মুক্ত গণমাধ্যমের বাধা কি কেবলই একটি আইন

গণমাধ্যম সূচকে এই বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২
গণমাধ্যম সূচকে এই বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২

৩ মে ছিল বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। এই দিন বাংলাদেশের গণমাধ্যম, এর সঙ্গে যুক্ত সম্পাদক, লেখক, কলামিস্টসহ সবার বক্তব্যে মোটাদাগে একটি আফসোসই ফুটে উঠেছে, আর তা হলো, বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম সূচকও এই ইঙ্গিতই দেয়। কয়েক বছর ধরে ক্রমাগত পেছাতে পেছাতে এই বছর ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম। বাংলাদেশ পেছাচ্ছে, এটা খুব নতুন খবর না। তবে যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে আফগানিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ তো বটেই এমনকি মিয়ানমারের গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও আমাদের চেয়ে ভালো। প্রত্যেকেই এর মূল কারণ হিসেবে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে দায়ী করলেও বাংলাদেশের আজকের এই অবস্থায় আসার পেছনে শুধু একটি আইনই দায়ী বলে আমি মনে করি না।

করোনার নতুন বাস্তবতায় মুক্ত গণমাধ্যম এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর এ-সংক্রান্ত আইনের একটা নতুন প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। করোনার সূচনাতেই আমরা দেখেছি চীনের আপ্রাণ চেষ্টা ছিল পুরো বিষয়টিকে ধামাচাপা দেওয়ার। চীনে প্রথম করোনাভাইরাসের কথা বলেছিলেন লি ওয়েনলিয়াং নামের একজন চিকিৎসক। তিনি আশঙ্কা করছিলেন নতুন একধরনের ভাইরাসের, যার লক্ষণ আগের সার্স ভাইরাসের মতো। সামাজিক মাধ্যমে এমন কথা বলার অপরাধে চীন সরকার তাঁকে তুলে নিয়ে গিয়ে চরমভাবে তিরস্কার করে এবং এমন কথা বলা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে।

লি ওয়েনলিয়াং বলার পরদিন ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীন আনুষ্ঠানিকভাবে একটি এটিপিক্যাল নিউমোনিয়ার অস্তিত্বের কথা স্বীকার করে। এরপর মেডিকেল সায়েন্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাময়িকী ল্যানসেট-এর একটা গবেষণার মাধ্যমে জানায় উহানে এই ভাইরাস পাওয়া গিয়েছিল তারও এক মাস আগে। প্রশ্ন আসে, চীন যদি ডিসেম্বরের প্রথমেই করোনার অস্তিত্ব স্বীকার করত এবং উহান লকডাউন ঘোষণা করত, তাহলে পৃথিবীর কি এই ভয়ংকর বিপর্যয় হতো? কিংবা লি ওয়েনলিয়াং যদি ডিসেম্বরের শেষে এসে এই কথাগুলো না বলতেন, তাহলে কি চীন তখন স্বীকার করত ভাইরাসের অস্তিত্বের কথা? তাহলে বৈশ্বিক পরিস্থিতি কি হতে পারত না আরও অনেক বেশি ভয়াবহ? তথ্য কীভাবে মানুষকে বাঁচায় অথবা এর ঘাটতি কী করে বহু মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, তার একটি বড় উদাহরণ হয়ে থাকবে লি-এর ঘটনাটি।

যেসব দেশে সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন, গণমাধ্যমকে চাপে রাখা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্য শেয়ারের অভিযোগে দমননীতি প্রয়োগের অভিযোগ উঠেছে তার মধ্যে ভারত অন্যতম।

ভারতে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে আক্রান্ত রাজ্যগুলোর একটা হচ্ছে উত্তর প্রদেশ; স্বাভাবিকভাবেই দিল্লির মতো সেখানেও হাসপাতাল শয্যা, অক্সিজেন, আইসিইউর চরম সংকট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন সরকার দাবি করেছিল রাজ্যে করোনার স্বাস্থ্যসেবার জন্য হাসপাতাল শয্যা, অক্সিজেন, আইসিইউসহ কোনো কিছুরই অভাব নেই। রাজ্য সরকার হুমকি দিয়ে বলেছিল, কেউ সামাজিক মাধ্যমে এমন কিছু চেয়ে স্ট্যাটাস দিলে সেটাকে মিথ্যা অভিযোগে রাজ্যের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা হিসেবে বিবেচনা করা হবে এবং তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কথা রেখেছিল উত্তর প্রদেশ সরকার—তারা কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করেছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হাসপাতাল শয্যা বা অক্সিজেন চেয়ে স্ট্যাটাস দেওয়ার ‘অপরাধে’। একই ধরনের ঘটনার উদাহরণ পাওয়া গিয়েছিল হরিয়ানা ও মহারাষ্ট্রেও।

এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের একটি বেঞ্চের বিচারপতি চন্দ্রচুড় সরকারের এমন দমননীতি প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশের নাগরিক এবং বিচারপতি হিসেবে একটা বিষয় নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন আমি। তা হলো দেশের কোনো নাগরিক যদি নেট মাধ্যমে অভাব-অভিযোগ তুলে ধরেন, সে ক্ষেত্রে তথ্যের ওপর দমননীতি নেওয়াকে সমর্থন করি না। নাগরিকদের কথা আমাদের কানে পৌঁছাতে দিন। আগামী দিনে হাসপাতালে শয্যা এবং অক্সিজেনের অভাব নিয়ে নেট মাধ্যমে মুখ খুলে কাউকে যদি হেনস্তার শিকার হতে হয়, তা আদালতের অবমাননা বলে গণ্য হবে।’ অর্থাৎ ভারতে মতপ্রকাশের পর কেউ হেনস্তার শিকার হলে সেটি হবে আদালত অবমাননা আর ঠিক এই কারণেই সেখানে আমাদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ধাঁচের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০০ থাকার পরও মানুষ বলতে বা লিখতে দুবার চিন্তা করে না, কারণ তারা জানে আদালত আছেন তাদের সুরক্ষায়।

ইতিমধ্যেই করোনার ভয়াবহতায় ভারতের আর সব রাজ্যকে ছাপিয়ে গেছে দিল্লি। সেখানে প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে আক্রান্ত আর মৃতের সংখ্যা। চলছে অক্সিজেনের জন্য হাহাকার। এমন অবস্থায় অক্সিজেনের অভাবে দিল্লির এক হাসপাতালে ৮ জন করোনা রোগীর মৃত্যুর ঘটনায় দিল্লির হাইকোর্ট বলেন, ‘পানি এখন আমাদের মাথার ওপরে। আপনাদের এখন সবকিছু ব্যবস্থা করতে হবে…আমরা কেন্দ্রকে নির্দেশ দিচ্ছি তারা দিল্লির জন্য বরাদ্দকৃত ৪৯০ টন অক্সিজেন যেকোনো মূল্যে সরবরাহ করবে। এই আদেশ এক দিন আগে দেওয়া হলেও সেটা পালন করা হয়নি। এটার জন্য আমরা আদালত অবমাননার কার্যক্রম শুরু করার কথাও ভাবতে পারি।’ অর্থাৎ দিল্লি হাইকোর্টও সরকারকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন তাঁদের নির্দেশ মোতাবেক ‘যেকোনো মূল্যে’ অক্সিজেন সরবরাহে ব্যর্থ হলে সরকারকে আদালত অবমাননার দায় বইতে হবে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের মতোই দিল্লি হাইকোর্টও করোনা মহামারিতে শক্তভাবে এসে দাঁড়িয়েছেন তাদের মানুষের পাশে।

করোনায় ভারতের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজ্যের আরেকটি উত্তর প্রদেশের লক্ষ্ণৌ ও মীরাট জেলায় অক্সিজেন না পেয়ে মারা গেছেন কয়েকজন। এই পরিপ্রেক্ষিতে এলাহাবাদ হাইকোর্টও খুব কঠোর ভাষায় স্পষ্ট করেছেন, শুধু অক্সিজেন না পেয়ে হাসপাতালে করোনা রোগীর মৃত্যু একধরনের অপরাধ, যা ‘গণহত্যার চেয়ে কম নয়’। এ হত্যার দায় কর্তৃপক্ষের, যারা অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাপনা করছে।

বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই ছিল হযবরল। একদিকে ছিল সাধারণ মানুষের ভোগান্তি, করোনা পরীক্ষা, হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন, আইসিইউ, হালে টিকা ইত্যাদির চরম অপ্রতুলতা, নানা অদক্ষতা-অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি অন্যদিকে সরকারে ছিল সবকিছু ধামাচাপা দিয়ে সব ঠিকঠাক চলছে এমনকি করোনায় বাংলাদেশ অসাধারণ ব্যবস্থাপনা করেছে, সেটা দেখানোর তাড়না। আর তাই শুরু থেকেই সরকারের চেষ্টা ছিল এ-সংক্রান্ত ব্যর্থতা অসন্তোষের খবর যেন কোনোভাবেই বাইরে না যায়।

করোনার শুরুর দিকে এন-৯৫ মাস্ক ও পিপিই না পেয়ে ফেসবুকে স্বাস্থ্যসচিব, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সমালোচনা করে স্ট্যাটাস দেওয়ায় নোয়াখালীর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের কাছে কৈফিয়ত তলব করা হয়েছিল। এ ছাড়া কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে কর্মরত কিছু নার্স খাবারের মানসহ নানা অব্যবস্থাপনার কথা সংবাদমাধ্যমে বলায় নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের আওতাধীন সব সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীকে চাকরিবিধি অনুযায়ী ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া জনসম্মুখে, সংবাদপত্রে বা অন্য কোনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কোনো প্রকার আলোচনা, বিবৃতি বা মতামত প্রদান না করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

হুমকি এসেছিল গণমাধ্যমের ওপরও। চাল চুরির খবর প্রকাশের জের ধরে দুটি অনলাইন নিউজপোর্টালের প্রধান সম্পাদক ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকসহ চারজনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয়েছিল। বাদ যায়নি সামাজিক মাধ্যমও —করোনার অব্যবস্থাপনা নিয়ে কার্টুন আঁকার ‘অপরাধে’ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে। করোনার সময়ে সাংবাদিক এবং সাধারণ নাগরিকদের ওপর এই আইন দিয়ে দমন-পীড়নের কথা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স-এর সাম্প্রতিক সব রিপোর্টে উল্লেখ আছে। অবশ্য এসব ঘটনাকে চাইলেই যে কেউ ‘রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি’ নষ্টের সঙ্গে তুলনা করতে পারে যে ‘ভাবমূর্তি’ রক্ষার বিষয়ে কিছুদিন আগেই আমাদের সর্বোচ্চ আদালতকে অত্যন্ত সচেতন দেখা গেছে।

করোনা ব্যবস্থাপনার ঘাটতি ঢাকতে অনেক সরকারের মতোই ভারতও চেষ্টা করেছিল তথ্য গোপন আর মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে বিষয়টিকে সামাল দিতে। কিন্তু সেখানে আদালত বাধ সেধেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটটা একটু ভিন্ন। করোনা মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশনা চেয়ে একটি রিট আবেদনের ওপর শুনানিকালে হাইকোর্ট জনস্বার্থে মামলা করার নামে করোনাভাইরাসের টিকা ও অক্সিজেন সরবরাহ নিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি না করতে আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান। তাঁরা স্পষ্ট বলেন, সব ক্ষেত্রে আদালতের হস্তক্ষেপ করা উচিত না। লক্ষণীয় যে একই ধরনের মামলায় দুই দেশের আদালতের অবস্থান ভিন্ন।

সরকার তার সুবিধামতো কালো আইন তৈরি করতে পারে। সরকারের প্রয়োজন মেটাতে নির্বাহী বিভাগ একটি ভালো আইনেরও অপপ্রয়োগ করতে পারে। এখানেই ৮০০ বছরের পুরোনো ‘সেপারেশন অব পাওয়ার’ ধারণাটি কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা খুব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যে রাষ্ট্রে তিনটি স্তম্ভ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগ সার্বক্ষণিকভাবে পরস্পরের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’-এর মধ্যে থাকে, সেই রাষ্ট্রে ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ গণমাধ্যম অবাধ, মুক্ত এবং স্বাধীনভাবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারে। আর তাই শুরুতেই বলছিলাম কেবল একটি কালো আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা হতে পারে না, যদি রাষ্ট্রের অন্যান্য অঙ্গগুলো সঠিকভাবে কাজ করে।

রুমিন ফারহানা বিএনপি দলীয় সংসদ সদস্য ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী