মিয়ানমারে তিন মাস ধরে চলা গণবিক্ষোভ ছিল রাজনৈতিক। দিনে দিনে তা সামরিক গৃহযুদ্ধের চেহারা নিচ্ছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী তাৎমাদৌ নিজ দেশের বিক্ষোভকারীদের প্রতি তা-ই করেছে, যা করা হয় রণাঙ্গনে শত্রু সৈন্যদের প্রতি। এই সময়ে নিহত হয়েছেন সাড়ে সাত শর মতো বিক্ষোভকারী। হত্যার জন্য গুলি; সরাসরি মাথায় গুলির নির্দেশ দেওয়া হয় তাঁদের প্রতি, যাঁরা নাকি একই দেশের নাগরিক। গণতন্ত্রকামী বন্দীরা যুদ্ধবন্দীদের মতো আচরণ পেয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের লাশ নিতেও টাকা দিতে হয়েছে পরিবারকে।
কিন্তু গত এক মাসে বিক্ষোভ সশস্ত্র চেহারা নিচ্ছে। মিছিল কমে আসছে, বাড়ছে বোমা বিস্ফোরণ। সাবেক রাজধানী ইয়াঙ্গুনে ঘন ঘনই ঘটছে এ ধরনের বোমার বিস্ফোরণ। ওদিকে মিয়ানমারের ১০টি বিদ্রোহী গোষ্ঠী সু চির সময়ে করা শান্তিচুক্তির বাইরে এসে স্বৈরশাসকদের উচ্ছেদের ডাক দিয়েছে।
কারেন জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহী বাহিনী মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর হামলাও বাড়াচ্ছে। কারেনের পর কিছুদিন আগেও শান্তিপূর্ণ চিন প্রদেশেও চিন জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহীরা সেনাবাহিনীর একটি ঘাঁটি দখল করেছে। প্রতিটি ঘটনায় নিহত সেনার সংখ্যাও কম ছিল না। সেনাবাহিনীও স্থল ও বিমান হামলা বাড়াচ্ছে।
গত সপ্তাহে জাতিসংঘের মিয়ানমার-বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি নিরাপত্তা পরিষদকে আশু গৃহযুদ্ধ ও ‘রক্তস্নানের’ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। যুদ্ধের গন্ধ পেয়ে ভারতের আদানি গ্রুপ মিয়ানমারে একটি কনটেইনার পোর্ট ও বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার প্রকল্প থেকে সরে আসার ইঙ্গিত দিয়েছে; যদি তা যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে।
লন্ডনে অনুষ্ঠিত জি-৭ বৈঠকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীও অস্ত্র ক্রয়ে নিষেধাজ্ঞা ও মানবিক হস্তক্ষেপের কথা জোরেশোরে বলেছেন। জি-৭-এর বিবৃতিতে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সামগ্রিক অবরোধ আরোপের আহ্বানও জানানো হয়।
এই মানবিক হস্তক্ষেপের আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত পরিভাষা হলো, আরপি২ বা রাইট টু প্রটেক্ট। অন্য কোনো দেশের জনসাধারণকে রক্ষায় যে সামরিক হস্তক্ষেপ করা হয়, তা আরপি-২-এর মাধ্যমে বৈধ করা হয়। ঠিক যেমনটা করা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সময় বলকান যুদ্ধে। ইরাক ও আফগানিস্তান আক্রমণেও এই যুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল সিরিয়ার বেলাতেও। দুনিয়ার ২০০টি বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি মিয়ানমারে সরাসরি জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করে বিবৃতি দিয়েছেন।
ঘটনাবলি সিরিয়ার মতো করেই এগোচ্ছে। ২০১১ সালে সিরিয়াতেও ‘আরব বসন্ত’ গণবিক্ষোভ দিয়ে শুরু হয়ে গৃহযুদ্ধের দিকে গড়ায়। সেই বিক্ষোভকে নৃশংসভাবে দমন করার পর শুরু হয় বিদ্রোহীদের সশস্ত্র অভিযান। পরিণতিতে দেশটা হয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র-ব্রিটেন-ফ্রান্স বনাম রাশিয়া-ইরান বনাম তুরস্কের ত্রিপক্ষীয় ভূরাজনীতির লীলাক্ষেত্র।
মিয়ানমারে গত ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া বিক্ষোভ মাত্র তিন মাসের মধ্যে সশস্ত্র রূপ নিতে থাকা সিরিয়ার পথপরিক্রমাকেই নির্দেশ করে। সিরিয়ায় আসাদ সরকারের পেছনে ছিল রাশিয়া ও ইরান, মিয়ানমারে সামরিক জান্তার পক্ষে চীন একাই যথেষ্ট।
জি-৭ বৈঠকে মিয়ানমারের জান্তাবিরোধী জাতীয় ঐক্যের সরকারকে একরকম স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। সেনাবিরোধী আন্দোলনকারীদের এই সরকার ঘোষণা দিয়েছে, তারা একটি ফেডারেল ইউনিয়ন আর্মি গঠন করবে। একদিকে বিদ্রোহীরা মিয়ানমারের কেন্দ্রীয় সেনাবাহিনী ও অন্যান্য প্রতিরক্ষা বাহিনীতে কাজ করা স্ব স্ব জাতির সদস্যদের জান্তার দিকে বন্দুক ঘুরিয়ে দিতে আহ্বান জানাচ্ছে, অন্যদিকে শহুরে গণ-অভ্যুত্থানে মার খাওয়া বিক্ষোভকারী বর্মী তরুণেরা যোগ দিচ্ছেন বিদ্রোহী দলে। সব মিলিয়ে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি ১৪ আনাই পাকা।
মিয়ানমারে সেনা নেতৃত্বে জাতিগঠন প্রকল্প ব্যর্থ হয়েছে। দেশকে এক করার বদলে তারা বরং আরও বিভক্ত করছে। উল্টোদিকে সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বিদ্রোহীরা তৈরি করছে এক বর্ণিল ঐক্য। বর্মী ও বৌদ্ধরা সেখানে অপর জাতি ও ধর্মের মানুষকে প্রান্তিক করে রেখেছিল।
এই প্রথম আরাকানের রোহিঙ্গা মুসলিম ও রাখাইন বৌদ্ধ, কারেন ও শিন প্রদেশের খ্রিষ্টানদের সঙ্গে বড় জাতির বর্মী বৌদ্ধদের সংহতি গড়ে উঠছে। গড়ে উঠেছে আরাকান আর্মি, কাচিন ইনডিপেনডেন্স আর্মি, তা’য়াঙ ন্যাশনাল লিবারেশন আর্মি এবং মিয়ানমার ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স আর্মির সামরিক জোট নর্দার্ন অ্যালায়েন্স।
তবে সিরিয়ার মতো এখনো প্রতিবেশী দেশগুলো সরাসরি মিয়ানমারের সংঘাতে জড়ায়নি। ভারত চীন ও রাশিয়াকে জান্তার বিরুদ্ধে কথা বলায় রাজি করাতে পারেনি। মিয়ানমারের সঙ্গে তাদের রয়েছে দীর্ঘ কাঁটাতারহীন সীমান্ত। দুই দেশের সীমান্তের দুই পারেই রয়েছে একই জাতির মানুষ। একই কথা থাইল্যান্ডের বেলাতেও প্রযোজ্য। এ দুটি দেশেই মিয়ানমারের শরণার্থীরা পালাচ্ছে, যেমন রোহিঙ্গারা এসেছিল বাংলাদেশে।
এশিয়া টাইমস-এ নিরাপত্তা বিশ্লেষক কে ভদ্রকুমার লিখেছেন, ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই৬ ও সিআইএ বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে পরিস্থিতির সুযোগ নিতে উসকানি দিচ্ছে। এটা করতে হলে তাদের ভারত ও থাইল্যান্ডের সহযোগিতা দরকার হবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধে থাইল্যান্ডই ছিল যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিতীয় নিকটতম কেন্দ্র। কিন্তু থাইল্যান্ড এখন চীনের বন্ধু। ভারতের পক্ষে একা কিছু করা সম্ভব না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও ভারত মিলে গঠিত ‘কোয়াড’-এর তৎপরতা অনেকটাই দৃশ্যমান।
যদি মিয়ানমারের জাতীয় ঐক্য সরকারকে ‘প্রবাসী সরকার’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, তাহলেই বোঝা যাবে যে গৃহযুদ্ধ বেগবান করায় পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো সক্রিয় হয়েছে। যেকোনো মানবিক মানুষের জন্যই এটা এক উভয়সংকট। সামরিক জান্তাকে এখনই থামানো না গেলে আরও বড় আকারের যুদ্ধ ও অশান্তি ঠেকানো অসম্ভব হয়ে উঠবে। আবার পশ্চিমা হস্তক্ষেপ মানে মিয়ানমারের ভূমিতে চীনের বিরুদ্ধে ছায়াযুদ্ধের সূচনা। সেই ছায়াযুদ্ধ যে সেখানেই সীমিত থাকবে বা শিগগির কোনো পক্ষ যে বিজয়ী হবে, তা বলা কঠিন। বিদেশি হস্তক্ষেপ বরং বর্মীদের একটা অংশকে ‘দেশপ্রেমের’ আবেগে সেনাপন্থী শিবিরে ঠেলে দিতে পারে। যেমনটা হয়েছিল সিরিয়ায়। বাংলাদেশের জন্য আশঙ্কার বিষয় এখানেই, দেশটার এক সীমান্তে দীর্ঘমেয়াদি গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠেছে। এটা দাবানলে পরিণত হলে দীর্ঘদিন ধরে তার উত্তাপ আমাদের গায়ে এসেও লাগবে।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক।
faruk.wasif@prothomalo.com