মুক্ত গণমাধ্যম কি অধরাই থেকে যাবে

‘যেসব দেশে গণমাধ্যম স্বাধীন, সেসব দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না।’ অমর্ত্য সেনের এই অনুধাবন বেশ পুরোনো। বিশেষত বর্তমান সময়ের বিচারে। জঁ দ্রেজ ও অমর্ত্য সেন হাঙ্গার অ্যান্ড পাবলিক অ্যাকশন (ক্ষুধা ও জনকর্মসূচি) নামের বইটি লিখেছিলেন ১৯৮৯ সালে।

উদাহরণ হিসেবে তাঁদের সময়ের সোমালিয়া বা ইথিওপিয়া খানিকটা এলেও মূল আলোচনার প্রয়োজনে তাঁরা পেছনের ইতিহাসই টেনেছেন বেশি। যেমন পঞ্চাশের মন্বন্তর এবং বাংলাদেশের ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। অমর্ত্য সেন টের পেয়েছিলেন স্বাধীন গণমাধ্যম–সম্পর্কিত এই অনুধাবন সেকেলে হতে চলেছে। তিনি ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং গুণীজনদের আসরে স্বাধীন গণমাধ্যমের শক্তির নতুন নতুন ডালপালার সন্ধান দিতে থাকলেন।

অমর্ত্য সেনের গবেষণালব্ধ জ্ঞান এই যে গণমাধ্যম মুক্ত থাকলে সমাজের অলিগলিতে নজর রাখতে পারে। ব্যবস্থাপনার অসংগতি ও অনিয়ম চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে পারে। ফলে, খাদ্য ব্যবস্থাপনা সহজতর ও যথার্থ হয়।

কারণ, খাদ্যের অভাবে দুর্ভিক্ষ হয় না। দুর্ভিক্ষ হয় দরকারি সঠিক তথ্য সঠিক সময়ে না থাকার কারণে। তাঁর তথ্যমুক্তিবিষয়ক সংযোজক ও সম্পূরক চিন্তার আরেক কারণ বিশ্বায়ন। এটা আগে অদেখা নতুন দুনিয়ার তথ্যবাস্তবতা। ইন্টারনেটের কারণে চোখের পলকে দুনিয়া হয়ে বসল গ্লোবাল ভিলেজ। পত্রিকা আর টেলিভিশনেই জনতাকে আটকে থাকতে হচ্ছিল না। অনলাইন দুনিয়া তথ্য নানা রূপে, নানা প্রকরণে আমজনতার নাগালে পৌঁছাতে লাগল। সৃষ্টি হলো ‘সিটিজেনস জার্নালিজম’–এর। জন্ম হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের।

নৃবিজ্ঞানী অর্জুন আপ্পাদুরাইয়ের ‘মিডিয়াস্কেপ’ ধারণাটিকে নোয়াম চমস্কি যেমন গুরুত্ব দিতে শুরু করলেন, অমর্ত্য সেনও আমলে নিলেন। ‘মিডিয়াস্কেপ’ ধারণাটি দিয়ে আপ্পাদুরাই বলেই রেখেছেন, বিশ্বায়নের পাঁচটি ক্রীড়নকের অন্যতম ‘তথ্যের অবাধ প্রবাহ’। এই প্রবাহ প্রপাতের জলের তোড়ের মতো। বাধা পেলে উপচে পড়বে।

অমর্ত্য সেন মুক্ত গণমাধ্যমের অনেক প্রয়োজনীয়তার মধ্যে চারটিতে বিশেষ গুরুত্ব দেন। সেগুলো হলো:

এক, ‘তথ্যের মুক্ততা ছাড়া (অর্থনৈতিক) উন্নয়ন পরিকল্পনা অকার্যকর হয়ে পড়বে’। কারণ, আগে গণতান্ত্রিক দেশেও উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলো নির্ভরশীল ছিল ‘যারা সবচেয়ে ভালো জানে’ নীতিনির্ভর। অর্থাৎ আমলাতন্ত্রনির্ভর। বিশ্বায়নের আগে আমলাতন্ত্র গণবিতর্ককে (পাবলিক ডিবেট) আমলে নেওয়ার দরকার বোধ করত না। বিশ্বায়নের কালে অসংখ্য তথ্যসূত্রে মানুষের প্রবেশাধিকার বেড়েছে। ফলে, গণভাবনা যথেষ্ট পরিণত। সেগুলোকে আমলে নিতে হয়। নইলে চাপিয়ে দেওয়া উন্নয়ন পরিকল্পনা আসল উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে পারে।

দুই, গণতন্ত্রের জন্য মুক্ত গণমাধ্যম প্রয়োজন। আধুনিক গণতন্ত্র ‘সজ্ঞান রাজনীতি’ বা ‘ইনফর্মড পলিটিকস’। যেহেতু নাগরিকেরা আগের চেয়ে অনেক সচেতন, তারা চাইবে গণমাধ্যমে বিভিন্ন রাজনৈতিক মত-পথের তর্ক-বিতর্ক প্রকাশিত-প্রচারিত হোক।

তারা আবেগের চেয়ে যুক্তির প্রয়োগ বেশি ঘটাবে। জনসমর্থন পেতে রাজনীতিকেরা তাদের কাছে ভবিষ্যতের উন্নয়ন নীতিমালা ব্যাখ্যা করবে। জবাবদিহি কীভাবে হবে, বলে যেতে হবে।

তিন, উপেক্ষিত ও অবহেলিত মানুষের কথা আলোয় আনতে হলে মুক্ত গণমাধ্যম লাগবেই। কারণ, বিশ্বায়নের সুযোগ তারা পায় না। যেমন ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ বাস্তবতা। দরিদ্র মানুষের ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার থাকে না। তাদের বড় অংশের টেলিভিশন, রেডিও বা সংবাদপত্রের খবরেও প্রবেশাধিকার নেই। চার, ‘সামাজিক ন্যায়বিচার’ নিশ্চিত করতে হলে গণমাধ্যমের মুক্ততার কোনোই বিকল্প নেই।

যেমন গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রিত হওয়ার অর্থ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার টুঁটি চিপে ধরা। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত হলে দুর্নীতি বাড়ে, ক্ষমতাবলয়ের বাড় বাড়ে, গণবিরোধী অপরাধীচক্র বাড়ে। সামাজিক ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে পড়ে।

২.
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকে বাংলাদেশ আরও এক ধাপ নিচে নেমেছে। টানা পরপর তিন বছর ধরে এ পতন অব্যাহত রয়েছে। এ বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম। আগের বছর ছিল ১৫১তম। তার আগের বছর ১৫০তম। ২০২১ সালে বাংলাদেশের গণমাধ্যম দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি অমুক্ত নির্ণিত হয়েছে।

গণমাধ্যম মুক্ততার ধরন অনুযায়ী বাংলাদেশ ‘রেড জোন’ বা ‘বিপজ্জনক’ বা ‘খুব খারাপ’ তালিকাভুক্ত হয়েছে। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স মুক্ত গণমাধ্যমের শর্তভঙ্গের একটি ইনফোগ্রাফিক ব্যারোমিটারও প্রকাশ করেছে। তাতে উল্লেখ করা হয়েছে, শুধু ২০২১ সালেই ছয়জন সাংবাদিক এবং চারজন গণমাধ্যম সহকারী খুন হয়েছেন। কারাবন্দী হয়েছেন ৩০৪ জন সাংবাদিক, ১০০ জন নাগরিক সাংবাদিক এবং ১২ জন গণমাধ্যম সহকারী।

আগামী বছরে যদি আরও এক ধাপ বা কয়েক ধাপ পতন হয়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এবারের পতনেও যেমন কেউ ততটা বিস্মিত নয়। সাংবাদিকতার জগতের কেউই সম্ভবত আশা করেনি যে অলৌকিক কোনো অগ্রগতি ঘটবে। রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিক্রিয়া ও বক্তব্য কী হতে পারে, সেটিও সহজেই অনুমেয়। তারা হয়তো বলবে, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের গবেষণাপদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত নয়।

এসব প্রতিক্রিয়া আমাদের অভ্যস্ততার অংশ হয়ে উঠেছে। অথবা তারা হয়তো সূচক পতনকে আমলে নেওয়ার বিষয়ও ভাববে না। ২০১৮ সালের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগের তথ্যটিও প্রতিবেদনে অনুল্লেখিত নেই। বাংলাদেশে গণমাধ্যমের হালহকিকত ও অমুক্ততা–সম্পর্কিত প্রতিবেদনটির সংক্ষিপ্তসার ভিনদেশের যেকোনো সংবাদকর্মীর সাংবাদিকতার প্রয়োজনে বাংলাদেশে আগমনে নিরুৎসাহিত করবে নিশ্চিত।

গণমাধ্যমকে মুক্ত ও স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেওয়াই যেকোনো সরকারের জন্য বেশি বিপজ্জনক। কারণ, এক, এতে অতথ্য (ডিসইনফর্মেশন) দারুণ বিশ্বাসযোগ্যতা পেয়ে বসে। মানুষের তথ্যক্ষুধা দিনদিন বাড়ছে। যেমনটি আপ্পাদুরাই ও সেন অনুমান করেছিলেন, সে রকম।

অমর্ত্য সেন যেটিকে ‘পাবলিক ডিবেট’ বলেন, সেটির প্রত্যাশায় ইউটিউব ছাড়াও অসংখ্য বিকল্প মাধ্যমে মানুষ তথ্যের ব্যবচ্ছেদ দেখতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ইউটিউবে বাংলাদেশের সরকারবিরোধী অনুষ্ঠানগুলোর ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তাই তার প্রমাণ। দুই, সঠিক তথ্যকে পাশ কাটিয়ে বানোয়াট তথ্য প্রচারের ব্যবস্থা চললে জনগণ সঠিক তথ্যেও আর আস্থা রাখতে চায় না। ঘরপোড়া গরু যেমন সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়, সে রকম।

অমুক্ত গণমাধ্যম আরও দুই ধরনের বিপজ্জনক চর্চার জন্ম দেয়। তাদের একটি ‘গুজব’, যা বাতাসের আগে ধায়। গুজব নিয়ন্ত্রণ করতে চীনা সরকারও হিমশিম খাচ্ছে সম্প্রতি। বাংলাদেশেও অনেক মানুষ গুজবে কান দেয়। অপরটি ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জনপ্রিয়তা। অবস্থাটি গল্পের মিথ্যাবাদী রাখালের ওপর বিশ্বাস হারানোর মতো। বাংলাদেশে করোনাকালে আমজনতা প্রায় প্রতিটি তথ্যকেই সন্দেহ করেছে এবং করছে।

গত বছর মৃত ও সংক্রমণের সরকারি সংখ্যা প্রসঙ্গে আমজনতা বিশ্বাস করত যে প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশি। এ বছর স্কুল-কলেজ বন্ধ-খোলা-বন্ধের দোলাচল, লকডাউনের শিথিল ও কঠোর সব পদ্ধতিকেই জনতা সন্দেহের চোখে দেখেছে। রাজনীতি ভেবেছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বে আস্থাবাদী হয়ে পড়েছে বিশাল জনগণ। মুক্ত গণমাধ্যম থাকলে গণ-অনাস্থা তৈরি হতো না।

সবশেষ অসুবিধার নাম ‘সেলফ সেন্সরশিপ’। ‘স্বেচ্ছানিয়ন্ত্রণ’ বাংলাদেশে পাঠ্যবইয়ে স্থান পাওয়ার মতো একটি শব্দে পরিণত হয়েছে। শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক—কেউই মন খুলে লিখতে বা বলতে পারছেন বলে মনে হয় না।

যেসব লেখালেখি বা আলাপচারিতায় মুক্ত আলোচনা একান্তই অবধারিত, সেসব ক্ষেত্রেও লিখিয়ে বা বলিয়ে সতর্ক ও ভীতসন্ত্রস্ত থাকছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়্গ মাথার ওপর ঝুলতে দেখা জ্ঞানজাগতিক বিকাশকে বহুলাংশে খর্ব করছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষকদের বিভিন্ন সংবেদনশীল বিতর্কের পাঠালোচনায় যেতে হয়।

ভুল অর্থ বা ভুল ব্যাখ্যা করা হতে পারে ভেবে তাঁরা সেসব পাঠালোচনাও এড়িয়ে যান। কট্টর রাজনৈতিক ভাবনাতাড়িত গণমাধ্যমগুলো ঝামেলা বাধাতে ওত পেতে আছে ভেবে অনেকেই মুক্ত আলোচনায় নিরুৎসাহী থাকেন। এত সব দম বন্ধ করা অবস্থা নিরাশাই বাড়ায়। আমরা শুধু প্রশ্নই করে যেতে থাকি—বাংলাদেশে মুক্ত গণমাধ্যম কি চির–অধরাই থেকে যাবে?

ড. হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান। সদস্য, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়।