‘মিম’ আসছে পশ্চিমবঙ্গে, মুসলমান ভোটাররা মানসিক চাপে

অল ইন্ডিয়া মজলিশে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমইএম) বা মিম এর  নেতা আসাদুদ্দীন ওয়াইসি
অল ইন্ডিয়া মজলিশে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমইএম) বা মিম এর  নেতা আসাদুদ্দীন ওয়াইসি

কংগ্রেস থাকার পর মুসলমানদের আলাদা সংগঠন দরকার আছে কি না, এ প্রশ্নে অনেক কাজিয়া হতো সাতচল্লিশের আগে। সে কাজিয়া থেকে ভারতীয় মুসলমানরা আজও রেহাই পায়নি। পশ্চিমবঙ্গে এখন একই কাজিয়া চলছে ‘মিম’কে নিয়ে।

বিজেপি ঠেকানোর দায় যেন শুধু মুসলমানদের
চার–পাঁচ মাস পরই পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন। বলা যায় অনানুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হয়ে গেছে। ভারতের অন্য রাজ্যগুলোর তুলনায় এখানে ভোটের গণিত ভিন্ন। প্রায় পুরো ভারত জিতেও বিজেপি অতৃপ্ত। কারণ গুরু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির রাজ্যে তারা আজও ক্ষমতায় যেতে পারল না। ফলে এই নির্বাচন তাদের জন্য বড় এক মর্যাদার লড়াই।
প্রতিদ্বন্দ্বিতা এখানে ত্রিমুখী-চতুর্মুখী। অন্য রাজ্যগুলোর মতো দ্বিমুখী নয়। বিজেপি ছাড়াও আছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বামপন্থীরা। আছে গান্ধী পরিবারের জাতীয় কংগ্রেসও। কংগ্রেস ও বামরা জোট করলেও নির্বাচন ত্রিমুখী হচ্ছে। যেকোনো বহুমুখী নির্বাচনে হার–জিত হয় অল্প ভোটে। তাই ‘সংখ্যালঘু’দের ভোট বিশেষ কদর পায়। সেই বিবেচনাতেই পশ্চিমবঙ্গে প্রাক্‌-নির্বাচনী আলোচনায় সবার কৌতূহল মুসলমানদের ভোট নিয়ে। মুসলমান নেতাদের রাজনৈতিক নড়াচড়াও প্রচারমাধ্যমের বিশেষ নজরে রয়েছে। এই সম্প্রদায় নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তায় আছে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক শিবির। তাদের মনোভাব দেখে মনে হতে পারে বিজেপিকে ঠেকানোর দায় যেন কেবল মুসলমানদের।

মীমকে নিয়ে তৃণমূল শিবিরে ভয়
প্রায় ২০ কোটি মুসলমানের দেশ ভারত। তবে দেশটিতে মুসলমানপ্রধান জাতীয় চরিত্রের দল নেই এখন। ২৯ রাজ্যে কেবল কেরালা, আসাম, কাশ্মীর ও তেলেঙ্গানায় চারটি বড় আঞ্চলিক দল আছে তাদের। পশ্চিমবঙ্গে তা–ও নেই। যদিও তিন কোটি মুসলমান এ রাজ্যে। গত ১০ বছর এদের ভোটের বড় অংশ পাচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘তৃণমূল’। ছয় মাস আগেও মনে হতো আসন্ন ভোটের গণিত গত নির্বাচনের মতোই হবে। কিন্তু বিহারে মিমের চমকে পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল শিবিরে ভয়ের হাওয়া বইছে।
‘মিম’ মানে অল ইন্ডিয়া মজলিশে ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমইএম)। হায়দরাবাদের আসাদুদ্দীন ওয়াইসির দল এটা। সবাই ইংরেজি বর্ণমালার হিসেবে ‘মিম’ বলে ডাকে। তেলেঙ্গানার আঞ্চলিক দল হলেও মীমের আবেদন ও পরিচিতি এখন ভারতজুড়ে। আগে তাদের ‘এক-দুই এমপির দল’ বলে ঠাট্টা উপহাস করা হতো। কিন্তু বিহারে সদ্য হওয়া ভোটে পাঁচটি আসন পেয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছে। বিজেপি বনাম কংগ্রেস-মিত্রদের মহারণে তৃতীয় কারও আসন জেতামাত্রই বড় ঘটনা। মীম সেখানে মাত্র ২০টি আসনে লড়ে পাঁচ লাখের বেশি ভোট পেয়েছে। এসবই যে মুসলমানদের ভোট, সেটা বলা বাহুল্য। মীম মাঠে না এলে এই ভোট বিজেপিবিরোধী শিবির পেত। মীমের আগমনে তাই তারা নাখোশ এবং বিজেপি খুশি।
কিষানগঞ্জসহ বিহারের যেসব এলাকায় মিম জনপ্রিয়, তার লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরের মতো এলাকা যেখানে মুসলমান ভোট ৪৫ ভাগ মতো। বাংলাদেশের ঠাকুরগাঁওয়ের বালিয়াডাঙ্গী সীমান্তের ওপারের এই এলাকাতে এখন পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ভাষ্যকারদের বিশেষ মনোযোগ।

মিমের সম্ভাবনা কম; কিন্তু বিপদ ঘটাতে পারে
পশ্চিমবঙ্গে মুসলমানদের একটা বড় রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যই প্রভাবশালী কোনো ধর্মীয় দল গড়তে মনোযোগ দিইনি তারা। ক্রমাগত বিভিন্ন সেক্যুলার দলকেই সমর্থন দিয়ে গেছে। কয়েক দশক তাদের ভোট গিয়েছে কাস্তে-হাতুড়ি মার্কায়; তারও আগে ‘হাতের তালু’ প্রতীকে। বামফ্রন্ট ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রতি অতীত সেই সমর্থন শূন্য হয়ে যায়নি এখনো। তবে সংখ্যালঘু ভোটের বড় অংশ গত দুই নির্বাচনে তৃণমূলের বাক্সে গেছে। এসব প্রবণতা থেকে স্পষ্ট, মুসলমান ভোটারদের পছন্দ প্রতিনিয়ত পাল্টায়। কিন্তু কেবল মুসলমান ভোটের ওপর ভরসাকারী ধর্মবাদী কোনো দলকে তারা বড় সংখ্যায় সমর্থন দিয়েছে এমন নজির নেই। এই ‘ঐতিহ্য’ মিমের সম্ভাবনা খাটো করে। অথচ পশ্চিমবঙ্গের ২৯৪ আসনের বিধানসভায় অন্তত ৮০-৯০ আসনে মুসলমানদের ভোট গুরুত্ববহ। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যেসব আসনে অমুসলমান ভোট ৯০ ভাগের বেশি, সেখানে বিজেপিকে ঠেকানো দুরূহ হয়ে উঠেছে। একই অভিজ্ঞতা জানাচ্ছে, তৃণমূল যদি গত নির্বাচনের মতো সংখ্যালঘুদের পুরো ভোট ধরে রাখতে না পারে, তাহলে তাদের বহু আসন বিজেপি দখল করে নেবে। কিন্তু মিম যদি পুরো রাজ্যজুড়ে প্রার্থী দেয় এবং ১০-২০ ভাগ মুসলমান ভোট কেটে নিতে শুরু করে, তাহলে তৃণমূল এবং বামফ্রন্ট-কংগ্রেস জোটের জন্য সর্বনাশ হতে পারে।
মহাসংকটে বিজেপিবিরোধী শিবির
মিমকে নিয়ে চলতি উত্তেজনা বিজেপির জন্য আনন্দদায়ক ও স্বস্তিকর। গত বছরের লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ৪০ আসনের ১৮টি পেয়ে তাদের আত্মবিশ্বাস এখন চাঙা। পূর্বের ২ থেকে আসনসংখ্যা ১৮ তে বাড়িয়েছিল তারা। এই ফল ছিল পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে ভূমিকম্পতুল্য। এবার পরিস্থিতি তাদের আরও অনুকূলে। কয়েক সপ্তাহ আগে শেষ হওয়া বিহারের নির্বাচনে অত্যন্ত ভালো করেছে বিজেপি। আপাতত পশ্চিমবঙ্গে তাদের প্রথম লক্ষ্য যথারীতি ভোটারদের ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করে ফেলা এবং দ্বিতীয় চাওয়া মিম নির্বাচন করুক।

