মুক্ত সংবাদমাধ্যমের বন্ধু কে, শত্রু কে

গত রোববার বিএনপির পক্ষ থেকে জাতীয় গণমাধ্যমের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছিল। সভায় গিয়ে অনেকটা হতাশ হলাম। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির অর্ধডজন সদস্যসহ অনেক কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত থাকলেও দিনকাল ছাড়া কোনো পত্রিকার সম্পাদক সেখানে ছিলেন না। যদিও মতবিনিময় সভাটি ছিল সম্পাদকদের সঙ্গে।

ব্যানারে মতবিনিময় সভার শিরোনাম লেখা হয়েছিল: ‘গণতন্ত্র হত্যায় গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ আইন, প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’। কিন্তু দলের পক্ষ থেকে গণমাধ্যম সেলের প্রধান জহিরউদ্দিন স্বপন উত্থাপিত নিবন্ধের শিরোনাম ছিল ‘মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশের ক্রমাবনতির প্রেক্ষিত ও বিএনপির ভাবনা।’ এতে আরএসএফের প্রতিবেদনের সূচকে বাংলাদেশের ধারাবাহিক অবনতির কথা উল্লেখ করে বলা হয়: ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২১। ১৩ বছরের ব্যবধানে হয়েছে ১৬২।

সন্দেহ নেই স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রধান বাধা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। তবে এর বাইরেও অনেক আইন সাংবাদিকদের হাত–পা বেঁধে রেখেছে কিংবা বঁাধার চেষ্টা করছে। ২০ মে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনাম তাঁর লেখায় ১২টি আইন বা প্রস্তাবিত আইনের উল্লেখ করেছেন। এই আইনগুলো হলো যথাক্রমে: ১. পেনাল কোড ১৯৬০ (ধারা ৪৯৯-মানহানি); ২. ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪); ৩. অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩; ৪. আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩; ৫. প্রিন্টিং প্রেস ও প্রকাশনা (ঘোষণা ও নিবন্ধন) আইন, ১৯৭৩; ৬. প্রেস কাউন্সিল আইন, ১৯৭৪; ৭. সংবাদপত্র কর্মচারী (পরিষেবার শর্ত) আইন, ১৯৭৪; ৮. তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ২০০৬; ৯. ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮; ১০. ডিজিটাল, সোশ্যাল মিডিয়া এবং ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন, ২০২১; ১১. ওভার দ্য টপ (ওটিটি) কনটেন্ট বেজড সার্ভিস প্রভাইডিং অ্যান্ড অপারেশন পলিসি, ২০২১ (আইসিটি বিভাগ দ্বারা); এবং ১২. (খসড়া) মাস মিডিয়া কর্মচারী (পরিষেবার শর্তাবলি) আইন ২০২২। এসব আইনি বাধার পাশাপাশি আছে বেআইনি বাধাও।

সেদিনের মতবিনিময় সভায় বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, তারা সরকারে গেলে মুক্ত গণমাধ্যমের অন্তরায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ সব ধরনের নিবর্তনমূলক আইন ও অধ্যাদেশ বাতিল করা হবে। এ ছাড়া তারা বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলকে পুনর্গঠন করে এর ক্ষমতা ও পরিধি বাড়ানোর কথা বলা হয়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত যেকোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি বা সংস্থা প্রেস কাউন্সিলের ফয়সালা না করে কোনোভাবেই যেন আদালতে যেতে না পারেন, সেটি নিশ্চিত করা হবে। গণমাধ্যমকে স্বাবলম্বী করার জন্য বিজ্ঞাপনের সুষম বণ্টন, প্রচারসংখ্যা ও টিআরপির ভিত্তিতে আর্থিক প্রণোদনার চিন্তাও বিএনপির আছে বলে প্রবন্ধে জানানো হয়।

স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ঘুরেফিরে দেশ চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে। জাতীয় পার্টি স্বৈরাচারের দল, তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলো সাংবাদিকদের প্রতি যে আচরণ করেছে, তা–ও সুখকর নয়।

বিএনপির এ ঘোষণাকে আমরা স্বাগত জানাই। সেই সঙ্গে এ প্রশ্নও করছি যে নব্বইয়ে স্বৈরাচারের পতনের পর বিএনপি দুই মেয়াদে ১০ বছর ক্ষমতায় ছিল। সেই সময় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন না থাকলেও প্রেস কাউন্সিল ও ডিএফপি যথারীতি ছিল। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার যেমন এ দুই প্রতিষ্ঠানকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে, ক্ষমতায় থাকতে বিএনপিও তা-ই করেছে। খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারে দাপুটে তথ্যমন্ত্রী ছিলেন নাজমুল হুদা। তিনি শিবির বদল করেছেন। কিন্তু তাঁর ‘অক্ষয় কীর্তি’র কথা আমরা ভুলতে পারি না। নাজমুল হুদা সে সময় ভোরের কাগজ-কে দৈনিক ২০ ইঞ্চি বিজ্ঞাপন দিয়ে সমুচিত শাস্তি দিয়েছিলেন। তিনি জনসভায় কী বক্তৃতা দিতেন, তা পত্রিকায় ছাপা হতো না। রাতে তাঁর অফিস থেকে পাঠানো বিজ্ঞপ্তিই হুবহু ছাপতে হতো। তিনি তথ্যমন্ত্রী থাকতেই পুলিশ জাতীয় প্রেসক্লাবে ঢুকে সাংবাদিকদের বেধড়ক পিটিয়েছিল। সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত হওয়ার ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা ছিল বলে অভিযোগ আছে।

খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সঙ্গে দ্বিতীয় সরকারের আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। প্রথম সরকারটি অনেক বেশি সহনশীল ছিল। তারপরও সে সময় বিজ্ঞাপন বণ্টনে ন্যায্যতা ছিল না। সব সরকারই মুক্ত সাংবাদিকতার স্থলে পছন্দের সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের খুঁজে বেড়ায়। এ কারণেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি বিরোধী দলে থাকতে গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বন্ধু হয়। কিন্তু ক্ষমতায় গেলেই তাদের ভিন্ন রূপ দেখতে পাই।

ওই দিনের সভায় বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সাংবাদিক নিগ্রহ, পত্রিকা ও টিভি বন্ধ করা সম্পর্কে যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে, তার কোনোটি মিথ্যা নয়। এ সময় বেসরকারি টিভি ও পত্রিকা বন্ধ হওয়ায় অনেক সাংবাদিক বেকার হয়েছেন এ-ও সত্য। বর্তমান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দিয়ে বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে জেল খাটিয়েছে। এই সরকারের আমলে ডেইলি স্টার সম্পাদকের বিরুদ্ধে ৭০টির বেশি মামলা হয়েছিল। কিশোর আলোর একটি অনুষ্ঠানে দুর্ঘটনায় এক ছাত্রের মৃত্যু হওয়ায় প্রথম আলো সম্পাদকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। গত বছর প্রথম আলোর সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সংবাদ সংগ্রহের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে গেলে তাঁকে ছয় ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখা হয় এবং পরে শত বছরের পুরোনো অফিশিয়াল সিক্রেসি আইনে মামলা করে কারাগারে পাঠানো হয়। কেবল প্রথম আলো নয়, অনেক পত্রিকার সাংবাদিকের নামে হয়রানিমূলক মামলা করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। কার্টুনিস্ট কিশোর কিংবা সাংবাদিক শফিকুল ইসলামের ওপর অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে। লেখক মোশতাক আহমদ কারাগারেই মারা গেছেন। এসব ঘটনায় সাংবাদিক-লেখকদের প্রতি আওয়ামী লীগ সরকারের বৈরী ও বিদ্বেষমূলক আচরণই প্রকাশিত হয়েছে। আমরা অবশ্যই গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমবিরোধী এ আচরণের নিন্দা করি।

সেই সঙ্গে এ কথাও বলতে হবে যে বিএনপির আমলেও সাংবাদিকেরা নির্বিঘ্নে দায়িত্ব পালন করেছেন, কোনো হামলা-মামলা হয়নি, তা ঠিক নয়। বিএনপি সরকারের আমলে একুশে টিভি বন্ধ করা হয়েছিল। বিদেশি সংবাদমাধ্যমে পাঠানো একটি খবরে ভুল তথ্য উদ্ধৃত হওয়ায় বিএসএসের সাংবাদিক এনামুল হক চৌধুরীকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছিল। দুই বিদেশি সাংবাদিককে সহায়তার কারণে সাংবাদিক সালিম সামাদ ও প্রিসিলা রাজের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সুহৃদ সায়মন ড্রিংয়ের ভিসা নবায়ন না করে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল।

সেই মতবিনিময় সভায় বিএনপির পক্ষ থেকে একমাত্র মহাসচিবই বক্তব্য দিয়েছেন। তাঁর ঘোষণা ও অঙ্গীকারকে আমরা বিএনপির অঙ্গীকার হিসেবে ধরে নিতে পারি। প্রশ্ন হলো, ক্ষমতায় গিয়ে তঁারা এসব অঙ্গীকার ও ঘোষণা মনে রাখবেন কি না।

স্বাধীনতার পর গত ৫১ বছরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি ঘুরেফিরে দেশ চালিয়েছে এবং চালাচ্ছে। জাতীয় পার্টি স্বৈরাচারের দল, তাদের কাছ থেকে কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু স্বৈরাচারের পতনের পর ‘গণতান্ত্রিক’ সরকারগুলো সাংবাদিকদের প্রতি যে আচরণ করেছে, তা–ও সুখকর নয়। সেদিন অনেক সাংবাদিক বন্ধু মতবিনিময় সভায় আমার সত্যভাষণে খুশি হতে পারেননি। তঁাদের বক্তব্য হলো দুই আমলের মধ্যে তুলনা করা ঠিক নয়। বিএনপির সময় সাংবাদিক নিগ্রহের ঘটনা ঘটলেও আওয়ামী লীগ আমলের মতো সর্বগ্রাসী নয়। সাংবাদিক বন্ধুদের কারও কারও কথায় সাংবাদিকতার স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার চেয়ে দলীয় আনুগত্যই বেশি প্রকাশিত হয়েছে। আসলে সমস্যাটি মাত্রার নয়, দৃষ্টিভঙ্গির, আচরণের, ক্ষমতার। বিরোধী দলে থাকতে সবাই গণমাধ্যমের বন্ধু হয়। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে তা ভুলে যায়। ক্ষমতায় থাকতে সাংবাদিকদের সঙ্গে তাদের মতবিনিময়ের প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হয় আনুগত্য পাওয়ার।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

sohrabhassan55@gmail.com