আমারে যেদিন তুমি ডাক দিলা তোমার ভাষায়
মনে হইল এ কোন পাখির দ্যাশে গিয়া পড়লাম,
এ কোন নদীর বুকে এতগুলো নায়ের বাদাম,
এত যে অচিন বৃক্ষ এতদিন আছিল কোথায়?
— আমারে যেদিন তুমি, সৈয়দ শামসুল হক।
পাখির দেশ থাকে, মাছের দেশ থাকে, মানুষের থাকে না কি? সেই দেশ যেখানে সে প্রাণ-প্রকৃতির একজন হিসেবে বেড়ে ওঠে। বংশ রক্ষা করে। যেখানে দেশ স্বজনের মতো পাশে দাঁড়ায়। আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ। ওঁয়া ওঁয়া শব্দের শিশুকে আশ্রয় যা দেয়, তাই দেশ। পানিত কান্দে পানি কাঁওরি/ শুকনাত কান্দে টিয়া/ আমার অভাইগ্যার অন্তর কাঁদে রে/ পোঁড়া দেশের লাইগ্যা। (মন কান্দে পদ্মার চরের লাইগ্যা, হেমাঙ্গ বিশ্বাস।)
দেশের উপরে যখন রাষ্ট্র এসে সীমানা টানে, তখনই দেশের মানুষ খাঁচার পাখির মতো ঝাঁপটায়। রাষ্ট্রের চোখে তা বেআইনি। যে মাছুয়া গাড়িয়াল ভাইয়ের মতো মাছের পিছে পিছে উজান যায়, যে মাহুত হাতির টানে গোয়ালপাড়া থেকে চিলমারী আসে; যখন বউ ‘কুনদিন আসিবেন মোর মাঁহুত বন্ধুরে’ বলে গান ধরে, রাষ্ট্রের চোখে তা বেআইনি। দেশ ভেঙে রাষ্ট্র গড়ে রাজধানীর কর্তারা। তারা সত্য করে মাছুয়া বা মাহুতের দুঃখ কোনওদিন বুঝবেন না। ফলে তারা কাঁটাতার টাঙাবেন। বানাবেন ফরেন এফেয়ার্স এক্ট ১৯৪৬।
২.
পদ্মা পার হলে নদে, ব্রহ্মপুত্র পার হলে মৈমনসিং। নদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, এবং বাঙ্গালদেশের সঙ্গেও। কোচবিহার থেকে যখন সেখানে যেতুম মনঃকষ্টের কারণ ঘটতো -সমবয়সী আত্মীয় বলতো, 'বাহে';...যার প্রসার ছিল প্রায় সমগ্র উত্তরবঙ্গ, আসাম, ভুটান এবং বিহারের উত্তর-পূর্বাংশ পর্যন্ত।—‘প্রাচীন কোচবিহারের ভাষা ও সংস্কৃতি’ প্রবন্ধে জানাচ্ছেন অমিয়ভূষণ মজুমদার।
এখনো বাহের দেশ মানে ওই ভূখণ্ডই। বাংলাদেশেও বৃহত্তর রংপুর-দিনাজপুর মানেই বাহের দেশ। ভাওয়াইয়া আর নদীই কেবল সেই যোগসূত্র। কোন এক সাদা চামড়ার লোক দাগ টেনে দিয়ে গেছে, তার ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে এই দেশ। কেউ কেউ বলে, স্মৃতিকেও খুঁজতে হয়, খুঁজে পেতে হয়। স্মৃতি একই সঙ্গে স্মরণ ও বিস্মরণে নির্মিত। গণসংস্কৃতি আলাদা আলাদা। টেলিভিশন আর লেখাজোকায় তাকে পাওয়া যায় না। প্রথাগত বিদ্যার বাইরে তা থাকে। সাংস্কৃতিক আচরণ, লোকশ্রুতি, মৌখিক রূপ দিয়ে ধরতে হয়। এই স্মৃতি ও গণসংস্কৃতিকে রাজনীতির সীমানা দিয়ে আটকানো যায় না। দীপেশ চক্রবর্তী বলছেন, ইংরেজ যে ধরনের রাষ্ট্রগঠন ভারতে করেছিল, যে ধরনের ক্ষমতা বিন্যাস করেছিল, যে ধরনের আনুষ্ঠানিক ও প্রাতিষ্ঠানিক জীবনের জন্ম দিয়েছে, তারই ফল নথিপত্র, অভিলেখ্যাগার ও কার্যকারণ সম্পর্কের সূত্রে গাঁথা কাহিনিমালা, যার নাম ‘ইতিহাস’। দুই অঞ্চলের মানুষ এই ইতিহাসে আটকা। পাকিস্তানে শ্বশুড়বাড়ি,/ হিন্দুস্তানে ঘর/ মধ্যিখানে ভূতের ময়দান,/ বউ যে হইল পর। হেমাঙ্গ বিশ্বাস পূর্ব বাংলার মানুষ, তিনি বুঝেছিলেন। কিন্তু যারা বৃটিশের রাষ্ট্র চালায়, তারা দেশের বেদনা কেমনে বুঝবে?