ওয়াইসির জ্বালাময়ী ভাষণে তারা ভারতীয় মুসলমানদের বিক্ষত হৃদয়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। লোকসভা কিংবা জনসভা সর্বত্র বিভিন্ন দল মুসলমানদের পক্ষে কথা বলে হিসাব–নিকাশ কষে। ওয়াইসি এ ক্ষেত্রে সাহসী, ঝাঁজালো এবং উত্তেজক।

বিজেপি জানে পশ্চিমবঙ্গে তারা মুসলমানদের ভোট পাবে না। সুতরাং এই ভোট ভাগ হওয়া দরকার। মীমের প্রতি তাদের ইতিবাচক মনোভাব সেই হিসাব থেকে। এই দেখে কংগ্রেস প্রকাশ্যেই মিমকে ‘বিজেপির এজেন্ট’ বলছে। কিন্তু মিমের স্বাধীনভাবে যেকোনো রাজ্যে নির্বাচন করার অধিকার রয়েছে। বিহারের ফল বলছে তাদের প্রতি মুসলমান সম্প্রদায়ের সমর্থনও বাড়ছে। প্রশ্ন উঠেছে, তাদের এই অগ্রযাত্রায় যদি পশ্চিমবঙ্গেও বিজেপি জেতে, সেই দায় আসাদুদ্দীন ওয়াইসি নেবেন কি না?
বিজেপির আবির্ভাবের জন্য মধ্যপন্থী হিন্দুরাও মিম ও তার সমর্থক ভোটারদেরই দায়ী করবে তখন। যার মধ্য দিয়ে রাজ্যের রাজনীতিতে মুসলমানদের নতুন করে বন্ধুহীন অবস্থা তৈরি হতে পারে। কংগ্রেস ও বাম দলগুলোর মুসলমান নীতিও পাল্টে যেতে পারে। কিন্তু নগর কলকাতা থেকে দূরদূরান্তর প্রান্তিক মুসলমানদের কাছে মিমের জন্য পক্ষপাত তৈরি হচ্ছে ভেতরে-ভেতরে। ওয়াইসির জ্বালাময়ী ভাষণে তারা ভারতীয় মুসলমানদের বিক্ষত হৃদয়ের প্রতিধ্বনি শুনতে পায়। লোকসভা কিংবা জনসভা সর্বত্র বিভিন্ন দল মুসলমানদের পক্ষে কথা বলে হিসাব–নিকাশ কষে। ওয়াইসি এ ক্ষেত্রে সাহসী, ঝাঁজালো এবং উত্তেজক। আরএসএস পরিবারের হাতে ক্রমাগত সব উপায়ে কোণঠাসা মুসলমানরা ওয়াইসির কণ্ঠে শোনে তাদের সব হাহাকারের উল্লেখ। কেউ কেউ তাঁকে বলছে, ‘নকিব-এ-মিল্লাত’ (সম্প্রদায়ের ভবিষ্যৎ বাহক)।
কংগ্রেস, তৃণমূল এবং বামফ্রন্টের মুসলমানদের পক্ষে এ রকম অবস্থান নেওয়া কঠিন। তাতে হিন্দু ভোট হারানোর প্রবল ভয় আছে। তাহলে এদের সামনে বিকল্প কী আছে? একটা বিকল্প মিমকে জোটে নেওয়া। তাতেও চরম ঝুঁকি। ‘সাম্প্রদায়িক’ মিমকে সঙ্গী করা মানেই বিজেপিকে হিন্দু ভোট কাছে টানতে বড় প্রচার অস্ত্র ধরিয়ে দেওয়া। এই মুহূর্তে তাই মহাসংকটে আছে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপিবিরোধী শিবির।

আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক