২০১৭ সালের ২২ জানুয়ারি মার্কিন নেটওয়ার্ক টেলিভিশন এনবিসির কল্যাণে সারা পৃথিবীর মানুষ একটি নতুন ধারণার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল, ‘অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস’, আক্ষরিক বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়াবে ‘বিকল্প তথ্য’। সহজভাবে দেখলে এটি এমন কোনো বড় ব্যাপার মনে হবে না। কিন্তু এ ধারণা ও টার্মটির পটভূমি এবং উদ্দেশ্য অনুসন্ধান করলেই বোঝা যাবে, এটির মর্মার্থ কী এবং কেন এটি রাজনীতির এক ভয়াবহ প্রবণতার উদাহরণ।
এই টার্মটি ব্যবহার করেছিলেন সদ্য শপথ নেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উপদেষ্টা কেলিয়ান কনওয়ে, এনবিসির ‘মিট দ্য প্রেস’ নামের সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠানে। বিষয় ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিতি নিয়ে। ট্রাম্পের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিতি আগের প্রেসিডেন্টদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের চেয়ে কম হলেও এবং তা সব ছবিতে দৃশ্যমান হলেও হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসার ২১ জানুয়ারি সাংবাদিকদের বলেন, উপস্থিতি ছিল ঐতিহাসিক এবং আগের চেয়ে অনেক অনেক বেশি। মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানের উপস্থাপক চাক টডের প্রশ্নের উত্তরে কেলিয়ান কনওয়ে বলেন, শন স্পাইসার আসলে যা বলছিলেন তা হচ্ছে, অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস।
এ নিয়ে বিতর্কের ঝড় উঠলে ওয়াশিংটন পোস্ট-এর সাংবাদিক ক্যারেন টুমাল্টি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, এ কথাটি আসলে জর্জ অরওয়েলের বিখ্যাত উপন্যাস ১৯৮৪-এর আদলে তৈরি। যাঁরা ১৯৮৪ পড়েছেন, তাঁরা জানেন যে অরওয়েলের সেই উপন্যাসে ক্ষমতাসীনেরা ঘোষণা করেছিল, ‘যুদ্ধ হচ্ছে শান্তি—মুক্তি হচ্ছে দাসত্ব—অজ্ঞতা হচ্ছে শক্তি।’ জর্জ অরওয়েলের ১৯৮৪ উপন্যাস হচ্ছে একনায়কের অধীন এক দেশের জীবনযাপনের কাহিনি, যেখানে ওই একনায়ক শাসকের বিরুদ্ধে ভাবাও হচ্ছে অপরাধ, যাকে বলা হয় থটক্রাইম। সেখানে চাউর করা হয় নতুন ভাষা, যাতে কোনো নেতিবাচক শব্দ নেই। মানুষ গুম হয় এবং এ বিষয়ে সব তথ্য গায়েব করে দেওয়ার দায়িত্বে আছে ‘মিনিস্ট্রি অব ট্রুথ’। পুলিশ বাহিনীর দায়িত্ব হচ্ছে, ‘মিনিস্ট্রি অব লাভ’-এর ওপরে। এককথায় বাস্তবতার উল্টো দিকে হচ্ছে সরকারের ভাষ্য।
কেলিয়ান কনওয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের সময়েই এনবিসির চাক টড বলেছিলেন, ‘অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস সত্য নয়, এটা মিথ্যাচার।’ পৃথিবীর বিখ্যাত অভিধান মেরিয়াম-ওয়েবস্টারের পক্ষ থেকে টুইট করে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে ফ্যাক্ট বাস্তবতার বা অবজেক্টিভ রিয়েলিটির সঙ্গে সম্পর্কিত। কেলিয়ান কনওয়ে, ট্রাম্প এবং তাঁর সহযোগীরা এ নিয়ে যত ব্যাখ্যাই দেন না কেন, এটা স্পষ্ট যে আসলে অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস হচ্ছে মিথ্যা কথা, ডাহা মিথ্যা কথা; কেউ কেউ একে বলেন, মতিভ্রম। কিন্তু এতে করে এর রাজনৈতিক দিকটা স্পষ্ট হয় না। অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস কেবল মিথ্যাচার নয়, এ হচ্ছে একটি রাজনৈতিক কৌশল। অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস বা তার যেকোনো ধরনের রূপ হচ্ছে কর্তৃত্ববাদীদের একটা বড় হাতিয়ার।
অনেকেই বলবেন যে রাজনীতিতে মিথ্যাচার কোনো নতুন বিষয় নয়; তা হলে এই অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস নতুন কী উপহার দিচ্ছে? যেকোনো মিথ্যাচারের সঙ্গে এর পার্থক্য হচ্ছে এই যে অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস হচ্ছে ক্ষমতার প্রকাশ; ক্ষমতাসীনেরা দেখান যে তাঁরা চাইলে এবং তাঁদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হলে তাঁরা সত্যকে মিথ্যায় পরিণত করবেন। অলটারনেটিভ ফ্যাক্টসের লক্ষ্য হচ্ছে যা সত্য, যা সহজেই দৃষ্ট, যা বাস্তবতা তাকে অস্বীকার করে তার পরিবর্তে একটি মিথ্যাকে গ্রহণযোগ্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করা। সেই গ্রহণযোগ্যতা তৈরির জন্য যা সহজেই করা হয়, তা হচ্ছে ক্ষমতার প্রয়োগ। সরকার ও তার অনুগতরা ‘আসলে এই ঘটেছে’ বলে একটা মিথ্যাচারকে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়। এ ক্ষেত্রে অনুগত গণমাধ্যম শুধু নয়, এমনকি যে মাধ্যমগুলো এ ধরনের মিথ্যাচারকে ডাহা মিথ্যা বলে চিহ্নিত করে না, তারাও এ কাজে জেনে অথবা না জেনে শামিল হয়।
আজকের দিনে ক্ষমতার এ ধরনের প্রকাশের আরেকটি সংশ্লিষ্ট দিক হচ্ছে ‘পোস্ট-ট্রুথ’। ‘পোস্ট-ট্রুথ এরা’কে যাঁরা বাংলায় ‘সত্য-উত্তর যুগ’ বলে বর্ণনা করেন, তাঁদের এই আক্ষরিক অনুবাদের সঙ্গে আমার ভিন্নমতের কারণ হচ্ছে, এতে করে একে ‘উত্তর-আধুনিক’ ধারণার মতোই মনে হয়। কিন্তু বাস্তবে পোস্ট-ট্রুথ হচ্ছে, প্রকৃত সত্যকে অস্বীকার করে আবেগ এবং বিশ্বাসের বশীভূত হওয়া। ২০১৬ সালে এই টার্মটি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হলেও এ ধারণার সূচনা করেন ১৯৯২ সালে স্টিভ টাসিক এবং এ নামে ২০০৪ সালেই প্রকাশিত হয় র্যালফ কিসের গ্রন্থ।
সহজ ভাষায় পোস্ট-ট্রুথ হচ্ছে এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে মানুষ আসল ঘটনা বা সত্যের বদলে তাদের আবেগ ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে কোনো একটি যুক্তিকে গ্রহণ করে নেয়। তার অর্থ হচ্ছে, এখানে ভাবাদর্শ বা আইডিওলজি সত্যকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে। এ বিষয়ে লি ম্যাকেন্টায়ারের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। আকারে ক্ষীণ এ বইটির সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে যে তাতে দেখানো হয়েছে পোস্ট-ট্রুথের সঙ্গে ভাবাদর্শ বা আইডিওলজির যোগাযোগ কোথায়। ম্যাকেন টায়ার দেখান যে পোস্ট-ট্রুথ হচ্ছে একধরনের আদর্শের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা, যা দিয়ে এর প্রচারকেরা অন্যদের এটা বিশ্বাস করতে বাধ্য করতে চান, যার বিপরীতে যথেষ্ট সাক্ষ্য রয়েছে।
অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস এবং পোস্ট-ট্রুথের পক্ষে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ বা সাংবাদিকেরা সরব না হলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজে এ প্রবণতা এখন ক্রমেই প্রকাশ্য হয়ে উঠছে। এ বছর দুটি আন্দোলনের সময়ে আমরা তার অনেক উদাহরণ লক্ষ করেছি। কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময়ে এ আন্দোলনের ব্যাপারে কোনো কোনো গণমাধ্যমের দেওয়া তথ্যই শুধু তার প্রমাণ নয়, কোনো কোনো গণমাধ্যম এসব আন্দোলনকে কীভাবে চিহ্নিত করেছে, তাতেও সেই অলটারনেটিভ ফ্যাক্টসের ধারণা স্পষ্ট; যেমন কোটা ‘সংস্কার’ আন্দোলনকে কোটা ‘বাতিলের’ দাবি বলার মধ্যেই এই প্রবণতা স্পষ্ট; কিংবা নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের সময় সাংবাদিকদের ওপর হামলাকারীদের পরিচয় দেওয়ার প্রশ্নে অবস্থান প্রমাণ করে যে আদর্শিক অবস্থান থেকেই তা বিবেচিত হয়েছে। এখন আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তা রাষ্ট্রীয় বা সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে।
গত শনিবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নুরুল হুদা যখন দাবি করেন যে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত হয়েছে এবং বলেন, যেসব প্রার্থী প্রচার চালাতে পারছেন, প্রচারে বাধা নেই—তখন তিনি আসলে অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস তৈরি করেন। এ কথাগুলো গণমাধ্যমে বড় করেই প্রচার করা হয়েছে। তাঁর অবস্থানের কারণে যদিও গণমাধ্যমের সূত্রেই আমরা জানি, কমপক্ষে ১২ জন প্রার্থী আটক হয়েছেন। শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ১২ জন প্রার্থীর প্রচারণার সময় হামলা হয়েছে। এসব ঘটনাকে অস্বীকার করার পেছনে কেবল সবকিছু ঠিক আছে প্রচার করাই উদ্দেশ্য নয়, এমন একধরনের আবহ তৈরি করা, যেখানে ‘ফ্যাক্টস’-এর বিপরীতে ‘অলটারনেটিভ ফ্যাক্টস’ দাঁড় করানো যায়। ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে তাকে সত্য বলে হাজির করা যাবে।
এ ঘটনার পাশাপাশি এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের পোস্ট-ট্রুথের বিষয়ে উৎসাহী করে তোলে। তা হচ্ছে, সাংবাদিকদের এক বিশাল অংশ আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা করা মিডিয়া উপকমিটির সদস্য হওয়া। বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা তাঁদের পেশাগত জীবনে বিভিন্ন দলে বিভক্ত। সেটা সাংবাদিক ইউনিয়নে বিভক্তির মধ্যেই দেখা যায়। কিন্তু এই নির্বাচনে তাঁরা যখন একটি দলের আদর্শের প্রচারের দায়িত্ব নিচ্ছেন, একটি আদর্শের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজে নিয়োজিত হচ্ছেন, তখন তাঁদের কাছে আবেগ ও বিশ্বাসের ওপর নির্ভর করে একটি যুক্তিকে গ্রহণ না করার কী কারণ থাকতে পারে? যদি তাঁরা তা না করেন, তবে তা হবে কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনে অবহেলা।
যদি সেটাই হয় তাঁদের অবস্থান, তবে তা হবে পোস্ট-ট্রুথের প্রচার।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর