উন্নয়ন ও গণতন্ত্র

মাহাথির মডেল এবং উন্নয়নের গণতন্ত্র

স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক সভায় বলেছেন, ‘আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তবে বেশি গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। মালয়েশিয়ায় মাহাথির মোহাম্মদ যে পথে এগিয়ে গেছেন, বাংলাদেশে শেখ হাসিনাও সে পথে এগিয়ে যাচ্ছেন। এই গণতন্ত্র আমরা মেনে চলব।’
বেশ কিছুদিন ধরেই দেশে এই নতুন সুর শোনা যাচ্ছে। সেটার মূল বক্তব্য হলো যে আরে ভাই গণতন্ত্র-টনতন্ত্র দিয়ে কী হবে? উন্নয়ন হলো আসল কথা। আমাদের পূর্ব এশিয়ান বাঘের বাচ্চারা আছে না। ওদের কি কস্মিনকালে গণতন্ত্র ছিল? সেই মডেলে চালাতে গেলে সেই রকম একজন মাহাথিরও তো দরকার আছে। পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য নেতার বদলে মাহাথিরকে নিয়ে আমাদের দেশে কেন এত লাফালাফি, সেটার কারণ মনে হয় পূর্ব এশিয়ান বাঘদের মধ্যে একমাত্র মুসলিম নেতা বলে।
এটা ঠিক যে নব্বইয়ের দশক থেকে আমাদের গণতন্ত্রের পথে অভিযাত্রা কখনোই সুখকর ছিল না। আমাদের নির্বাচন মোটামুটি মুক্ত ও নিরপেক্ষ ছিল, কিন্তু সেটা ছিল তথাকথিত এক দিনের গণতন্ত্র। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং চর্চা অভ্যন্তরীণ দলীয় কাঠামো বা দেশ পরিচালনায় কখনোই ছিল না।
সব রাজনৈতিক নেতৃত্বই চেয়েছে নির্বাচিত হয়ে একনায়কের মতোই দেশ চালাতে। নব্বইয়ের পর থেকে আমরা লক্ষ করি যে একের পর এক পর্যায়ক্রমিক নির্বাচিত সরকার কীভাবে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে চলেছে। যার পরিণতি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামো এখন মোটামুটি ধূলিসাৎ।
কিন্তু গণতন্ত্র উপেক্ষা করে বাংলাদেশ চটজলদি মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে—এ রকম স্বপ্ন দেখানোটাও কতটুকু বাস্তবসম্মত, সেটাও চিন্তার বিষয়। পূর্ব এশিয়ার ইতিহাস, সভ্যতা ও সংস্কৃতি দক্ষিণ এশিয়ার থেকে অনেক ক্ষেত্রেই অন্য রকম। এ ছাড়া যারা বাংলাদেশে এই মডেলের প্রবক্তা, তারা একটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা ভুলে যায়, সেটা হলো যে পূর্ব এশিয়ার এই সব দেশে হয়তো নির্বাচনমুখী, বহুদলীয় গণতন্ত্র ছিল না। কিন্তু সেই সব দেশে আইনের শাসন, ব্যক্তির অর্থনৈতিক স্বাধীনতা এবং সম্পদের সুরক্ষা—সবই নিশ্চিত করা হয়েছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো ছাড়া এই সব নির্বাচনমুখী গণতন্ত্র অর্থহীন এবং মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের উদাহরণ টানাটাও অনেকখানিই অবাস্তব।
ফরিদ জাকারিয়া ১৯৯৬ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্স-এ প্রকাশিত প্রবন্ধে বলেছেন যে একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিচার করতে হবে সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার দৃষ্টিকোণ থেকে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতা না থাকলে শুধু নির্বাচন দিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না। কোনো সরকার যদি সীমিত গণতন্ত্রের মধ্যে আস্তে আস্তে এই সব স্বাধীনতা বাড়ায়, তাহলে এগুলোকে একনায়কতন্ত্র বলা যাবে না। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে তা-ই হয়েছে এবং সেখানকার লোকজন জীবন অনেক শান্তি, সমৃদ্ধি ও স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে কাটিয়েছে ইরাক, লিবিয়া, কিংবা স্লোভাকিয়া অথবা ঘানার একনায়কতন্ত্রের চেয়ে।
সাংবিধানিক উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থার ভিত্তি ছাড়া গণতন্ত্র আসলে একটা কাগুজে গণতন্ত্রই রয়ে যায়। সেখানে সুশাসনের অভাব, উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতিগত দাঙ্গা, এমনকি যুদ্ধ লাগারও ঘটনা রয়েছে। সমাজতন্ত্রের পতন ঘটার পরপরই সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুগোস্লাভিয়াতে যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাতে জাতীয়তাবাদী বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ক্ষমতায় চলে আসে এবং দেশ ভেঙে যায়। দ্রুত ভেঙে যাওয়া এই সব দেশে সংখ্যালঘুদের অধিকার ও প্রাতিষ্ঠানিক নিরাপত্তা নিশ্চিত না থাকায় সেখানে অবর্ণনীয় বিশৃঙ্খলা, নারকীয় অত্যাচার সংঘটিত হয়। অধুনা বিশ্বে আরব বসন্তের ফলে যেসব সরকার নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে, সেখানে এই রকম সাংবিধানিক শাসনকাঠামোর অভাবের কারণে তারাও জনগণের কল্যাণ বয়ে আনতে পারেনি।
এটা একটু অদ্ভুত যে বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনমুখী গণতন্ত্রের এত প্রচার করে। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক শাসনব্যবস্থার একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটা কতটা গণতান্ত্রিক সেটা নয়, বরং এটা কতটা অগণতান্ত্রিক। এখানে অনেক রকম সীমাবদ্ধতা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে নির্বাচিত গরিষ্ঠের ওপর। এই দেশের সংবিধান যেটি আধুনিক বিশ্বে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়, সেটির পেছনে মূল দর্শন হলো রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে কোনোভাবেই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে পারবে না। ক্ষমতাশালী মানুষকে বিশ্বাস করা যায় না—এই আশঙ্কার ওপর ভিত্তি করেই মূলত এই সংবিধান রচিত।
এখন এমন একটা যুগ চলছে, যেখানে দৃশ্যমান চিত্তাকর্ষক কোনো কিছু দেখানো না গেলে সেটির আবেদন তৈরি হয় না। সেদিক থেকে নির্বাচনের খুব দৃশ্যমান একটা প্রতিক্রিয়া আছে। এটা দেখানো যায় যে নির্বাচনের আয়োজন হচ্ছে, মুক্ত ও স্বচ্ছ নির্বাচন হচ্ছে, কিন্তু সংবিধান বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে কি না, সেটা আসলে দৃশ্যমান নয়। তাই গণতন্ত্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আইনের শাসনের বিষয়টি নির্বাচনের ডামাডোলের মধ্যে চাপা পড়ে যায়।
আমরা এখন গণতন্ত্রের যুগে বসবাস করছি, বিশ্বের চারদিকে গণতন্ত্রের জয়জয়কার। গণতন্ত্রের বিজয় উৎসবে একবিংশ শতাব্দীতে এখন যে সমস্যা, সেটা হলো গণতন্ত্রের ভেতরে সমস্যা, নির্বাচনমুখী গণতন্ত্রের সঙ্গে একনায়কতন্ত্রের আমদানি। এই সমস্যার সঙ্গে মোকাবিলা করা অনেক কঠিন, কারণ নির্বাচিত রাজনৈতিক ব্যবস্থা বলে এর একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে।
এই ধরনের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় হুমকি হলো যে এটা সত্যিকারের গণতন্ত্রকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলে। আর তার ফলে যেটা হয়, মানুষ তখন বলা শুরু করে যে গণতন্ত্র আসলে কাজ করছে না, অন্য কিছু দরকার। তখন একনায়কতন্ত্রের পক্ষে সাফাই গাওয়া শুরু হয়। গণতন্ত্রে এই সমস্যা নতুন কিছু না, বিভিন্ন সময়ে যখনই গণতন্ত্রের ঢেউ উঠেছে, তখনই দেখা গেছে যে এর মধ্যে কোনো না কোনো সমস্যা বিদ্যমান। যার ফলে উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক নেতৃত্ব আর অশান্ত জনতা সব সময় বিকল্প খুঁজেছে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ দুই বিশ্বযুদ্ধের মধ্যের সময়টা। এই সময়ে যেসব হিটলার টাইপের একনায়ক এসেছে, তারা খুবই জনপ্রিয় ছিল এবং কেউ কেউ নির্বাচিত ছিল। সেই সব হিটলারি একনায়কতন্ত্রের ফলাফল কী হয়েছে, তা তো সবারই জানা।
সাংবিধানিক শাসন ছাড়া গণতন্ত্র খুবই ভয়ংকর জিনিস, সেটা আমরা বাংলাদেশিরাও হাড়ে হাড়ে জেনে ফেলেছি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে গণতন্ত্র ছুড়ে ফেলে এখন পূর্ব এশিয়ার মডেলের দিকে ছুটতে হবে। সবার আগে সংবিধান এবং আইনের কাঠামোর মধ্যে একজন নাগরিকের যেসব মৌলিক অধিকার রয়েছে, সেগুলো নিশ্চিত করতে হবে। কারণ, উদারনৈতিক সংবিধানকেন্দ্রিক আইনের শাসন ছাড়া গণতন্ত্র বলেন আর মাহাথির স্টাইল একনায়কতন্ত্র বলেন, সবই নিপীড়নমূলক স্বৈরশাসকে পরিণত হয়।
মাহাথির মোহাম্মদ এ কথা ভালোভাবে জানতেন বলেই সে পথে হাঁটেননি। কিন্তু মোহাম্মদ নাসিম বা তাঁর ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক নেতৃত্বও কি বিষয়টি জানেন? দুঃখের বিষয়, আপাতদৃষ্টিতে সেই রকম কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না!
ড. রুশাদ ফরিদী: শিক্ষক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
rushad.16@gmail.com