৩.
আসামের মানবাধিকার পরিস্থিতি, অর্থনৈতিক সক্ষমতা, কর্মসংস্থানের হার, মানব উন্নয়ন সূচকসহ নানান সূচকে আসাম বাংলাদেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে। এমনকি জলবায়ু পরিস্থিতিও খারাপ।
কলকাতা বা ঢাকা নয়, গোয়ালপাড়া-রংপুর-মাইনকার চর এই অঞ্চলের জীবন-জীবিকার ঠিকানা। সমস্ত সূচককে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দুই পাড়ের মানুষ পরিযায়ী পাখির মতো জঙ্গলে ও নদীতে ছোটাছুটি করে। এ বড় পুঁজির অর্থনীতি টান নয়, প্রাণ-প্রকৃতিময় জীবন-সংস্কৃতির টান। এপারের ইলিশ যেমন উজানে আসাম যায়, পশ্চিমবঙ্গের বাঘ যেমন এপারে আসে। তবুও বৃটিশের টেনে দেওয়া রেখায় মানুষেরই জীবন, স্মৃতি ও ইতিহাস আটকায়।
৪.
২৬ জন বাংলাদেশিকে কেবা কারা শিখিয়ে দিয়েছে, মাছ মারার কথা কও, ছাড়া পাবে। তারা তাই করেছে। ফলে মামলা জটিল হয়েছে। কোর্ট তাদের হাজতে পাঠিয়েছে। আমি চেষ্টা করছি, শাস্তি যেন ন্যূনতম হয়। এইসব জানিয়েছেন আসামের গৌহাটির বাংলাদেশের সহকারি হাইকমিশনার।
আটক ২৬ জন বাংলাদেশির নামে ফরেন এফেয়ার্স এক্ট-১৯৪৬–এর ১৪ ধারায় মামলা হয়েছে। সেখানে বলা আছে, ‘সুনির্দিষ্ট কোনো শাস্তি নেই। তবে সর্বোচ্চ ৫ বছর পর্যন্ত জেল আছে।’ ইতিমধ্যে তাদের হাজতবাস মাস পেরিয়েছে। ঔপনিবেশিক আইনে শুনানির জটিলতায় কতদিন যাবে, কেউ জানে না। দেখা গেল শাস্তি হলো ১৫ দিন, আর হাজতই খাটা হলো এক বছর। অন্যদিকে উপার্জনক্ষম পুরুষ সদস্যদের অনুপস্থিতি, তার ওপর করোনা পরিবারগুলোকে পথে বসিয়েছে। ঈদের আগে চিলমারীর ইউএনও এক সপ্তাহের খাবার আর ঈদের আগের রাতে একটা করে মুরগি ও সেমাই-চিনি পৌঁছে দিয়েছেন টাঙ্গাইলের এডিসি বজলুর রশিদ। এইটুকুই। কয়েকটি পরিবারের অবস্থা সংকটাপন্ন।
এদিকে আসামে বাংলাদেশের সহকারি হাইকমিশনার তানভীর সাহেব প্রথমে বললেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ না গেলে তিনি কিছু করতে পারবেন না। পরে ঢাকা থেকে নির্দেশ গেলে তিনি নির্দেশপ্রাপ্তির কথা স্বীকার করেন এবং রাজশ্রী দাসগুপ্ত নামে একজন আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে বলে জানান। ইতিমধ্যে ২ মাসের জেল হয়েছে, এটা যাতে বছরে না গড়ায় সে চেষ্টা উনি করছেন। কিন্তু আইনজীবী রাজশ্রী দাসগুপ্ত জানিয়েছেন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের তরফে নিযুক্ত হননি। স্থানীয় আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে হয়েছেন। আটক ২৬ জন বাংলাদেশির ব্যাপারে চার্জশিট এখনো দেয়নি পুলিশ। এখনো তদন্ত চলছে।
‘মাস তো হয়া গেল, আর কুনদিন আইসপে? বাজানের সাথে এহনা (একটু) আও কইরবের পাইলে কইলজেটা ঠান্ডা হৈল হয়। তোমরা এহনা ব্যবস্থা কর বাহে।’
এইসব প্রতিদিনের জিজ্ঞাসা। উত্তরের আকাঙ্ক্ষায় থাকা জোড়া জোড়া সরল চোখে অন্ধকার। কে দেবে আশা, কী উত্তর দেবে বাংলাদেশ?
নাহিদ হাসান রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভাপতি।