। বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে ডলার কেনাবেচা করে বা অনুমোদিত ডিলারদের নির্দেশনা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে। টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখার জন্য ফোন করা ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংক গত আড়াই বছরে ৫০ কোটি ডলারের বেশি বিক্রি করেছে। তা সত্ত্বেও টাকা ৬ শতাংশের বেশি নামিক (নমিনাল) অবমূল্যায়িত হয়েছে, যেটা প্রতিযোগীদের তুলনায় অনেক কম। ফলে অতিমূল্যায়ন সংশোধনে এই অবমূল্যায়ন বড় ধরনের অবদান রাখতে পারেনি। 

মুদ্রা বিনিময় হারের স্থিতিশীলতা সার্বিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্ব রাখে, তবে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ স্থিতিশীলতার বিনিময়ে নয়। রিজার্ভের পরিমাণ মাসিক আমদানির হিসাবে অর্থবছর ২০১৭–তে ৮ মাস থেকে ২০১৯–এ ৬ মাসে নেমে আসে। রিজার্ভের সীমাবদ্ধতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে টাকার মান ধরে রাখা সব সময় সম্ভব হয় না। আবার ধরে রাখতে গিয়ে ডলার বিক্রি করলে টাকার তারল্য কমে যায়। ফলে সুদের হারের ওপর চাপ বেড়ে যায়। 

ভাসমান মুদ্রাহারকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। মুদ্রা বিনিময় হার অবমূল্যায়িত হলে আমদানি খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে ঠিকই। তবে সেটা প্রতিকারযোগ্য। আমদানি কর একই অনুপাতে কমিয়ে আমদানি খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। 

আমরা বিদেশি প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ চাই, চাই শেয়ারবাজারে পোর্টফোলিও বিনিয়োগ। এগুলো পেতে হলে বিদেশি মূলধন লেনদেনের দুয়ার খোলা রাখতে হবে। আবার মুদ্রা বিনিময় হারকে বেঁধেও দিতে চাই। সেই সঙ্গে মুদ্রানীতির নিয়ন্ত্রণ কিন্তু হারাতে চাই না। ব্যাপারটা প্রবল স্রোতে বহমান নদীর ওপর দুই নৌকায় একসঙ্গে পা রাখার মতোই বিপজ্জনক। উদার মূলধন প্রবাহ, স্থির বিনিময় হার এবং স্বায়ত্তশাসিত মুদ্রানীতি একযোগে করতে চাওয়ার পরিণাম নিশ্চিত সলিলসমাধি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। 


ড. জাহিদ হোসেন অর্থনীতিবিদ