পয়লা ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের দিক থেকে বড় ভয় ছিল, আবার না জানি তারা রাখাইন প্রদেশের বাদবাকি রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের দিকে ঠেলে দেয়। এই আশঙ্কায় বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিল। ঘটনাক্রমে এই লেখক তখন টেকনাফ হয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাচ্ছিলেন। পয়লা ফেব্রুয়ারি দুপুরেও সেন্ট মার্টিনের কাছে বাংলাদেশের নৌবাহিনীর কোনো জাহাজ দেখা না গেলেও ২ ফেব্রুয়ারিতে নৌবাহিনীর একটি যুদ্ধজাহাজ এবং কোস্টগার্ডের একটি গানবোট পাহারায় থাকতে দেখা যায়। টেকনাফের বাংলাদেশ সীমান্ত জেটিতেও বিশেষ পাহারা দেখা যায়। ভয় ছিল যে মিয়ানমারের সামরিক জান্তা বিক্ষুব্ধ জনতাকে ভাগ করতে আবার কি রোহিঙ্গা কার্ড খেলবে? আবার কি বাংলাদেশকে মিয়ানমারের সমস্যা খালাসের উঠান হতে হবে?
কিন্তু যা কেউ কেউ ভেবেছিলেন, বিষয়টা সেভাবে এখনো দৃশ্যমান হয়নি। বরং জানা যাচ্ছে অন্য কথা। সামরিক অভ্যুত্থানের পরপরই নতুন সামরিক শাসকেরা মিয়ানমারে অবস্থানরত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তাঁরা সামরিক অভ্যুত্থানের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে বলেন কীভাবে নভেম্বর ২০২০-এর নির্বাচনে সু চির দল এনএলডি বিপুল কারচুপি করেছে ইত্যাদি।
চিঠিটির সম্পূর্ণ বয়ান বাংলাদেশ পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশ করেনি। তবে রোহিঙ্গা সমস্যা সম্পর্কে সেখানে যা বলা হয়েছে, তাতে অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন। সাংবাদিকদের কাছে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ‘এসব ভালো খবর। এটা এক সুন্দর সূচনা’।
স্বেচ্ছায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে এ ধরনের সুন্দর অনেক সূচনাই অতীতে হয়েছে, যাদের পরিণতি অসুন্দর হয়েছে। কিন্তু এই দফায় চিঠির ভাষার বাইরেও আরও কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমারের সংবাদমাধ্যমে এসেছে যে রাখাইন প্রদেশের কয়েকজন সামরিক কমান্ডার সেখানকার মুসলিম-অধ্যুষিত এলাকা সফর করেছেন, আঞ্চলিক রাজধানী সিত্তেয় অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুতদের শিবিরে হাজির হয়েছেন।
বাংলাদেশের সংবাদ সংস্থা ইউএনবি ৫ ফেব্রুয়ারির এক সংবাদে জানায়, কমান্ডাররা স্থানীয় রোহিঙ্গা মুরব্বিদের সঙ্গে দেখা করেন এবং সেখানকার মসজিদ সংস্কারে ৩৫০ ডলার ও খাদ্য দান করেন। রাখাইনের অন্য প্রধান শহর মংডোতেও সামরিক কর্তাদের সফরের সংবাদ এসেছে। এসব কমান্ডার বলার চেষ্টা করছেন যে সেনাবাহিনী নয়, সু চিই রোহিঙ্গাদের বিতাড়ন করেছেন। এই খবরও এসেছে যে অনেক রোহিঙ্গাই সু চির পতনের খবর শুনে উল্লসিত হয়েছেন। কিন্তু অভিজ্ঞরা ভালো করেই জানেন যে রাখাইনে রোহিঙ্গা বিদ্বেষে সেনাবাহিনী ও সু চির রাজনৈতিক দল এনএলডি দুজন দুজনার। সরকারপ্রধান হিসেবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে মানবতাবিরোধী অপরাধ করা হয়েছে, তার দায় সু চি এড়াতে পারবেন না। কিন্তু বাস্তবে রাখাইনে গণহত্যা ও পোড়ামাটি নীতির কারিগর দেশটির সেনাবাহিনী। স্বরাষ্ট্র ও সামরিক উভয় মন্ত্রণালয়ই তাদের হাতে।
তাহলে কেন তারা সু চির ওপর দায় চাপিয়ে নিজেদের রোহিঙ্গাদের বন্ধু প্রমাণ করতে চাইছে? কেন বাংলাদেশের কাছে চিঠি পাঠিয়ে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের উদ্যোগী হবে বলে ভরসা দিচ্ছে? তাদের এই কৌশলে রোহিঙ্গাদের ভোলার কথা নয়। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এই মুখোশের প্রদর্শনী মিয়ানমারের বিক্ষুব্ধ জনতার উদ্দেশেও নয়। রাখাইনে তাদের সেনাবাহিনীর আগ্রাসী ভূমিকার সবচেয়ে বড় সাক্ষী তো তাদের দেশেরই মানুষ। বাংলাদেশিদেরও ভূতের মুখে রামনাম শুনে বিভ্রান্ত হওয়ার কথা নয়।
তবে বিভ্রান্ত হওয়ার অন্য মানুষও আছে।
বাংলাদেশ দূতাবাসে চিঠি পাঠানোতেই তারা থামেনি, রাখাইনে শরণার্থীশিবিরে সামরিক কর্তারা আশার বাণী শোনাতেও গেছেন। তার চেয়ে বড় যা তা হলো মিয়ানমারের সামরিক শাসক মিন হ্লাইংয়ের ভাষণ। সেখানে তিনি ‘বাংলাদেশে অভিবাসী’ হওয়াদের ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন। বাংলাদেশ গত বছর মিয়ানমারের কাছে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের জন্য ৮ লাখ ৮৪ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকা দিয়েছিল। মিয়ানমার জবাবে যাচাই করেছে মাত্র ৪২ হাজার জনকে। কিন্তু এসবের নামে মিয়ানমার যথেষ্ট সময়ক্ষেপণের মওকা বানিয়ে নিয়েছিল।
এটা এক দ্বিমুখী টোপ। বৈধতার সংকটে থাকা সামরিক শাসকেরা কি তাহলে জাতিসংঘসহ পাশ্চাত্যের কাছে দেখাতে চাইছে যে অবৈধ ক্ষমতাধর হলেও তাদেরও একটি মানবিক মুখ রয়েছে। পাশ্চাত্য যদি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চায়, তাহলে মিয়ানমারের সেনাশাসকদেরই সেই সমাধানের অংশীদার করতে হবে। অন্যদিকে সত্যি সমাধানের কোনো প্রক্রিয়া শুরু হলে বাংলাদেশও হবে তার উৎসাহী পক্ষ। কাজে কাজেই মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের কণ্ঠ থাকবে ‘বন্ধুতামূলক’। যতটা বন্ধুতা হলে মিয়ানমারের কাছ থেকে চাল কেনা যায়। এভাবে বাংলাদেশকে নিরস্ত করে বুঝিয়ে রাখা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা কার্ড দেখিয়ে নমনীয় করার মাধ্যমে সামরিক জান্তা কি তাদের ক্ষমতা দখলের স্বীকৃতি চায়? তারা কি বোঝাতে চায় যে তারা না থাকলে এই সমস্যার সমাধান হবে না?
অন্যদিকে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে যেসব বর্মি আন্দোলন করছে, তারা রোহিঙ্গাদের প্রতি সেনাবাহিনীর পরিবর্তিত অবস্থানের বিরুদ্ধেই থাকবে। তখন সামরিক জান্তা কৌশলে দেখাতে পারবে মিয়ানমারের গণতন্ত্রকামী সু চিপন্থীরা রোহিঙ্গাবিদ্বেষী বর্ণবাদী। স্বাভাবিকভাবে বর্ণবাদে তাতিয়ে তোলা বর্মি জনতা আগের মতোই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিপক্ষে থাকবে, অন্ততপক্ষে জনমত ভাগ হয়ে যাবে। এভাবেও মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাতমাদৌ বিশ্ব মানবতাকে দেখাতে পারবে যে গণতন্ত্রপন্থীরা আসলে ভয়ংকর বর্ণবাদী।
অতীতে রোহিঙ্গাদের তাড়িয়ে মিয়ানমারের সেনাশাসকেরা জনপ্রিয় হয়েছিলেন। এখন আবার রোহিঙ্গা কার্ড খেলে মানবতাবাদী সাজছেন, বৈশ্বিক চাপের মুখে বাংলাদেশকে পাশে পেতে চাইছেন। মিয়ানমারের আশ্বাসে অতীতে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলার বাদী হতে রাজি হয়নি। এবারও বাংলাদেশ যদি কোনো ছাড় দেয়, তা যেন হয় বাস্তব ইতিবাচক পদক্ষেপের বিপরীতে। আশার ছলনে ভুলবার সুযোগ আমাদের আর নেই। আমরা নিশ্চয়ই মনে রাখব, অভ্যুত্থানকারী সামরিক জান্তার সঙ্গে দর-কষাকষিতে বাংলাদেশ এখন সুবিধাজনক জায়গায় আছে।
তৃতীয় একটি সম্ভাবনার কথাও ভাবা দরকার। সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোট আরও সক্রিয় হতে পারে। এদের মধ্যে রাখাইন প্রদেশের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী আরাকান আর্মিও রয়েছে। রোহিঙ্গাদের কিছু অংশকে কাছে টেনে তাদের আরাকান আর্মির বিপক্ষে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার খেলাও চলতে পারে। বাংলাদেশের জন্য সেটাও সুফলদায়ক হওয়ার কথা নয়।
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক
rotnopahar@gmail.com